Ads

সন্তানকে যেভাবে মানবসম্পদে পরিণত করা যায়

মনিরা ইসলাম 

আমি চেষ্টা করেছি ব‌ই থেকে পড়া কথা অথবা ক্লাস লেকচার/ সেমিনার এ পাওয়া সিদ্ধান্ত গুলো আমার বক্তব্য থেকে পরিষ্কার করতে।সেসবের ভাষা যেহেতু বাংলা অথবা ইংলিশ না ।তাই কোনো রেফারেন্স দেয়ার উপায় থাকে না।তবে অভিজ্ঞতার সমর্থন শেখানে থাকে কারণ আমার পেশা শিশু প্রতিপালন ও পরিচর্যা।

আজকে আমি জীবন যাপন থেকে পাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে লিখব মনে করেছি।ডান ডান ডান,হেই হট হট, সপাং( লাঠির বাড়ি) বাম বাম বাম।এই ভাষায় শিশু কালে রাখালকে গরু চড়াতে দেখেছি।আমার জীবনে একবার দেখা গ্রামটির বিশাল সৌন্দর্য্যের এ আরেক দিক।রাখাল সভ্য জীবন যাপনের ধারণা নিয়ে চলে না। অভিধান অনুযায়ী গরু বোবা/ ইতর প্রাণী।গরুকে এতটা কঠিন বেত্রাঘাত করা ছাড়া বাংলাদেশী রাখালের ভাবনাতে অন্যকিছু আসবে না।তাই সে সেটাই করবে এটা স্বাভাবিক।সে জানে গরুকে এভাবে না বললে গরু চলবে না, বুঝবে না।

বাচ্চাদের অনেক সময় ঠিক এভাবে না হলেও অনেকটাই এভাবে -এটা কর ওটা করতে হবে বলে প্রতিপালন করা হয়।
লিখতে চাচ্ছি, এমন ব্যবহার দুঃখজনক।কারণ গরু আর শিশুর বিস্তর ফারাক। রাখাল জানে গরুকে মেরে পথে নিতে হবে।রাখালের সুযোগ-সুবিধা সীমাবদ্ধ তাই তার জ্ঞান সীমাবদ্ধ।তার কাছে সহানুভূতিশীল আচরণ কি সেটাই হয়ত অজানা। শিশু গরু না, মানুষ।সে বুদ্ধিমান প্রাণী।তাকে বুদ্ধিমান হবার এবং বুদ্ধি চর্চার সুযোগ দিতে হবে। সহজ এবং সঠিক আয়োজন থেকে তার প্রতিপালন ব্যবস্হা নিরাপদ হতে হবে।

সারাক্ষণ বাচ্চার মাথায় তর্জণী তুলে কথা বলে ডান বাম চালাবার চেষ্টার নাম হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং।এ জাতীয় মৌখিক চাপ থেকে শিশু কে ডিক্টেটর এবং শ্রদ্ধাবোধ কম হতে দেখেছি।কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশু অত্যন্ত শিশু বয়সে হতাশ হয়ে যায়। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারায়।” জানি তো,করতে দিবা না” এ জাতীয় মন্তব্য থেকে শিশুর মনের হতাশা / ভরসাহীনতা অনুভব করা যায়।আমরা যেখানে শিশুর ভরসার কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য সেখানে ভরসা হারানো শিশু পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে চলে যায় পরিবারের বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এর সবটাই ” না” শব্দ থেকে উদ্ভূত মনে হয় কি? আমি প্রায়ই ইনবক্সে ঘটনা জানতে পারি। বিভিন্ন মা আমাকে ” কি করতে হবে What to do” প্রশ্ন করেন। উনাদের সাথে কথা বলে বুঝা যায় সাহায্য কখন চাইতে হবে এ বিষয়ে উনাদের সঠিক ধারণা কম। শিশু যখন ছোট থাকে তখন ভুল দেখলে বড় হলে সংশোধন হয়ে যাবে সেই আশায় থাকেন।আর বড় হলে জটিল হয়ে গেলে ইনবক্স করেন।

আসলে মা বাবাও মাঝে মাঝে বেচারা হয়ে যান।সব কিছুর ব্যাতিক্রম আছে। নিজেকে বেচারা হ‌ওয়া থেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করা মা বাবাও আমার কাছে এসেছেন।যিনি স্পষ্ট করে বলেছেন সমস্যা তো আমার।আমি কিছু জানি না।আমার কাউন্সিলিং লাগবে।ও(বাচ্চা) তো ভালো।সত্যি সত্যি একথাই ঠিক।যা ছয় এ হয় না তা ষাট এ হবে না।

আমার বাচ্চা যখন বয়স আঠারো হলো তার জন্মদিন মানে
আমার কাছে বিশাল কিছু।তবে বয়স দশ হবার পর আমি জন্মদিন পালন না করা মুসলিম হিসাবে আদেশ পালনের নির্দেশ দেই।সাথে বিস্তারিত বলে দেই যে আসলে এটা কোনোদিনই করার অনুমতি ছিল না।প্রবাসী কালচার থেকে আবার আঠারো বছর পালন করে উৎসব করতে হয়।

আঠারোর জন্মদিনে আমি তাকে বলেছিলাম,”এখন থেকে তুমি জীবন যাপন করবে।আমি দেখব।আমি সমস্যা বলব তুমি সমাধান করবে”। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল।সাথে সাথে আমি বুঝিয়ে বলেছি এর মানে তো আমি কোথাও চলে যাইনি।আমি এটা দেখতে চাই কারণ আমি মারা গেলে তুমি ভালো থাকবে সেই ভরসার আনন্দ আমি পেতে চাই।

সদ্য শৈশব পেরোনো সন্তানকে চোখে চোখ রেখে যা বলেছিলাম তা হলো: ” যে কোনো রকম মিথ্যা থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহ পাকের পরে মা এবং বাবাকে শ্রদ্ধা করবে। ছোটদের স্নেহ করবে। তোমার সংস্পর্শে যে আসবে তার সাথে তোমার সম্পর্ক বিচার করে তার প্রতি তোমার কর্তব্যে অটল থাকবে। Make sure তুমি কষ্ট পাবে না,কাউকে কষ্ট দিবে না। তোমার জন্মদিন বার বার এসে তোমাকে উন্নত মানসিকতা দিয়ে যাবে এই আমার ঐকান্তিক শুভেচ্ছা”। আমার বিশ্বাস আমি তাকে যেভাবে বড় করেছি কিছু টাকা অথবা একটা নতুন গাড়ির চেয়ে এই কথা তার কাছে মূল্যবান ছিল।

আমাদের কর্তব্য সন্তানকে সেভাবে গড়ে তোলা যেন সে সমাজের যোগ্য এবং উপযুক্ত হয়ে জীবন কাটাতে পারে। ইন্টারনেটের কল্যাণ অকল্যাণ যেটাই বলি না কেন মানুষ এখন বৈশ্বিক নাগরিক।এই নাগরিকত্ব বজায় রাখার জন্য তার পারফরমেন্স সুন্দর না হলে সে তো পদে পদে বিপদে থাকবে।আমরা তেমন চাই না।
শিশু কে জীবন যাপন শেখানো হবে সেই পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য।মানুষ নামে মানব সম্পদ হবার জন্য।
দুনিয়ার উপরে এবং নীচে সুখী হবার জন্য।এটাই আমার সিদ্ধান্ত।পাঠকদের সবাইকে ধন্যবাদ।

লেখকঃ জার্মান প্রবাসী লেখিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী, প্রাক্তন শরীরচর্চা প্রশিক্ষক ও
শিশু প্রতিপালন বিশেষজ্ঞ ( প্যাডাগগ)

আরও পড়ুন