Ads

‘বাচ্চা সবাইকে খুব মারে’ কি করবেন?

উম্মে সাল্মা কলি

“বাচ্চা সবাইকে খুব মারে” কি করব? খুব কমন জিজ্ঞাসা মায়েদের। কিভাবে চেঞ্জ করা যায় এই স্বভাব তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তারা উদ্বিগ্ন। কিন্তু সমস্যা হলো তারা ইন্সট্যান্ট সমাধান চান। যেন এটার সমাধান একটা ট্যাবলেট, গুলে খাওয়ালাম আর ঠিক।
যাদের বাচ্চা শান্ত, বোঝালেই বোঝে, তারা ঠিক এসব জেদী, মারকুটে বাচ্চাদের সমীকরণ বুঝে উঠতে পারেন না। তাই তারা ওই মাকে উপদেশ দেন, বুঝিয়ে বলুন, সুন্দর করে কথা বলুন। উনারা উনাদের অভিজ্ঞতা হতেই একথা বলেন, যেহেতু তারা শান্তশিষ্ট বাচ্চার মা। কিন্তু যারা শিশুদের নিয়ে কাজ করে তারা জানে, এই বুঝিয়ে বলা সব বাচ্চার ক্ষেত্রে কাজ করে না।

একটা উদাহরণ দেই – কিছু কিছু মানুষ বেপরোয়া গাড়ি/বাইক চালাতে গিয়ে একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফাইন দিলে আর কখনোই ওই কাজ করেনা। কেউ কেউ কোর্টে কেস না যাওয়া পর্যন্ত শোধরায় না৷ আর কেউ জেল খেটে বের হয়েও একই কাজ করে।
তেমনি সব বাচ্চার জন্য গনহারে এই বুঝিয়ে বলুন, সুন্দর করে কথা বললে সব বাচ্চা বুঝে, এসব উপদেশ কোনো কাজেই লাগে না। বাচ্চাকে মারবেন না, চিৎকার চেচামেচি করবেন না, কিন্তু তার মানে এই না যে তাকে বকা দেয়া, ধমক দেয়া যাবেনা। অবশ্যই সেটা লাস্ট অপশন, অন্য সব অপশন ফেইল করার পর।

বাচ্চারা কেন মারে? বহু কারন আছে এর। অনেক মা ই বলেন, “আমরা তো ওকে মারিনা, ও কই হতে শিখলো”। এটা একটা সহজাত শিক্ষা বলা যায়। আপনি মারেন না, কিন্তু ও অন্য বাচ্চাদের হয়তো মারতে দেখেছে, কার্টুনে দেখেছে বা আপনারা যে নাটক দেখেন সেখানে। অথবা রাস্তায় কাউকে দেখেছে। আশেপাশের পরিবেশে কাউকে কখনোই মারামারি করতে দেখেনি, টিভিতে দেখেনি এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাও যদি তেমন হয়ে থাকে, তবে সেটাতেও অবাক হবার কিছু নেই।

বাচ্চারা ১ বছর বয়সের পর হতেই কম্যুনিকেশন এর চেষ্টা করে কিন্তু কথা যেহেতু তখনও বলতে শেখেনি তাই তারা নিজেকে ঠিকঠাক প্রকাশ করে উঠতে পারে না। তখনই বাচ্চারা জেদি হয়ে উঠে, মারতে শুরু করে।

মারামারির পেছনে একটা পাওয়ার ফ্যাক্টর থাকে। বাচ্চা যখন দেখে সে অন্য বাচ্চাকে মারলে বাচ্চাটি ভয় পাচ্ছে, সে যা চায় তা দিয়ে দিচ্ছে, তখন সে আরও উৎসাহিত হয়ে উঠে। বাড়িতেও দেখে জেদ করে মারলে সে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে যাচ্ছে। শক্তি প্রদর্শনের ব্যাপারটাও চলে আসে। অন্যদের আঘাত করে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকে শিশুটি। ওই সময়ে বাচ্চাকে না থামানো গেলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ প্রবণতা বাড়তে থাকে।

বাচ্চাকে থামাতে মা বাবাও যদি বাচ্চাকে মারতে শুরু করে, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়।

প্রথম ক্ষেত্র – ভয় পেয়ে ও শক্তিতে না পেরে মা বাবা বা বড় কাউকে হয়তো মারে না সে আর, কিন্তু সমবয়সী ও ছোট কাউকে পেলেই তার এই প্রবৃত্তি জেগে উঠে। এরা স্কুলে bullying করে। বড় হয়ে এবিউজ করে স্ত্রী-সন্তানকে।

দ্বিতীয় ক্ষেত্র – এরা মার খেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, সব সাহস হারিয়ে ফেলে, নিজের উপর কনফিডেন্স থাকে না আর। এরা বড় হয়ে সব কিছুতে আপোষ করে, নিজের উপরই বিশ্বাস করতে পারেনা।

কি করবেন তাহলে? বোঝানোর প্রাথমিক চেষ্টা অবশ্যই করবেন। তবে একটা ব্যাপারে স্ট্রিক্ট থাকবেন, বাসায় কোনো রকম ভায়োলেন্ট ব্যাবহার সহ্য করা হবে না। এটা শুধু বাচ্চার জন্য নয়, পরিবারের সব সদস্যদের জন্যই এই নিয়ম। বাসার দেয়ালে, ফ্রিজের সাথে বড় কাগজে এ কথা লিখে আটকে রাখুন, যাতে আসতে যেতে সবার চোখে পড়ে।

যৌথ পরিবারে থাকেন। বাড়ির অন্য বাচ্চারা/সদস্যরা আপনার বাচ্চাকে মারে তাই আপনার বাচ্চাও ওদের মারে। কিভাবে বাচ্চাকে বোঝাবো, এ প্রশ্ন করলে আপনার শাস্তির ব্যবস্থা আগে করা দরকার। বাচ্চার সুস্থ বিকাশের জন্য বাসায় কেউই মারামারি করতে পারবে না। এমনকি বাচ্চার বাবাও না। তারও অধিকার নেই বাচ্চাকে মারার। মা হিসেবে আপনার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য নিজের সন্তানকে রক্ষা করা। তাতে অন্য সম্পর্কের ১২টা বাজলে বাজবে।

বাচ্চাকে যেভাবে বোঝাবেন

*বাচ্চা ২ বছরের কম বয়সী হলে মারার আগে হাত ধরে ফেলবেন, যে বিষয়গুলো মারমুখী প্রবনতাকে ট্রিগার করে তা এড়িয়ে চলবেন।
*২ থেকে ৩ বছর বয়সীদের শক্ত গলায় মানা করবেন। হাত আটকাবেন। ব্যাথা কেন দেয়া উচিত না তা বোঝাবেন। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে ধমকে হলেও সরিয়ে আনতে হবে।
*৩ এর বেশি বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে consequence rule এপ্লাই করতে হবে। যতবার মারবে ততবার। কি ধরনের consequence আপনি ওর খারাপ কাজের প্রেক্ষিতে দেবেন তা আগেই ঠিক করে নেবেন। এমন কোনও কাজ দেবেন না যা ওর পক্ষে অসম্ভব।
যেমন ধরুন, আপনার ছেলে তার বড় বোনকে মেরেছে। এক্ষেত্রে যতক্ষণ না সে Apology note লিখবে বোনকে ততক্ষণ সে তার প্রিয় কার্টুন পাবে না।
বা ধরুন বাবাকে মারার পর ১০ বার sorry লিখলে তবেই বাবা তার সাথে কথা বলবে, নইলে না।
বাচ্চার অতিরিক্ত মারামারির অভ্যাস থাকলে যা কিনা স্বাভাবিক নয়, সেক্ষেত্রে স্পেশালিষ্ট দেখাতে হবে। বাচ্চার বয়স ৬ অতিক্রান্ত হবার পরও মারামারির অভ্যাস না গেলে সেক্ষেত্রেও স্পেশালিষ্ট দেখাতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে মেডিসিন নেবারও প্রয়োজন হতে পারে।

তবে আবারও বলি, বাড়ির অন্য সদস্যরা যদি মারের অভ্যাস ত্যাগ না করে তবে আপনার বাচ্চাকে শোধরাতে চেষ্টা করে লাভ হবে না। আর আত্মরক্ষার জন্য বাচ্চা যখন মারবে সেটাতে বাধা দেবেন না। বাচ্চার অধিকার আছে নিজেকে রক্ষা করার। পড়ে পড়ে মার খেতে শেখাবেন না বাচ্চাকে।
Don’t worry that children never listen to you; worry that they are always watching you.

লেখকঃ টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী এবং আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট এক্সপার্ট, টরেন্টো, কানাডা

আরও পড়ুন