Ads

ব্যাড প্যারেন্টিং; খারাপ অভিভাবকত্বের এই দোষগুলো আপনার মাঝে নেই তো?

নাজমুল হক

প্যারেন্টিং  কি খারাপ হয়? পৃথিবীর কোন বাবা-মা’ই কি চায় তার সন্তানের ক্ষতি হোক? দ্বিতীয় বার না ভেবেই এর উত্তর ‘না’ দেয়া যায়। তাহলে ব্যাড প্যারেন্টিং বা খারাপ অভিভাবকত্ত্ব কী? সন্তানের জন্মের পর থেকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত, তার সাথে আমাদের প্রতিটা আচরণই মূলত সন্তানকে ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, ভালোর জন্য করা আমাদের আচরণগুলোর মাঝেই লুকিয়ে আছে কিছু খারাপ প্রভাব বা খারাপ দিক। আপাত দৃষ্টিতে আমরা ভাবি আমাদের আচরণটি সন্তানের ভালোর জন্যই। কিছু আমাদের আচরণের ফলে সন্তানের উপর যেই প্রভাবটা পড়ে সেটা ভালো নাও হতে পারে। এটাই মূলত ব্যাড প্যারেন্টিং বা খারাপ অভিভাবকত্ব। যেমন ধরুন, সন্তান কোন একটা ভুল করেছে, আপনি তাকে কড়া একটা ধমক দিলেন কিংবা একটা চড় মারলেন। এতটুকু পর্যন্ত মনে হতেই পারে চড়টা বা ধমকটা সন্তানের ভুল শোধরানোর জন্য দেয়া হয়েছে। গবেষণা বলছে, সন্তানের উপর এর প্রভাবটা নেতিবাচকভাবে পড়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। কড়া ধমক বা ছোট একটা চড় দেয়ার ফলেই সন্তানের মাঝে ভয় ও আতঙ্ক বাসা বাধতে পারে। এই ভয় ও আতঙ্কের ফলে সন্তানের মাঝে নিজের ভুলগুলো লুকানোর প্রবণতা বা মিথ্যা বলার প্রবণতাও তৈরি হতে পারে। শুধু কড়া শাসন না, অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য আমাদের অতিরিক্ত নজরদারিও সন্তানের জন্য নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। ব্যাড প্যারেন্টিং এর এমন অনেক উদাহরণ নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের ব্লগ।

ওভার প্যারেন্টিং

সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত নজরদারি, সন্তান কী করবে? কীভাবে করবে? এইসব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সন্তানকে শিখিয়ে দেয়াই ওভার প্যারেন্টিং বা হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং। অনেক বাবা-মা’ই আছেন, সন্তান মোটামুটি বড় হওয়ার পরও তার স্কুল ব্যাগ নিজে বহন করে নিয়ে স্কুলে যান। নিজেই সন্তানের হোমওয়ার্ক করে দেন। সন্তানকে নিয়ে অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা করেন। সন্তান খেলতে গেলে তার সাথে মাঠে গিয়ে বসে থাকেন। আপনার এই ধরণের আচরণ ব্যাড প্যারেন্টিং এর আওতায় পড়ে। আপনি হয়তো আপনার সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে বা সন্তানের ভালোর জন্য এইসব করেন। কিন্তু আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন আপনার এমন আচরণকে সন্তানের মানসিক বিকাশের পথে বড় বাধা হিসেবেই দেখছেন। তারা বলছেন, আপনার এমন আচরণ আপনার সন্তানকে বড় হতে দিচ্ছে না, সন্তানের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে, সন্তানের নিজে থেকে শেখার ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, সন্তানের সামাজিকীকরণ উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সন্তানের যত্নতো আপনি অবশ্যই নিবেন। তবে আপনি যদি সন্তানের সঠিক মানসিক বিকাশ চান তাহলে সন্তানের বয়স ও যোগ্যতা অনুযায়ী তার কিছু কিছু কাজ তাকেই করতে দিতে হবে।

শারীরিক আঘাত

আমার শৈশব, আপনার শৈশব সবার, শৈশবেই বাবা-মা দ্বারা শারীরিক আঘাত খুবই সাধারণ একটা বিষয় ছিলো। ছোট ভুল কিংবা বড় ভুল, পড়া না পারা কিংবা পড়া বুঝতে একটু সময় নেয়া; ইত্যাদির শাস্তি হিসেবে শারীরিক আঘাতকে অনেকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। ২০১২ সালের একটা জরিপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৯৪% মানুষই সন্তানকে শারীরিক আঘাত করে থাকেন। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই অলিখিত নিয়ম ও এত মানুষের আস্থায় মনে হতেই পারে সন্তানকে শারীরিক আঘাত করা ঠিক। তাছাড়া “না মারলে সন্তান মানুষ হয় না” এমন অনেক মিথতো আমাদের দেশে প্রচলিত আছেই। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, সাইকিয়াটিরিকরা বলছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তারা শারীরিক আঘাতকে কার্যকরী উপায় বলতে চান না। তারা বলছেন, এটা সবচেয়ে সহজ উপায়। কিন্তু এটার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে রয়েছে অগণিত নেতিবাচক দিক। সন্তানের মাঝে অসামাজিক আচরণ, ভয়, আতঙ্ক, হতাশা, মিথ্যা বলার প্রবণতা, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন মনোরোগও জন্ম নিতে পারে শারীরিক আঘাতের ফলে। সন্তানকে শারীরিক আঘাত না করে বরং তার ভুলগুলো তাকে ধরিয়ে দিয়ে একটু ধৈর্য নিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলা যেতে পারে।

তুলনা করা

আমার গল্পটাই বলি। আমার মামাতো ভাই রুবেল ছিলো বেশ গোছালো, একাডেমিক পড়ালেখায়ও আমার চেয়ে ভালো। আমার আম্মা প্রায়ই তার সাথে আমার তুলনা করতেন। বলতেন-রুবেল কত ভালো ছেলে, সবকিছু কেমন গুছিয়ে রাখে, পড়ালেখায়ও ভালো। আর তুমি! একটা অপদার্থ। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, এই তুলনা আমার মোটেও ভালো লাগতো না। এবং একবার রাগে, ক্ষোভে আমি জানালার গ্রিলে ঘুষি দিয়ে হাত কেটে ফেলেছিলাম। আপনি যদি আপনার ছোটবেলাটাও মনে করার চেষ্টা করেন, দেখবেন এমন তুলনা আপনারও মোটেও ভালো লাগতো না। আর সন্তানকে কারো সাথে তুলনা করার খারাপ দিকটা উঠে এসেছে  গবেষণায়ও। গবেষণা বলছে, সন্তানকে অন্যের সাথে তুলনার ফলে সন্তান নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারায়। তাকে দিয়ে কিছু হবে না, এমন ভাবনা থেকে হতাশ হয়ে পড়ে। বাবা-মা’র সাথে দূরত্বও তৈরি হয় অনেক। কারো সাথে তুলনা নয়, বরং সব সময় সন্তানের পাশে থেকে তাকে তার সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন।

অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ

কোন বাবা-মা’ই চায় না সন্তান ব্যার্থ হোক। সবাইই সন্তানকে পারফেক্ট বানাতে চায়, সেরা বানাতে চায়। কিন্তু এই পারফেক্ট ও সেরা বানাতে গিয়ে কখনো কখনো বাবা-মার প্রত্যাশার পরিমাণটি হয়ে যায় অনেক বেশি। যার ভারটা বহন করার মতো সামর্থ্য হয়তো বা আপনার সন্তানের নাই। পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষই আলাদা। একই কাজ কারো করতে কম সময় লাগে, আবার কারো বেশি। একই পড়া কোন কোন শিশু অনেক দ্রুত শিখে ফেলে আবার কেউ কেউ শিখে একটু ধীরে। আপনার সন্তানের সামর্থ্যটা আপনাকে বুঝতে হবে। জানতে হবে তার শেখার ধরণ, তার শক্তি ও তার দুর্বলতা। আর প্রত্যাশার লেভেলটাও হতে হবে তার সামর্থ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হ্যাঁ, আপনি আপনার সন্তানের সামর্থ্য বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে পারেন, সে কেন গণিত ভালো বোঝে না, কেন তার ইংলিশে এত এত দুর্বলতা; এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও আপনি খুঁজতে পারেন। বের করতে পারেন দারুন কোন সমাধান। কিন্তু দুর্বলতা নিয়ে কাজ না করেই প্রত্যাশার চাপ আপনার সন্তানকে আরো বেশি দুর্বল ও হতাশ করে তুলবে।

ভয় দেখানো

তাড়াতাড়ি খাও, না হলে কিন্তু বাঘ আসবে; তাড়াতাড়ি না ঘুমালে ভূত এসে ঘাড় মটকে দিবে; কথা না শুনলে তোমাকে ওই ভয়ংকর লোকটার সাথে দিয়ে দিবো; এমন অনেক কথাইতো প্রতিদিন সন্তানকে বলেন। বিশেষ করে ছোট শিশুদের কোন কাজ করানোর সময় এমন ভয় অনেকেই দেখান। খালী চোখে এটা খুবই খুবই নিরীহ কোন মজা। সন্তান ভয়ে জড়োসড়ো হয়, কাজও করে ফেলে। আপনিও একটু মজা পান। কিন্তু এটার প্রভাব নিয়ে ভেবেছেন কখনো? ছোট বেলার কোন ভয় মানুষের মনে এত বিশাল প্রভাব রাখে যে, এই ভয়ের রেশ থেকে যায় অনেক দিন। অনেকে সারাজীবনেও আর এই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে না। গবেষণা বলছে, ছোট বেলার এই নিরীহ মজার কারণে পাওয়া ভয়টিও মানুষকে অনেক দিন তাড়া করে বেড়ায়। সন্তানের মানসিক বিকাশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভয় দেখিয়ে নয়, সন্তানের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করুন। স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমাতে বলুন, খেতে বলুন, পড়তে বলুন। স্বাভাবিকের চেয়ে সুন্দর কিন্তু আর কিছু হতে পারে না।

সন্তানের প্রতি আমাদের প্রতিটা আচরণইতো আসলে ভালোবাসা। কিন্তু আমাদের কিছু কিছু আচরণের ফলে যে ক্ষতিটি হয় তা হয়তো আমরা জানি না। জানলে কোন বাবা-মা’ই সেসব করতো না। আপনি যদি আগে থেকে সন্তানের সাথে এইসব আচরণ করে থাকেন, তাহলে অপরাধবোধে ভোগার দরকার নেই। প্রয়োজনে আরো জানুন, ব্যাড প্যারেন্টিং বাবা-মা হিসেবে নিজেকেও সমৃদ্ধ করুন। আপনার সন্তান বেড়ে উঠুক ভালোবাসায় ও আনন্দে।

আরও পড়ুন