Ads

৩১ বছর বর্ষপূর্তিতে শুভ কামনা ঠিকানা, নিউইয়র্ক

এইচ বি রিতা

আমেরিকান চিত্রনাট্যকার ও লেখক অ্যানিতা লুস বলেছিলেন, ‘স্মৃতি কলমের কালির চেয়েও স্থিতিশীল, যা অপরিবর্তিত।’
স্মৃতিকথা আমাদের জীবনের গল্প, আমাদের উত্তরাধিকার সংরক্ষণের দুর্দান্ত একটি উপায়। ছোট-বড় সুখ-দুঃখ জীবনের প্রতিটি মাইলফলক এবং ফেলে আসা বিশেষ ঘটনাগুলোই আজকের আমাদের জন্ম দেয়। সফলতার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত মানুষটির রূপ দিতে সহায়তা করে। শুধু তা-ই নয়, আমাদের ফেলে আসা ঘটনা, অর্থাৎ স্মৃতিগুলো কলমের আঁচড়ে লিপিবদ্ধ করতে উর্বর ক্ষেত্রও তৈরি করে থাকে।

সাপ্তাহিক ঠিকানা। নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটিতে ঠিকানা বেশ পুরোনো একটা সংবাদমাধ্যম। এবং ঠিকানা আমার দীর্ঘ ২১ বছরের প্রবাসজীবনে আমার লেখা একটি কবিতা প্রকাশের প্রথম পত্রিকা। কবিতাটির নাম ছিল ‘খাদিজা’। ঠিকানায় প্রকাশ করা হয় ২০১৬ সালের ২৬ অক্টোবর। যদিও এর আগে ও পরে বহু বিজ্ঞাপন, লেখাও এসেছে ঠিকানায়, তবু কবিতার বেলায় এটাই ছিল আমার প্রথম তৃপ্তি। দীর্ঘ  প্রবাসজীবনে নিয়মিত সাহিত্যচর্চার পর কোনো পত্রিকার পাতায় নিজের কবিতাখানা দেখার যে সুখটা অনুভব করেছিলাম সেদিন, তা বোধ করি আজকের নবীন লেখকেরা পাবেন না। কেননা আজ আর পত্রিকার পাতায় নিজের লেখা দেখতে আমার মতো কারো দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় না।
নারী ‌অধিকার নিয়ে বেশ কিছু লেখা আমি ঠিকানায় লিখেছি। সাথে কবিতা। লেখা নিয়ে টপিক বা শব্দের ব্যবহারের কোনো সীমাবদ্ধতা কখনো পাইনি ঠিকানায়।

প্রতি সপ্তাহের বুধবার স্কুল সময় শেষ করেই ছুটে যেতাম জ্যাকসন হাইটসে। হাটবাজার থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করতাম। মূল্য ১ ডলার মাত্র। সে সময়টাতে মনে হতো, মাত্র ১ ডলার! মাসে দু-একটা লেখা ঠিকানা ছাপিয়ে দিলে যে সুখটা পেতাম, তার মূল্য ১ ডলার যথেষ্ট মনে হতো না।
কিশোরী বয়সে ১৯৯৯ সালে নিউইয়র্কে পাড়ি দিই। তখনো লিখতাম। তবে দেশীয় স্কুল শিক্ষা কম থাকায় সাহিত্যবিষয়ক জ্ঞান নিতান্তই কম ছিল। তবু থামিনি। রোজ চর্চা করেছি, শিখেছি। জ্যাকসন হাইটসের সাইডওয়াক এবং বাঙালি দোকানগুলো থেকে ডাবল দামে শুদ্ধ বানান, সমার্থক শব্দের ব্যবহার বইগুলো কিনতাম। বাংলা একাডেমির কিছু বই এবং বিখ্যাত কবি-লেখকদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার প্রচুর বই আমি কপি করে এবং ডাউনলোড করে পড়েছি। শিখেছি, জেনেছি। এখনো পড়ি, এখনো শিখি।

আমার বাবা ছিলেন একজন গীতিকার, সুরকার, লেখক, নাট্যশিল্পী এবং বিশ শতকের একজন কবি। অধ্যাত্ম সাধনা ও সাহিত্যচর্চা ছিল তার অন্তরের বস্তু। জীবদ্দশায় বাবা অসংখ্য কবিতা, গল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, নাটক ও গান রচনা করে গেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। বাবার রচিত গানের মধ্যে নুরতত্ত্ব সৃষ্টি, নবীতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ভাবতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, আধুনিক, বিচ্ছেদ, দেশাত্মবোধক এবং বিবিধ পর্যায় উল্লেখযোগ্য। এসব গানের ভাব এবং তত্ত্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। তথ্য কাব্য এবং মরমি সংগীত রচনা ছিল বাবার প্রিয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও সুরকার। হতে পারে সেই পৈতৃক সূত্রে সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি, গবেষণা আমার স্বভাব ও অভ্যাস।

সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার সাথে আমার পরিচয় সেই ২০১২ সালের মার্চ মাস থেকে। আমি তখন তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকি, বৃদ্ধ মা এবং দুটি শিশুসন্তানকে নিয়ে। সে সময় বাসা ভাড়া দিতাম ১৬০০ ডলার। পরিবারের‌ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচের সাথে বাসা ভাড়ার মূল্যটা খুব বেশি চাপে ফেলে দিত আমাকে। তাই প্রতি সপ্তাহে বিজ্ঞাপন দিতাম ঠিকানায়-একজন মেয়ে রুমমেটের সন্ধান পেতে।
সেই সুবাদে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আমার এবং আমার বাবার নামে প্রকাশিত মোট দুটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে একটি সুন্দর প্রচারণা করে ঠিকানা পত্রিকা। তার পর থেকেই লেখা শুরু।

কমিউনিটিতে খুব একটা মেলামেশার সুযোগ ছিল না আমার। ২০১২ সালের দিকে পত্রিকা বলতে শুধু ঠিকানাকেই জানতাম। প্রতি সপ্তাহে একটা করে পত্রিকা কিনে আনতাম। কখনো যেতে না পারলে দোকানে বলে রাখতাম সংগ্রহে রাখার জন্য।
ঠিকানা এখনো পড়ি। দীর্ঘ ভারী পত্রিকাটি হাতে নিলেই খুব আপন মনে হয়। নিত্য খবর, রাজনীতি, ব্যবসা, ইমিগ্রেশন, স্বাস্থ্য, সাহিত্য, বিনোদন, আন্তর্জাতিক খবর আমরা পেয়ে যাই ঠিকানায়।

জীবনে ‘প্রথম’ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সব সময়ই হয় সুখগাথা কিংবা শোকগাথা। ঠিকানা পত্রিকার সাথে আমার এমনই একটি সুখ গেঁথে আছে বহুদিন।
আজও লিখি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তড়িৎ গতিতে লিখি। তবু পাঁচ বছর আগে সেই প্রথম একটি কবিতা প্রকাশ হওয়া সাপ্তাহিক ঠিকানাকে আজও স্মৃতিতে, হৃদয়ে লালন করি।
শুভকামনা সাপ্তাহিক ঠিকানা।

লেখকঃ প্রবাসী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র 

আরও পড়ুন