Ads

শিশু প্রতিপালন পদ্ধধি

উম্মে সামিয়া আফরিন

সন্তান লালন পালন আপাত দৃষ্টিতে একটি প্রকৃতিগত বিষয় হলেও অভিভাবকদের এই ব্যাপারে জেনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত শিশুর সার্বিক ও সুন্দর বিকাশের জন্য পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী হলেও এর প্রধান প্লাটফর্ম বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল “পরিবার”।

তাই, আমাদের আজকের শিশু সন্তানকে ভবিষ্যতের একজন সত্যিকারের ভালোমানুষ বা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে পারিবারিক শাসন ব্যবস্থা বা সন্তান প্রতিপালন পদ্ধতি কেমন হলে ভালো হয় তা আমাদের সবার জানা জরুরী।

Psychologist Diana Baumrind’s research অনুযায়ী সাধারাণভাবে শিশু প্রতিপালন ব্যবস্থা বা parenting style কে তিনি ৪ ভাগে ভাগ করেছেন এগুলো হলোঃ

1.Authoritarian or extremely strict

2.Authoritative or moderate

3.Permissive or indulgent

4. Uninvolved parents

নিম্নে এই চার ধরণের পরিবারের সন্তান প্রতিপালন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

1. Authoritarian or extremely strict Parenting style:
এ ধরনের পারিবারিক শাসন ব্যবস্থায় পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সাথে সাধারণত অনেক বেশি কঠোর হয়ে থাকেন । তারা শিশুদের উপর সবকিছু চাপিয়ে দেন এবং কঠোর ভাবে নিয়ম কানুনও ঠিক করে দেন কিভাবে তার সন্তানরা চলবে ফিরবে, কিভাবে পড়াশুনা করবে, এমন সব কিছু। এই শাসন ব্যবস্থায় পরিবারের পিতামাতারা কোন কিছু ঠিক করার আগে তাদের সন্তান দের সাথে আলোচনা করেন না , প্রত্যাশা করেন সন্তান কোন মতেই তাদের মতের বাইরে যেতেই পারবেনা , বিনা বাক্যে সব মেনে নিবে। তারা ভাবেন যে তারা তো তাদের সন্তানের ভালই চান, ভালোবাসেন ,তাই তাদের সন্তান তাদের সম্মানেই তাদের মতো করে চলবে।
এই ধরনের পরিবারের সন্তান এবং পিতামাতার মাঝে মানসিক যোগাযোগ কম থাকে । তারা নিজ থেকে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, তার বাবা/মা-ই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। Authoritarian পরিবারের সন্তানরা তাই পরবর্তীতে আত্মনির্ভরশীল হতে বাঁধা প্রাপ্ত হয়, স্কুল পারফরম্যান্স অনেক ভালো আর অনেক ভালো গ্রেড পায়, আর কোন কারণে রেজাল্ট কিছুটা খারাপ হলে অনেক হতাশায় ভোগে। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন maturity, , self-control, curiosity, friendliness , social interaction এই skill গুলোর ক্ষেত্রে তাদের সঠিক development হয় না। এই ধরণের পরিবারের সন্তানের Self esteem কম বা মোটামুটি ধরণের হয়।

2. Authoritative, or moderate Parenting style:
এ ধরনের পরিবার প্রতিপালন ব্যবস্থায় বাবা-মা রা শিশুদের বেড়ে ওঠার উপর কঠোরভাবে নিয়ম চাপিয়ে দেন না,আবার খুব বেশি সীমাবদ্ধতাও রাখেন না । তারা সবসময় তাদের সন্তানকে উষ্ণ ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে চেষ্টা করেন । নিয়ম কানুন সন্তানকে মানানোর আগে তাদের বুঝিয়ে দেন কেন তাদের সেগুলো মানা উচিত । তারা তাদের শিশুদের সিদ্ধান্ত গ্রহন ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ ও সুযোগ করে দেন । সন্তান ভুল করে ফেললে সেই ভুল থেকে কিভাবে শিক্ষা নিয়ে আবার সামনে এগিয়ে চলতে হয় সেই ব্যাপারেও বুঝিয়ে বলেন । কিছু বিষয়ে সন্তানদের সাথে তাদের দ্বিমত থাকলেও সন্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে তা বিচার করার চেষ্টা করেন । এসব সন্তানের স্কুলের পারফরম্যান্স সাধারণত অনেক ভালো বা মোটামুটি ভালো দু’ধরণেরই হতে পারে। খুব ভালো গ্রেড না পেলেও এরা খুব বেশি হতাশাতেও ভোগে না। এই ধরণের পরিবারের সন্তানদের self esteem অনেক ভালো হয়ে থাকে৷

3. Permissive, or indulgent parenting style :
এ ধরণের পরিবারের বাবা মা-এরা সন্তানকে অনেকটা অন্ধভাবে ভালবাসেন, সন্তানের সব কিছু accept করেন এবং সন্তানের উপর তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ ই রাখেন না। তারা তাদের সন্তানকে তার নিজের নিয়ম নীতি মোতাবেক চলতে বাঁধা দেন না এমনকি সন্তান যখন যা চায় তাই মেনে নেন।
এদের স্কুলের পারফরম্যান্স ভালো, মোটামুটি বা অনেক সময় খুব খারাপও হতে পারে। এসব সন্তানেরা সাধারণত তাদের স্কুলের রেজাল্ট নিয়ে খুব সিরিয়াস থাকে না। সাধারণত এদের Self esteem ও কম থাকে,কেননা Authoritarian বা Authoritative পরিবারের মত সন্তানের উপর অভিভাবকদের কোন আচরণগত demands থাকে না । এই ধরনের পরিবারের সন্তানের প্রচুর স্বাধীনতা বিদ্যমান ।

4. Uninvolved Parents:
Uninvolved পরিবারে , পিতামাতারা সন্তানের চেয়ে নিজেদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন । তারা হয়তো সন্তানের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করেন কিন্তু সন্তানের সাথে তেমন interaction অর্থাৎ মানসিক যোগাযোগ থাকে না বিধায় সন্তান মানসিকভাবে অনেক অবহেলার সাথে নিজের ইচ্ছেমত করে বড় হয় । এধরণের পরিবারের সন্তানদের স্কুল পারফরম্যান্স সাধারণত অনেক খারাপ হলেও কখনো কখনো কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে অনেক ভালো রেজাল্ট করে থাকলেও বেশিরভাগ সন্তানদেরই পড়ালেখা থেকে শুরু করে যাবতীয় কোন কিছুর প্রতিই তেমন আগ্রহ থাকেনা। নিজের ব্যাপারে সারাক্ষণ হীনমন্যতায় ভোগার কারণে এদের Self esteem ও খুব নিম্নমানের হতে পারে।

মূলত, বাইরের দেশের গবেষণায় উপরোক্ত ৪ ধরনের পরিবার দেখা যায় । আর এই তত্ত্বের আলোকে সবার শিশু প্রতিপালনের ধরণের পার্থক্যের কারণে প্যারেন্টিং এর ফলাফল যে গবেষণার মতোই একই রকমভাবে ঘটবে তা নয়, তবে সাধরণভাবে কম-বেশি সেরকমই হওয়ার চান্স বেশি থাকে।

যাইহোক আমাদের দেশে তেমন কোন গবেষণা না হলেও বুঝে হোক কিংবা না বুঝে , আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটা সন্তানই অনেকটা উপরে পারিবারিক শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই বড় হচ্ছে। যাইহোক, আমরা বুঝতে পারছি যে, শিশুর প্রথম এবং প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার পরিবার এবং বিভিন্ন ধরনের Domain based development গুলোও অনেকাংশে এই পারিবারিক শাসন ব্যাবস্থার উপরই নির্ভরশীল তাই আমাদের উচিৎ এখন থেকে বুঝে শুনেই সঠিক পারিবারিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ।
আর শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা জিনিস খুব জরুরী, পরিবারে শাসনটা যেন একরকম-ভাবে পরিচালিত হয় অর্থাৎ বাবা মা, কিংবা দাদা- দাদি নানা -নানি যারা সন্তানকে দেখাশুনা বা পরিচালনা করছেন তাদের সবার মতামতে, শাসনে ( minimum) মিল থাকতে হবে। তা না হলে সন্তান confused হতে পারে আর শাসনের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে নিতে শিখবে, যেটা কোন ভাবেই উচিৎ নয় । কেননা পারিবারিক শাসন ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করছে আমাদের শিশুর সবধরনের বিকাশের সাথে সাথে maturity, school performance, self-esteem, self-control, curiosity, social responsibilities নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও।

মূলকথা, আমাদের আজকের সন্তানকে যদি আমরা সঠিক মূল্যবোধে এবং সঠিক শাসন ব্যবস্থায় ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি তাহলে আশা করা যায়, হয়তো আগামী দিনের পরিবারিক বন্ধন তথা আমাদের দেশ ও জাতি নিয়েও ভবিষ্যতে এত উদ্বিগ্ন হতে হবে না ইন শা আল্লাহ্ ! আর পরিশেষে, অভিভাবক হিসেবে আমাদের এটাও মাথায় রাখা জরুরী যে,

“শাসন করা তাকেই মানায় যে সোহাগ করতে জানে।”

লেখক:উম্মেসামিয়া আফরিন
(M.Ed, Department of Educational Psychology & Guidance, DU)

আরও পড়ুন