ডাঃ লুনা পারভীন
আজকাল খুব কমন একটা কথা মায়েদের বলতে শোনা যায়, ” বাচ্চা বুকের দুধ পায়না! ” ” জন্মের পর থেকেই ফর্মুলা দিতে হয়েছে “। এর কারণ কি? এর আগে কি হয় জন্মের পর, শাল দুধ কি তা বুঝি।
শালদুধের গুরুত্বঃ
জন্মের পর কি হয় আসলে? ১ম তিনদিন শাল দুধ নামের একটা কষ কষ জাতীয় পদার্থ বের হয় যা পরিমানে খুব কম হলেও ঘনত্বে অনেক বেশী ও পুষ্টি গুনে অনন্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উৎস।
এই শাল দুধ বাচ্চা যত কাঁদবে তত তৈরি হবে এবং যত ঘন ঘন বাচ্চাকে দিয়ে টানানো হবে তত তাড়াতাড়ি পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
তাহলে সমস্যা কোথায় হয়?
মায়ের সমস্যাঃ
১. মা অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে বা বেশী বয়স হলে
২. মায়ের স্বাস্থ্য রুগ্ন হলে বা অপুষ্টিতে ভুগলে
৩. মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে
৪. মা কোন দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভুগলে
৫. মায়ের মানসিক সমস্যা থাকলে
৬. মায়ের নিপল বড় বা ভেতরে ঢুকানো ( Retracted nipple) থাকলে
৭. বুকে নিপলের আশেপাশে কোন ফোঁড়া বা ফাটা ( Fissure) বা ব্যথা হলে
৮. মা প্রসব পরবর্তী জটিলতায় ( খিচুনি, রক্তক্ষরণ, জরায়ুর সমস্যা) ভুগলে।
প্রতিকারঃ
১. বাল্য বিবাহ বন্ধ করা
২. বাচ্চা নেয়ার আগে মায়ের শারিরীক ও মানসিক প্রস্ততি নেয়া
৩. মাকে বেশি করে সামর্থ্য অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো।
৪. নিয়মিত ডাক্তার দিয়ে মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ও নিপলের কোন সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা।
৫. মায়ের দীর্ঘমেয়াদি অসুখ থাকলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে বাচ্চা নেয়া ও সেভাবে প্রস্তুতি নেয়া।
৬. পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী বিশেষ করে স্বামীর কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া ও মায়ের জন্য সাপোর্ট তৈরী করা।
৭. ডেলিভারি অবশ্যই হাসপাতালে এবং সম্ভব হলে শিশুর চিকিৎসাও হয় এমন জায়গায় হওয়া।
বাচ্চার সমস্যাঃ
১. বাচ্চা সময়ের আগে হয়ে গেলে বা ওজন কম হলে বা দুটো কারণ একসাথে হলে
২. বাচ্চার জন্মগত কোন ত্রুুটি থাকলে যেমন, তালু কাটা, মুখের হা ছোট হওয়া, শরীরের কোন অংগে ত্রুটি থাকলে ( খাদ্য নালি, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড ইত্যাদি)
৩. বাচ্চার জন্মের সময় কোন সমস্যা হলে, শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে দেরি করা, খিচুনি, কালো হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
প্রতিকারঃ
মোটামুটি মায়ের পরিচর্যা ও চেকআপ ঠিকমতো হলে বাচ্চার সমস্যাও কম হয় এবং সমস্যা হলে সাথে সাথে চিকিৎসা পেলে বাচ্চা সুস্থতাও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বিকল্প কখন দিবেনঃ
১. মা মারা গিয়ে থাকলে
২. মা নিজেই শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে
৩. মায়ের কোন ঔষধ যদি বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে
৪. মা কর্মজীবী হলে ( যদিও সরকার মেটারনিটি লিভ ৬ মাস করেছেন, তবে অনেক চাকুরিতে এ সুবিধা নেই)
৫. বাচ্চার সমস্যার জন্য দীর্ঘ সময় মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকলে ( এনআইসিইউ / হাসপাতালে ভর্তি থাকলে)
৬. একদমই দুধ পাচ্ছে না বাচ্চা শত চেষ্টার পরও (???)
কারণ ছাড়া বিকল্প দিলে কি সমস্যা?
১. শুরুতেই ফিডার দিলে পরবর্তীতে বাচ্চা আর বুকের দুধ টানতে চায় না
২. মায়ের সাথে মানসিক দুরত্ব তৈরী হয়
৩. পরবর্তীতে বাড়তি খাবার খাওয়াতে সমস্যা হয়
৪. বাচ্চা শক্ত খাবার চিবিয়ে খেতে চায় না
৫. ফিডার থেকে জীবাণু সংক্রমণ হয় ও বাচ্চা ঘন ঘন অসুস্থ হয়
৬. বাড়তি খাবার খিচুড়ি খেতে ও খাওয়াতে অনীহা দেখা দেয়ায় এখানেও বিকল্প হিসেবে সুজি সেরেলাক বেছে নেয়ায়, বাচ্চা শক্ত খাবারে আরো অনীহা তৈরী হয় ও সুজি সেরেলাক সাবু ওটস বাচ্চার পেটে দীর্ঘক্ষণ হজম না হওয়ায় খিদে কমে যায় ও পায়খানা কষা হয়।
৭. বাড়তি খাবার হিসেবে গরুর দুধ পায়খানা কষা ও ক্ষেত্র বিশেষে পাতলাও করে। গরুর দুধে অনেক বাচ্চার এলার্জি বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা গরুর দুধে রক্তস্বল্পতা হওয়ার চান্স বেড়ে যায়।
যুক্তি খন্ডনঃ
এত কিছুর পরও কিছু মা যুক্তি দেখান, বাইরের দেশে সবাই এটা খাওয়ায় , বাইরের দেশে ডাক্তারই সেটা খাওয়ার পরামর্শ দেয়। যুক্তি দেখানোর আগে চিন্তা করে দেখুন তো
১. বাইরের দেশের খাবারে কি আমাদের দেশের মতো ভেজাল থাকে?
২. বাইরের দেশের আবহাওয়ায় কি আমাদের দেশের মতো জীবাণু বা দূষিত পদার্থ থাকে?
৩. বাইরের দেশের মতো কি আমাদের দেশে খাবারের মান কঠোর ভাবে পরীক্ষা করা হয়?
৪. বাইরের দেশের মতো আমাদের দেশের সব মানুষ কি ইনকাম করে?
৫. বাচ্চার লালনপালন বা চিকিৎসা করাতে বাইরের দেশের মতো কি আমাদের দেশে সরকারি অনুদান পান?
৬. আপনার সামর্থ্য আছে বলে আপনি খাওয়ালেন, যার সামর্থ্য নাই সে তখন কি মনোকষ্ট বা হীনমন্যতায় ভুগবে না যে সে বাচ্চাকে ফর্মুলা বা দামি সেরেলাক খাওয়াতে পারলো না? কাজেই সে ব্যর্থ মা?
৭. যুগের সাথে তাল মেলাতে বা ফেসবুক থেকে ভুল ধারনা নিয়ে যদি কোনো মা ভুলভাবে দুধটা বানায় ( অধিক পানিতে অল্প দুধ) তাহলে তার বাচ্চা পুষ্টির বদলে আরো অপুষ্টিতে ভুগবে। এর দায় কে নিবে?
বিকল্প দিতে বাধ্য হওয়াদের জন্য পরামর্শঃ
১. দিতেই যদি হয়, তাহলে ফিডারে না দিয়ে বাটি চামচে দিন। অন্তত ফিডার থেকে জীবাণু সংক্রমণের আশংকা কমে যাবে।
২. প্রতিবার ফর্মুলা দেয়ার আগে বুকের দুধ টানানোর চেষ্টা করবেন।
৩. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফর্মুলা বন্ধ করে বুকের দুধে ফেরত আনার চেষ্টা করবেন।
৪. ৬ মাস বয়স পূর্ণ হলে, বাচ্চাকে পুষ্টিকর খাবার দেয়ার চেষ্টা করবেন ( খিচুড়ি, ডিম কলা)। তখনও বিকল্প কিছু দেয়ার চেষ্টা করবেন না।
বুকের দুধ না পেলে কি করবেন?
১. প্রচুর পানি, তরল, দুধ ও শাকসবজি খাবেন।
২. নিজের পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করবেন।
৩. টেনশনমুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন।
৪. ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করুন।
৫. বাচ্চাকে ২ ঘন্টা পর পর শুধু মাত্র একপাশে খাওয়াবেন এরপর ২ ঘন্টা হলে অন্য পাশে। এতে একেক পাশে দুধ তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে।
৬. সবচেয়ে বড় কথা, বাচ্চাকে যথেষ্ট সময় দিবেন। মায়ের সাথে মানসিক দুরত্ব যেন না হয়।
কাজেই,
মায়ের দুধের কোন বিকল্প নাই
সাথে বাচ্চার নিশ্চিত সুস্থতা চাই।
বিঃ দ্রঃ লেখকের শিশুর যত্নে মায়ের জিজ্ঞাসা বই থেকে
লেখকঃ ডা লুনা পারভীন,শিশু বিশেষজ্ঞ,ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা।