Ads

আমরা কি জানি আমাদের সন্তানরা কি শিখছে?

হাবিবা মুবাশ্বেরা

“ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা

সব শিশুরই অন্তরে”

অর্থ্যাৎ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য কি ভবিষ্যত তৈরি করছি ? আমরা আমাদের সন্তানদের উচ্চ বেতন দিয়ে ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি, স্মার্ট টিভি, মোবাইল ফোন দিয়ে তাদের বিনোদনের চাহিদা স্মার্টলি পূরণ করছি, আর এই আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি যে. যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অভিভাবক হিসেবে আমরা আমাদের  সবধরনের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি। কিন্তু আমরা কি আদৌ খতিয়ে দেখেছি আমাদের শিশুরা একাডেমিক শিক্ষা এবং বিনোদন এর মাধ্যমে বাস্তবিকই কি শিখছে?

আসুন, একাডেমিক শিক্ষা এবং বিনোদন মাধ্যমের  কনটেন্টগুলো একটু পর্যালোচনা করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি।

একাডেমিক শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। ইদানীং এই প্রাথমিক শিক্ষার সিংহভাগ প্রদান করা হয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে। দেশের শহরাঞ্চলের অলিতে-গলিতে  এখন ব্যাঙ এর ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছড়াছড়ি। বড় স্কুলগুলোর আসন স্বল্পতা এবং যাতায়াতের ঝামেলা বাঁচানোর সুবিধার্থে অভিভাবকরা তাদের সন্তানের জীবনের প্রথম বিদ্যাপীঠ হিসেবে বেছে নেন এসব স্কুলগুলোকে। ভাড়া বাসায় কয়েকটা রুম বা ফ্লোর নিয়ে গড়ে ওঠা এসব স্কুলগুলিতে নেই কোনো মাঠ, টানা বারান্দা, পর্যাপ্ত টয়লেট কিংবা প্রয়োজনীয় আলো-বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা। অথচ নামের শেষে ‘ অমুক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ এবং ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনও তাই  অনেক বেশি। 

আধুনিক পদ্ধতিতে আধুনিক সিলেবাসে পড়ানো হয় –এই  আকর্ষণীয় প্রচারণায় মুগ্ধ হয়ে অভিভাবকরা তাদের তিন-চার বছর বয়সী শিশু সন্তানদের সাত সকালে  প্রি-প্লে বা প্লেগ্রুপে ক্লাস করতে নিয়ে যান। অথচ সকাল বেলার নির্মল বাতাসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সমস্বরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, শপথ বাক্য বলা কিংবা তালে তালে পিটি করার যে আনন্দ –তা এসব স্কুলের শিশুরা পায় না। শৈশব থেকেই শারীরিক ও মৌখিক জড়তা কাটানোর জন্য, proper uniform maintain করা ও  discipline শেখার জন্য এই assemblyর গুরুত্ব অপরিসীম, যা এসব স্কুল দিতে পারছে না।

 এসব স্কুলে বাংলা, ইংরেজি, গণিতের বাইরেও পরিবেশ, বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান এবং কম্পিউটার সহ এত এত বিষয় কোমলমতি শিশুদের পড়ানো হয় যে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার আগ্রহ বা সময় শিশুদের অবশিষ্ট থাকে না। সারা বছর জুড়ে CT পরীক্ষা, ৩টা সাময়িক পরীক্ষার চাপে ক্লান্ত শিশুরা এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে, বই মানেই  তা পড়ে পরীক্ষা দিতে হয় এবং ভালো নম্বর পাওয়াতেই এই পড়ার সার্থকতা। আমরা ইদানীং প্রায়ই আফসোস করি যে, এই যুগের বাচ্চারা অবসরে বই পড়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয়, অথচ আমরা একবারও ভেবে দেখি না যে, তারা সারা বছর এত পাঠ্য বই পড়ে যে অবসরেও আবার সেই ‘বই ’ পড়তে তাদের ভালো না লাগারই কথা।

তাছাড়া শিশু বয়সেই এত বিষয়ের বই পড়ে, পরীক্ষা দিয়ে তারা আদৌ কতটুকু জ্ঞানার্জন করছে তা পর্যবেক্ষণ করাও জরুরী। বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ও কম্পিউটারের মতো বিষয়গুলো বইয়ের পাতায় যা পড়ানো হয়, হাতে-কলমে তা শেখানো হয় না বলে তাদের কাছে এগুলো শুধু মুখস্থ করে খাতায় লিখে আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অ্যাবাকাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে কম্পিউটার আবিষ্কারকদের কঠিন কঠিন নামের বানান  মুখস্থ করলেও এসব শিশুরা আদতে কম্পিউটার open বা shut down করার মতো বেসিক জিনিস জানে না। সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে বিভিন্ন দিবসের নাম মুখস্থ করে ঝরঝরা করে ফেললেও স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার দেখলে বলতে পারে না কোনটা কেন তৈরি হয়েছে। তাহলে এই পড়ার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল কি?

এরপর তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলে শুরু হয় সরকারী, বেসরকারী সব স্কুলেই ‘সৃজনশীল ’ নামক বিভীষিকা।  শিশুরা নিজেদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেরাই উত্তর বানিয়ে লিখবে– এই আপাত মহৎ অথচ বাস্তবে অসম্ভব উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারী  পাঠ্য বইয়ের অধ্যায়গুলোর শেষে এমন সব প্রশ্ন সংযুক্ত করা হয়েছে যার উত্তর বইয়ের ভেতরে নেই। বই রিডিং পড়ে সেখান থেকে অনুশীলনীর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না বলে শিক্ষার্থীরা এখন বইটাই ভালো মতো পড়ে না। আর বইয়ের বাইরের যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নগুলোর উত্তর শিক্ষার্থী তো দুরের কথা, সাধারণ অভিাভাবকরাও তৈরি করতে পারেন না। 

ফলাফল হলো এ্ই যে ,শিশু বয়সেই তারা হয় গাইড বই কিংবা শীট পড়া শেখে নাহয়  স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কোচিং করতে বাধ্য হয়। এভাবে নিজ স্কুলের অভ্যন্তরীন পরীক্ষাগুলোর  বৈতরণী পার হওয়া গেলেও তারা যখন পিএসসি, জেএসসি বা এস এসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় unseen প্রশ্নের মুখোমুখী হয় তখন যেন উতরে যেতে পারে সেজন্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, নকল করা কিংবা পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের উত্তর বলে দেয়ার মতো অসাধু উপায় অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। 

আমরা  ইদানীং পঞ্চম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁস হতে দেখে অবাক হয়ে যাই কিন্তু নেপথ্যের কারণটা অনেকেই বুঝতে পারিনা। শিক্ষার নামে এই শুভন্করের ফাঁকি বছরের পর বছর ধরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সর্বস্তরে চলছে বলেই এইসব শিক্ষার্থীরা  বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় শূণ্য পায় কিংবা প্রক্সি পরীক্ষার্থীর শরণাপন্ন হয়।

‘পাঠ্যবই থেকে শেখা’  ও ‘পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে সেই শেখার প্রতিফলন ঘটানোর ’ সুযোগ নেই বলে  সমন্বয়হীন এই একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জ্ঞানের মেরুদন্ডকে শক্তিশালী তো করছেই না বরং নৈতিকতার মেরুদন্ডকে দুর্বল করে দিচ্ছে জীবনের প্রারম্ভেই।

এই অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের  উপায় কি? 

প্রথমত:  অভিভাবকদের একত্রিত হয়ে জনমত তৈরি করা দরকার যে, পাড়া-মহল্লার এসব ছোট ছোট কিন্ডারগার্টেন  স্কুলগুলোকে merge করে প্রতিটা এলাকায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একটি করে বড় স্কুল তৈরি করা। এজন্য প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং  সরকারী শিক্ষা অফিসারের সাথে আলাপ করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানানো যেতে পারে। আমরা যেন এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি যে, অধিক বিষয় মুখস্থ করলেই অধিক শিক্ষিত হওয়া্ যায় না বরং সংকীর্ণ পরিসরে শিক্ষা লাভ করলে শিশুরা সংকীর্ণ মন নিয়ে বেড়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত: তথাকথিত  সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা এখন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় এটা প্রমাণিত  হয়েছে যে, প্রকৃত সৃজনশীল শিক্ষা দেয়ার মতো সঠিক পাঠ্যবই প্রণয়ন ও অভিজ্ঞ শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব হয়নি বলে এই পদ্ধতি এখন শিশুদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। তারা আগে যতটুকু শিখতো এখন তাও শিখছে না। ফলে শিক্ষার প্রাথমিক ভিতটাই দুর্বল হয়ে গড়ে উঠছে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করা এখন অতীব জরুরী।

তৃতীয়ত: অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের SO CALLED GPA 5 পাওয়ার জন্য চাপ না দিয়ে বরং তারা যেন প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি অধ্যায় ভালোভাবে রিডিং পড়ে, তা থেকে কি  বুঝতে পারলো তা যেন বলতে এবং লিখতে পারে সে ব্যাপারে focus করা। একটি ক্লাস পাশ করে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়া মানে যেন শুধু কতগুলো নম্বর পাওয়া না হয় বরং একটি ক্লাস শেষ করা মানে যেন সেই শ্রেনির সবগুলো বিষয়ের সবগুলো অধ্যায় থেকে যা শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা  সন্তান আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছে কিনা তা যাচাই করা হয়—-অভিভাবকদের মূল্যায়নের মাপকাঠি এমনটা হওয়া উচিত। 

এককথায়  একাডেমিক শিক্ষার  গুণগত মানের ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং শিক্ষার মূল্যায়নের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা আমাদের অভিভাবকদের  জন্য সময়ের দাবী।

চলবে

লেখকঃ সাহিত্যিক

আরও পড়ুন