Ads

এক্সটেন্ডেড গার্ডিয়ানশিপের কুফল এবং আমাদের সামাজিক দায়িত্ব

মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক

Let them fly with their wings power, let them stand on their own feet, let them be the best of them.
শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যারা অলরেডি বড় তাদেরকে অহেতুক ছোট মনে করা কিংবা ছোট হয়ে চলতে বাধ্য করার এই সামাজিক অপব্যবস্থার নিরসন হওয়া জরুরী।
Let our adult children claim their youthfulness with full potential and proper responsibilities. Don’t consider them and socially force them to behave as adolescents. Let them earn, get their own family, and live their own life.
অভিভাবকরা কেন নিজেদের স্বপ্ন তাদের সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, সেটা আমার বুঝে আসে না।
(১) শিক্ষাব্যবস্থার সংকট,
(২) সন্তানদের ব্যাপারে গার্ডিয়ানদের মাত্রাতিরিক্ত ক্যারিয়ারমুখী চিন্তাভাবনা এবং
(৩) তরুণদের সুবিধাবাদিতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতার কারণে
গড়পড়তা কমপক্ষে ১০টা বছর আমাদের তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবন থেকে হারিয়ে ফেলছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে উর্বর, সবচেয়ে ভালো দশটা বছর…! ভাবা যায়…? তারুণ্যের কি নিদারুন অপচয় …!
আজকে আর এ বিষয়ে লিখতে চাচ্ছি না। বরং এ বিষয়ে পুরনো একটা লেখা শেয়ার করছি।
“সমকালীন বাংলাদেশ সমাজের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হলো extended tenure of guardianship। হ্যাঁ, এটি একটা অশ্রুতপূর্ব বিরাটা সমস্যা। সামাজিক সমস্যা নিয়ে যারা কথাবার্তা বলেন, তারা কখনো এমন একটা সমস্যার কথা বলেন নাই।
ছেলে-মেয়েদের অভিভাকত্ব কতদিন হওয়া উচিত?
ইসলামী শরিয়াহ’র দৃষ্টিতে এটি তাদের সাবালকত্ব অর্জন করা পর্যন্ত। প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পরে অভিভাবকদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে মেয়েদের। ব্যস এতটুকুই। আর হ্যাঁ, বড় হওয়া তথা প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া পর্যন্ত তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
তাদেরকে আয়-উপার্জনের জন্য সক্ষম করে গড়ে তোলার প্রাথমিক কাজটি একইসাথে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব। সেটি হতে পারে মিড টিন এইজ পর্যন্ত। শিক্ষাব্যবস্থার হিসাবে হাই স্কুল অর্থাৎ ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত, বড়জোর। এরপর বাচ্চাটির উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি, এগুলো মূলত: রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়িত্ব। বাবা-মা’র যে পরিবার, তারা সন্তানের উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারে সহযোগিতা করতে পারে। সেটি ঐচ্ছিক। নীতিগতভাবে এটি নিছকই পারষ্পরিক সম্পর্ক ও সম্মতির ব্যাপার।

 

সন্তানকে এস্টাবলিশ করে দেয়া বাবা-মা’য়ের দায়িত্ব নয়। আমার এই কথাটা ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল গ্রহণযোগ্যই নয়, বরং এটিই কোরআন, হাদিস, সীরাত ও কাণ্ডজ্ঞানের কথা।

 

আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অব্যবস্থার ফলে এখানে সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য লাইন ধরে, এটি অতিরিক্ত মেয়াদে অভিভাবকত্ব পালনের এই সমস্যা তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ। উচ্চশিক্ষা অর্জনে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সময় লাগে অনেক বেশি, এটিও সমস্যার অংশ। চাকুরীর ক্ষেত্রে ওভার কোয়ালিফাইড হওয়াকে অযোগ্যতা হিসাবে গণ্য না করে একধরনের যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এটিও সমস্যার অন্যতম উৎস।
স্বতন্ত্রভাবে এগুলো বড় বড় সমস্যা হলেও সামগ্রিকভাবে এর চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, অভিভাবক তথা বাবা-মা’র মূর্খতা, অজ্ঞতা ও ভুল মন-মানসিকতা।
মুসলিম মেজরিটির এই দেশে ইসলামপন্থীরা ওভারঅল খুব শক্তিশালী। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার নির্মম খেলায় কখনো কখনো অমুক তমুক দল দমন-নিপীড়নের স্বীকার হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে এ’ দেশে ইসলাম বরাবরই একটা লিডিং ফ্যাক্টর। সামগ্রিকভাবে ইসলামপন্থীরা এদেশে অন্যতম একটি ডিপ-স্টেট।
কিডস রেইজিংয়ের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে এ সময়কার পাশ্চাত্য কালচারের যে হুবহু মিল, তা এখানকার ইসলামিক ডিককোর্সে একেবারেই অনুপস্থিত। পাশ্চাত্যবাসীদের যৌবনকালীন ও বার্ধক্য-অবস্থার সামাজিক ব্যবস্থা ইসলামের মিলে না। বরং বিপরীত। কিন্তু, সন্তান লালানপালন তথা অভিভাবকেত্বের দিক থেকে তাদের ব্যবস্থা আর ইসলামের ব্যবস্থা অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।
আমি এই প্রসংগে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের কথা পাশাপাশি বললাম এ জন্য যে এখানকার লোকেরা এই দুইটা ডমিন্যান্ট ফোর্সের কোনো একটাকে ক্ষেত্রবিশেষে কোনোকিছুর গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড হিসাবে গ্রহন করে।
ঘরে ঘরে, লক্ষ করলে দেখবেন, বাচ্চারা টিন এইজের মাঝামাঝি হতে বেয়াড়া হয়ে উঠে। তাদেরকে সামাল দেয়া খুব কঠিন। আর্লি টুয়েন্টিজের একটা বাচ্চার সাথে বাবা-মা’কে আসলে এক প্রকারের সমঝোতা করেই চলতে হয়। এর কারণ হলো, প্রাপ্ত বয়ষ্ক হলে মানুষের একটা নিজস্ব say তৈরী হয়। হওয়াটাই স্বাভাবিক। না হওয়াটা অস্বাভাবিকতা। অথচ, এ ধরনের say-less বাচ্চাদেরকে আমরা সো-বার বলে এপ্রিশিয়েট করি। অদ্ভূত ….!
পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। সেগুলোর দরকারও আছে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি দরকার হল, বাবা-মা হতে যাওয়া মানুষগুলো যাতে বাবা ও মায়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে সে জন্য উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। বিয়ে করলেই বাচ্চার ‘মালিক’ হওয়া যায়। কিন্তু আদর্শ বাবা ও মা হওয়ার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা। সেটি বিএ-এম.এ পাশ করা নয়। বরং, সন্তান লালনপালনের যথোপযুক্ত কৌশল ও পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা। স্বামী-স্ত্রী’র পারষ্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা। আত্মীয় স্বজনের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা।
মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটি মানুষ স্বাধীন। প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া মাত্রই এই মানবিক দায়িত্ব প্রত্যেকটা মানুষের ওপরই বর্তায়। তাই তার ওপর ফরজ হয় শরয়ী নিয়মকানুন। ধর্ম, নৈতিকতা ও আইনের দৃষ্টিতে একজন পূর্ণ মানুষকে যখন আপনি কুক্ষিগত করে রাখবেন, আগলে রাখবেন, দমন করে রাখবেন, শিশু হিসাবে ভাববেন, তখন অজান্তে কিন্তু অনিবার্যভাবে সামাজিক কাঠামো বা সোশ্যাল ফ্রেব্রিকের মধ্যে আপনি একটা ঝামেলা পাকালেন।
একজন সিটিজেন যখন নিজেকে ডিপেনডেন্ট হিসাবে আবিষ্কার করে তখন সে আত্মনির্ভরশীল না হয়ে সুবিধাবাদী হয়ে উঠবে। তার স্বাধীন সত্তার বিকাশ ও স্বকীয়তা বাধাগ্রস্ত হবেই। না হওয়ার কোনো কারণ নাই। ভুল করে আমরা তথা বড়রা মনে করি, ‘ও তো এখনো ছোট। ও কী বুঝে? আমিই ঠিক করে দিবো তার জন্য যা কিছু ভালো সব। ও কি আমার চেয়ে বেশি বুঝে?’
হ্যাঁ, হতে পারে সে আপনার চেয়ে কম বুঝে। কিন্তু তাকে তার মতো করে বুঝতে দেন। তার বুঝজ্ঞান তৈরী হওয়াতে আপনি সহযোগিতা করেন। কিন্তু চাপিয়ে দিবেন না। মানুষের স্বভাব হলো, সে চাপিয়ে দেয়া কিছুকে গ্রহণ করতে চায় না। এমন কি তা যদি ভালোও হয়। চাপিয়ে দিলে কোনো সত্য, সঠিক ও জ্ঞান আর সত্য, সঠিক ও জ্ঞান থাকে না। বরং ডগমা হয়ে উঠে। তাই সত্যকে খুঁজে নিতে হয়। জ্ঞানকে অর্জন করতে হয়। অভিভাকত্বের নামে আমরা বাচ্চাদের ওপর এইটা-ওইটা চাপিয়ে দিচ্ছি। এটি ঠিক হচ্ছে না। একজন সমাজকর্মী হিসাবে এটি বলে দেয়া দায়িত্ব মনে করছি। তাই লিখছি।
বাচ্চাদের পিছনে এভাবে অনর্থক ছোটাছুটি করার আর একটি গূঢ় কারণ হলো, এই অভিভাবক গোষ্ঠীর নেতিবাচক স্বার্থপর চিন্ত। ‘আমার বাচ্চার এইটা, আমার বাচ্চার ওইটা …’ এটাই যেন তাদের অব্যক্ত মনের একমাত্র জিকির। কেন, আপনি অন্যের বাচ্চাদেরকে দেখেন না? তাদের জন্য কিছু করার কথা মনে পড়ে না? একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসাবে বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্বসমূহ পালনের কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত হওয়ার কথা আপনার কক্ষনো মনে পড়ে না?
আমি জানি, নিজের সংসারের বাইরে বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্বপালনের বাধ্যবাধকতা তাদের মনে পড়ে না। বিশেষ কোনো দলের খাতায় নাম থাকা, তাদের কিছু রুটিন কাজ করা, ফেইসবুক ‘পড়া’, এগুলো তেমন কাজের কাজ কিছু নয়। যেমন করে, টিভি সিরিয়াল দেখার মানে নয় সমাজ সচেতনতা অর্জন করা।
আল্লাহ রাসূল (স.) বলেছেন‘সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’

 

আল্লাহ তায়ালা সূরা তাকাসুরে বলেছেন, ‘প্রত্যেকটা নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’। ইসলামী জীবনদৃষ্টি মোতাবেক, কাউকে নিজ ভিন্ন অপরের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে না। কোরআনের কয়েক জায়গাতে এমন কথা বলা আছে যা এক ধরনের radical existentialismএর কথা বলে। বলা হয়েছে, কর্মফল পাওয়া তথা চূড়ান্ত ফায়সালার দিনে মানুষ পরিবারের লোকদের থেকে পালিয়ে যাবে। নিজের ছাড়া অন্য কারো কথা তার মনে পড়বে না।
তাই তো কিছুদিন আগে লিখেছিলাম, নিজের জীবন যাপন কর। অন্যের জীবন যাপন করো না। নিজের জন্য বাঁচ। অন্যের জন্য বাঁচতে যেও না। অন্যথায়, নির্ঘাৎ তুমি হতাশাগ্রস্ত হবে। বালুচরে ঘর বাঁধার মতো তোমার সব আবেগি ভাবনা অচিরেই ভেংগে পড়বে।
বাস্তববাদী হও। অস্তিত্ববাদী হও। আত্মসচেতন হও। তোমার যা অধিকার তা নির্দ্বিধায় দাবী করো। অযথা সেক্রিফাইস করতে যেও না। সেক্রিফাইসের ওপর শেষ পর্যন্ত কেউ-ই টিকে থাকতে পারে না। প্রতিদানের আশা না করেই এবং সংশিষ্ট ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ চরিত্রের হলেও, অন্যের প্রতি তোমার যা কর্তব্য তা সম্পন্ন কর। নিজের ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোল। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হও।
এ দুনিয়াতে তোমার কী করণীয়, কেন তোমাকে আল্লাহ তায়ালা বানিয়েছেন তা খুঁজে নিয়ে সেইটা সম্পন্ন করার জন্য সচেষ্ট হও। কেউ তোমার জীবনে সফলতা এনে দিবে না, তুমি নিজে ছাড়া। প্রত্যেকের জীবন প্রত্যেকের। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র হলো আমাদের পারষ্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র। আমার পরিচয় আমি নিজে যা, তা।
একজন অভিজ্ঞ, জীবনবাদী ও স্পষ্টভাষী ব্যক্তির এই অপ্রিয় কথাগুলো নিয়ে ভেবে দেখ। এগুলো স্মরণে রাখ। ভাল থাক। একজন সফল অভিভাবক হিসাবে তোমাকে জানাই শুভেচ্ছা।”
লেখকঃ কলাম লেখক  ও পরিচালক, মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র, সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র
লেখকের প্রকাশিত লেখা-
আরও পড়ুন