আখতার হোসেন
সন্তানদের জীবন গড়ার জন্য কানাডায় এসেছেন নাকি মনের অজান্তেই তাদের জীবনটা ধ্বংস করার জন্য এসেছেন সেটা কি আরেকবার ভাবার সময় এখনো আসেনি??
সন্তানদেরকে লালন-পালন করতে গিয়ে কে কী করছেন সেটা যার যার বিষয় কিন্তু যা এখন করা দরকার তা হচ্ছে–
১। নিজেকে তাদের সামনে বড় করে তুলবেন না। তাকে অনুভব করতে শেখান যে, তারা আপনার চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে—আপনাকে ছাড়িয়ে গেছে।
২। এক সাথে বসে অন্ততঃ রাতের খাবারটা খান। সারাদিনের সবকিছু শেয়ার করুন। দৈনিক আপডেট থাকবেন।
৩। মাছ ধরতে নিয়ে যান। বাগান করতে নিয়ে যান। লাইব্রেরীতে নিয়ে যান। পালা করে বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান। তাদের মাঝে থাকুন।
৪। তারা যে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠছে সেটা তাদেরকে অনুভব করতে দিন। আদেশের ক্ষেত্রে নম্রতা বজায় রাখুন। তারা যে আচরণ পাবে সে আচরণই করবে।
৫। ধর্মগ্রন্থের দু’চারটা লাইন যা তাদের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো নিয়ে দৈনিক আলাপ করুন। নিজে মানুন, জানুন আর তাদেরকে মানতে আর জানতে দিন।
৬। কাজ, কথা আর ব্যবহারে নিজে সততার অনুশীলন করে তাদেরকে সেভাবে গড়ে তুলুন। আপনাকে দেখেই তারা শিখবে।
৭। নম্বর কম পেলেও হাইফাইভ দিতে ভুলবেন না। বলবেন, তুমি তো ৭০% নম্বর পেয়েছো, আর আমি কোনমতে ৬০% পেয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। তুমি পারবে, আরো পারবে। কেবল আরেকটু বেশী সময় দাও, আর আরেকটু বেশী পরিশ্রম করো। সব তোমার নাগালে চলে আসবে।
৮। তাদেরকে সামনে রেখে তাদের মায়েদের সাথে ঝগড়া করবেন না। আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করছেন—জিতে যাচ্ছেন কিন্তু তাদের মা অপমানিত হচ্ছে। কোনো সন্তানই মায়ের অপমান সহ্য করতে পারে না। তারা দূরে চলে যাবে—দূরত্ব বেড়ে যাবে। এক সময় দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে—নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কখন যে হারিয়ে যাবে তা টেরই পাবেন না।
৯। সন্তান দু’জনেরই। সমানে সমান। দায়-কর্তব্য সমান। নিজের দায়টা পালন করে অন্যেরটাও পালন করুন। তারা যেন অবহেলিত না থাকে। নিজেদেরকে তারা যেন পরিত্যক্ত মনে না করে।
১০। তাদের বারবার বলেন যে, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি আর তুমি তো সঠিক পথেই আছো। চিন্তা করো না। আমি সব সময় তোমার পাশেই আছি।
১১। আপনি যে তাদেরকে ভেতরে ভেতরে কতোটা ভালোবাসেন সেটা তাদেরকে অনুভব করতে দিন। তাদেরকে বুঝতে দিন যে, তাদেরকে আপনি ভালবাসেন কিন্তু তাদেরকে সেটা বুঝতে দিতে চান না।
১২। সব সময় উৎসাহ দিন। বারবার বলুন, তুমি অবশ্যই পারবে, ভালো করেই পারবে। কেবল সংহত হয়ে এগিয়ে যাও।
১৩। ব্যর্থ হলে বকাঝকা করবেন না। বলুন, হাল ছেড়ে দিও না। সফলতা তোমার খুব কাছেই। আমার জীবনে এমন অনেকবার হয়েছে। আমি অনেক বার ফেল মেরেছি আবার আমি একাই উত্তীর্ণ হয়েছি। তুমিও পারবে। কারণ, তুমি একা নও, আমিও তোমার সাথে আছি। সব সময়—যেকোনো মূল্যে।
১৪। তাদেরকে বলুন যে, আমি ভুল করতে করতে শিখেছি। সবাই শিখতে শিখতেই বিখ্যাত হয়। তুমি ভুল করলে আমি তোমাকে মন্দ বলবো না। তবে, তুমি অবশ্যই ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।
১৫। তাদেরকে বলুন যে, তুমি নিরাপদে আছো, নিরাপদ শহরে আছো, নিরাপদ পরিবারে আছো। আমরা সবাই তোমাকে পছন্দ করি। আমি তো তোমাকে নিয়েও গর্ব করি।
১৬। তারা বাব-মার নিকট থেকে বেশী কথা পছন্দ করে না। তাই, কথা কম বলুন কিন্তু যা বলবেন তা যেন কাজে লাগে।
১৭। সংসারটা নাঙ্গলের জোয়ালের মতো। সমানভাবে দূ’জনেরই কাঁধে থাকবে। মিলেমিশে চাষ-আবাদ করুন। একে অপরকে সাহায্য করুন।
১৮। তাদেরকে বলুন যে, আমি তোমার খুব কাছের মানুষ—কাছের বন্ধু। তোমার মা তোমার সবচাইতে ভালো বন্ধু—তবে আমি ও কম না।
১৯। তাদেরকে যে আপনি বুঝতে পারেন সেটা তাদেরকে বুঝতে দিন। তাদের কথা মন দিয়ে শুনুন। তাদের কথার মাঝে কথা বলবেন না। বুঝতে চেষ্টা করুন তারা কী বলতে চায়—কী করতে চায়। গরম হওয়া যাবে না। বেশি নরমও হতে যাবেন না।
২০। তাদেরকে বলুন যে, তোমার কাজগুলো আমি দেখি আর ভাবি যে, তুমি কতোটা নিখুঁৎভাবে চর্চা করো।আমি জানি যে, তোমাকে দিয়ে সবই সম্ভব। কারণ, আমি সেটা তোমার মাঝে দেখেছি। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কাজগুলো করো। দেখবে তোমার ক্ষমতা কতো!!
২১। তাদেরকে বলুন যে, আমি গোপনে গোপনে তোমার অনেক কাজ দেখেছি। আমার অটল বিশ্বাস এই যে, তুমি পারবে না এমন কোন কাজ নেই। এরই মধ্যে তুমি তা প্রমাণও করেছো।
২২। নিজে হেরে যাবেন। স্ত্রী বা সন্তানেরা জিতে গেলেও কাপটা তো আপনার ঘরেই থাকলো। সংসারটা খেলার প্রতিযোগীতা নয়—শান্তিতে বসবাসের জায়গা। শান্তিতে রাখুন—শান্তিতে থাকুন।
২৩। আপনার সন্তান আপনার চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখে সেটা যে আপনি জানেন সেটা তাদেরকে বুঝতে দিন। নিজেকে বেশী জাহির করেছেন কি মরেছেন।
২৪। সম্ভব হলে বেবীসিটার না রেখে সন্তানদেরকে নিজেরা লালন-পালন করুন। কারণ, CHILDERN COMFORT আর PARENTAL COMFORT এই দু’টো উপাদান উভয়ের জন্য খুবই জরুরী একটি উপাদান যা বাইরের মানুষের কাছে থাকে না।
২৫। সন্তানকে যা বলার নিজে বলুন। অন্যকে দিয়ে বলাবেন না। আসুক তোর বাবা, সব বলে দেবো। এমন কথা এড়িয়ে যান—ভুলেও বলবে না। এতে আপনি নিজের সন্তানকে নষ্ট করলেন আর বাপকে অন্যায়ভাবে ভিলেন বানালেন।
শেষ কথা,
যদি দেখেন যে, আপনার ভাষা আর আপনার সন্তানের ভাষা এক থাকছে না তবে মনে রাখবেন যে, আপনার সন্তান আপনার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে—হারিয়ে যাচ্ছে।
যদি দেখেন যে, আপনার ধর্ম আর আপনার সন্তানের ধর্ম এক থাকছে না তবে মনে রাখবেন যে, আপনার সন্তান আপনার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে—হারিয়ে যাচ্ছে।
যদি দেখেন যে, আপনার মূল্যবোধ আর আপনার সন্তানের মূল্যবোধ এক থাকছে না তবে মনে রাখবেন যে, আপনার সন্তান আপনার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে—হারিয়ে যাচ্ছে।
আরো মনে রাখবেন,
সন্তান মরে যাওয়ার বেদনার চাইতে সন্তান হারিয়ে যাওয়ার বেদনা অনেক বেশী কঠিন—অনেক বেশী মর্মান্তিক।
সহ্য করা যায় না।
লেখকঃ প্রকৃতি প্রেমী ও কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী