Ads

স্মার্ট ফোনের যুগে শিশুর বই পড়ার অভ্যাস গড়বেন যেভাবে

ফারজানা মাহবুবা

সপ্তাহখানেক আগে একটা দাওয়াতে যে রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম,একজন আপু এসে বললেন, ‘আপু, মাশাআল্লাহ! আপনার মেয়েতো বেশ পড়ুয়া! সব বাচ্চারা খেলা করতে করতে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছে। আপনার মেয়ে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো গল্পের বই আছে কিনা!’ আমার মাথার উপর ঠাডা পড়লেও মনে হয় আমি এত অবাক হতাম না!হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার মেয়ে??’ উনি উলটা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করে মেয়েকে পড়ুয়া বানিয়েছেন?’

রীতিমত ঢোঁক গিললাম বড় বড় দুইটা!আমার মেয়ে?? পড়ুয়া?! সে আসলেই বই নিয়ে বসেছে এই হট্টগোলের ভিতর?! মানুষের মাথা একটা সেইরকম চীজ। সেকেন্ডের ভিতর আমার মাথার ভিতর অনেকগুলো চিন্তা একসাথে খেলতে লাগলো।

এক-
মেয়ে যদি সত্যি বই না পড়তো তাহলে তো আর আপু বলতো না! কিন্তু আমি কেনো বিশ্বাস করতে পারছিনা?! বাবা-মা’রা কী কোনো সাইকোলজিক্যাল কারনে অবচেতন মনে নিজের সন্তান সম্পর্কে সবসময় লো-ধারনা পোষন করেন? ঠিক যেমন আমি যাইই করতাম না কেনো, সবসময় আম্মুর কমেন্টের ধাঁচ ছিলো এমন যেন আম্মুর কথা শুনলে আমি আরো ভাল করতে পারতাম!

দুই-
অন্যের মুখে সন্তানের সামান্য কোনো পজিটিভ প্রশংসাও বাপ মা’র বুকে কীভাবে যেন অন্যরকম একটা হ্যাপী ফিলিংস এনে দেয়! এই ফীলিংসটাই কী আস্তে আস্তে একসময় গিয়ে কম্পিটিশান-এ পরিনত হয়? বাবা-মা’রা কি আস্তে আস্তে এই ফীলিংস-টার নেশায় পড়ে যান? তখন নিজের সন্তানকে সবার চোখে ভাল বা বেষ্ট বানাতে উঠে পড়ে লাগেন?
(আল্লাহ’র কাছে আশ্রয় চাই এমনটা হলে।)

যা হোক, ফেইসবুকে কয়েকটা বই পড়ার ছবি দেখেও অনেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মেয়েকে কীভাবে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করলেন? মেয়ে আসলে বইয়ের প্রতি কতটুকু আগ্রহী তা নিয়ে আমি এখনো সন্দিহান, তারপরওঅনেক বাবা-মা-ই আছেন যারা খুব চান বাচ্চার সাথে বইয়ের কানেকশান বিল্ডাপ করতে, কিন্তু বুঝতে পারছেন না কী করবেন, তাদের সাথে নিজের স্ট্রাটেজীটুকু শেয়ার করার জন্য এই স্ট্যাটাস। কারন প্রযুক্তিগতভাবে এবং অন্যান্য দিক দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যতই এগিয়ে যাক না কেনো, আমার ব্যক্তিগত ধারনা, যে বা যারা তখনো প্রচুর বই পড়বে, যাদের কনস্ট্যান্ট একটা হাংগার থাকবে জানার জন্য, পড়ার জন্য, কিছু না পড়লে মাথা আউলা ঝাউলা লাগবে
তারাই সবসময় আলোকিত মানুষ হবে। নিজের ভিতরে আলো জ্বালাতে, প্লাস আশেপাশের মানুষকে আলো দেখাতে।

তাছাড়া বই পড়ার প্রতি আমার এত বেশী চাপ দেয়ার অন্যতম আরেকটা কারণ হলো, জীব্রাঈল আঃ রাসূল সঃ এর কাছে এসে প্রথম শব্দই বলেছিলেন ‘ইক্বরা!’ তিনবার বলেছিলেন শব্দটা। ‘ইক্বরা!’, মানে ‘পড়ো!’

ভেবে দেখুন, আল্লাহ শেষ নবীকে দিয়ে মানূষকে যে ফাইনাল গাইডেন্স পাঠিয়েছেন তার একদম, একদম, একদম শুরুতেই তিনবার বলেছেন, ‘পড়ো!’ অতএব, আমার কথা একটাই, আর কিছু করো না করো, প্লীজ পড়ো! যা পাও তাইই পড়ে ফেলো! রাস্তায় কুঁড়িয়ে পাওয়া কাগজ থেকে শুরু করে, ডিকশনারী থেকে শুরু করে, গল্পের বই থেকে শুরু করে, পেপার থেকে শুরু করে, যা হাতের নাগালে আসবে, সব পড়ে ফেলো!

কিন্তু আমার এই পড়ার আকুতি আমার মেয়ের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়! শেষে অনেক অনেক অনেকদিন ভেবে বের করতে চেষ্টা করেছি,এর কারণ কী? এতভাবে বলি, এতরকম করে তাকে বইয়ের দিকে টানি, তারপরও মেয়ের মধ্যে বই পড়ার কোনো আগ্রহ দেখি না কেনো? ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছি।

প্রথম কারণ

আমি নিজে এখন আর না পড়া! এর আগেও অনেকবার বলেছি, বাচ্চারা কান দিয়ে শুনে শিখে না, চোখ দিয়ে দেখে শিখে। হ্যা, বাসায় বইয়ের বিশাল সংগ্রহ নিয়ে মেয়ে বেশ গর্ববোধ করে, বুঝি।কিন্তু মেয়ে তো আর মা-কে বই পড়তে দেখে না! নিজের হাসি’র মত বই পড়ার অভ্যাসটাও কীভাবে যেন কোথায় হারিয়ে গেছে! এর মধ্যেও যে একদম পড়ি না, তা না। কিন্তু খুব টুক টাক।আগের মত সর্বভূখ হাভাতে পড়ুয়া টাইপ টা আর নেই আমি।

আমি নিজে পড়া শিখেছি আম্মু, আব্বু আর বড় ভাইয়াকে দেখে।আম্মুর কোনো স্বর্ণ গয়নাগাটি শাড়ী এসব ছিলো না। আম্মুর ছিলো বই। অজস্র বই। হাজারে হাজারে বই। খাটের তলে বস্তায় বস্তায় বই। এমনকি জানালার পর্দার কার্নিশের উপরেও বই! আব্বুকে দেখেছি দুপুরে খাওয়ার পরে এক ছটাক যে ভাত ঘুম দিতেন তার আগে বই বা পেপার নিয়ে বসতেন। বড়ভাইয়াকে দেখেছি একহাতে ভাত খায় আরেকহাতে বইয়ের পাতা উল্টায়। ওর বই চুরি করে করে পড়ে আমি পড়ুয়া হয়েছি বলা যায়!

কিন্তু আমার মেয়েরা কাকে দেখে শিখবে? কাকে দেখে বুঝবে বই পড়ার নেশা আসলে কাকে বলে?! মেয়ের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হলে, মেয়েকে দেখাতে হবে মা- নিজে খেয়ে না খেয়ে শুধু পড়ে! ঠিক যেমন আম্মুকে দেখতাম পড়তে।

আমার আম্মুই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র আম্মু যে কিনা বাস্তবেই পড়তে না পারলে হাউ মাউ করে কাঁদতো!কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর চোখের পানি নাকের নোলক বেয়ে বেয়ে পড়তো!
আর কাঁদতে কাঁদতে আম্মু খালি বলতো, “আমাকে জেলে নেয় না ক্যান, আমাকে জেলে নিলে তো একটু পড়ার সুযোগ পাইতাম! বিভিন্ন স্বনামধন্য মওলানা, সাইয়্যেদ কুতুবসহ সবাই জেলে গিয়েই তাফসীর লিখছে! তোদের জন্য আমি একটা লাইন পড়তে পারি না! আজকে আমি জেলে থাকলে, আমিও তো একটু পড়তে পারতাম!” আপনাদের কাছে শুনতে অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু এইইই আমার মা! যে পড়ালেখা করার সুযোগ না পেয়ে জেলে যেতে চাইতো যেন জেলখানায় গিয়ে নির্বিঘ্নে একটু পড়ালেখা করতে পারে!!

দ্বিতীয় কারণ 

লাইব্রেরীতে রেগুলার না নেয়া।অনেকবার শিডিউলে ঢুকিয়েও মেয়েদেরকে নিয়ে লাইব্রেরীতে যাওয়ার

রেগুলারিটিটা মেনটেইন করতে পারি না।কিন্তু খেয়াল করে দেখেছি, যখনই লাইব্রেরীতে একটু বেশী নিয়ে যাই,ওখানে লাইব্রেরীর ভিতর খেলাধুলা দৌঁড়াদৌঁড়ি করলেও, ঠিকই দুই মেয়ে একজন আরেকজনের সাথে প্রতিযোগীতা দেয়, কে কয়টা বই পড়ে ফেলেছে!
ছোটটা তো আর পড়তে পারে না, পৃষ্টা উলটানো মানেই ওর পড়ে ফেলা!মাঝখানে কয়েক সপ্তাহ রেগুলার লাইব্ররীতে নেয়ার পর, এক সপ্তাহে আবার বাদ পড়ায় সে সপ্তাহে সারা সপ্তাহ ছোটু জ্বালিয়েছে ‘মা তুমি পঁচা মা! তুমি লাইবলি তে নিচ্ছো না!’সেই অভিযোগ যতবার শুনেছি, ততবার কী যে খুশী লেগেছে!যাক, ছোটটা এখনই লাইব্রেরী পছন্দ করে!

তবে লাইব্রেরীতে নিলেই শুধু হয় না,লাইব্রেরীতে নিয়ে আমি যদি নিজে ল্যাপটপে বা মোবাইলে কাজ করি, তখন খেয়াল করেছি ওরা কেমন যেন অস্থির হয়ে থাকে!পড়ার চেয়ে বা খেলার চেয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে বেশী।
বুঝেছি, লাইব্রেরীতে গিয়ে আমাকেও পড়তে হবে ওদের সাথে।এখন যখন ওদের সাথে গিয়ে আমিও পড়ি, হয়তো লাইব্রেরীতে কিডসদের সেকশানে ফ্লোরে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে পড়ছি, ছোটু আর বড্ডা আমার পিঠের উপর মাথা রেখে তারাও তখন ফ্লোরের উপর শুয়ে শুয়ে বই পড়ে!

মাতৃত্বের এই এক জ্বালা,সারাক্ষণ বাচ্চাদেরকে করে দেখাতে হবে আপনাকে।আদারওয়াইজ যতই ওয়াজ নসিহত চিৎকার চেঁচামেচি করেন, এক ফোঁটা লাভ নাইক্কা!ওদের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে সাঁইইইইইইই করে বেরিয়ে যাবে!

তৃতীয় কারণ 

কারণ ওরা বাচ্চা!!অনেকেই ভাবেন বাচ্চারা বড়দের মত ঠাস করে পড়ুয়া বনে যাবে!আরে বাচ্চারা কী জানে নাকি বইয়ের ভিতরে কী মজা?তাকে তো আগে আস্তে আস্তে পড়ানোর অভ্যাস করাতে হবে, তারপরেই না সে বুঝবে বইয়ের মজা কী!আর বাচ্চাদেরকে যে কোনো কিছু অভ্যাস করানোর সবচে’ ইফেক্টিভ ওয়ে হলো তাদেরকে রিওয়ার্ডস দেয়া।
সোজা বাংলায় ঘুষ দেয়া।না, ঘুষ দেয়া খারাপ শোনায়। নেগেটীভ ব্যাপার।তার চেয়ে বলেন, পুরষ্কার দেয়া।
তো আমি আর মেয়েদের বাবার মধ্যে এখানে পার্থক্য আছে। মেয়েদের বাবা মেয়েদেরকে কথায় কথায় পুরষ্কার দেয়!
বাপগুলা মোষ্ট প্রোবাবলি এইরকমই হয়।

মেয়েগুলা একটু গলে পড়ে নরম করে বাবা ডাক দিলেই পুরা কাইত!এই কাইত মানুষটাকে দিয়ে তখন দুই মেয়ে যা ইচ্ছা তা কিনিয়ে নেয়।এ ক্ষেত্রে আমি আয়রন লেডী।
খুব কম পুরষ্কার দেই। তো এই কারণেই হয়তো আমার কাছ থেকে কিছু আদায় করে নিতে পারলে বড়টা বিশাল একটা ক্রেডিট ভাবে নিজের!
এতদিন এই সেই কারণে পুরষ্কার দিয়েছি।এখন ঠিক করেছি এই পুরষ্কার দেয়াটাকে মেয়েকে বই পড়ানোর দিকে নিয়ে যেতে কাজে লাগাবো। তাই রিসেন্টলি তার সাথে আমার ডীল হয়েছে-
তার যে আইকাস পরীক্ষা চলছে, এটা শেষ হয়ে গেলে, তাকে দশটা ক্লাসিক কীডস বুক পড়ে শেষ করে, প্রত্যেকটা বইয়ের মূল সারমর্ম আমাকে লিখে দিতে হবে।তাহলে তাকে আমি বড় লেগোর দোকানে নিয়ে যাবো। যত দাম হোক, সে যে লেগোর বক্স চাইবে আমি তাকে সেটাই কিনে দেবো ইনশাআল্লাহ। মেয়ে মহাখুশী!আমিও খুশী, টাকা গেলে যাক, তাও মেয়ে বই পড়ুক!

চতুর্থ কারণ
স্ক্রীন এডিকশান। আমি জানিনা অন্য বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন, আমার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখেছি, যখনই ওরা স্ক্রীন বেশী দেখে, তখনই কেমন যেন এডিক্টের মত আচড়ন করে! ঘুরে ফিরে সারাক্ষণ তাদের একটাই চিন্তা, কখন আবার স্ক্রীন নিয়ে বসবে!দুই মেয়ে সারাক্ষণ টিভি নিয়ে, আইপ্যাড নিয়ে, মোবাইল নিয়ে কাড়াকাড়ি! বড্ডাকে যাইই করতে বলি, দ্রুত করে ফেলে তারচে’ও দ্রুত টিভি দেখতে বসার জন্য! সবসময়ই জানতাম স্ক্রীন এডিকশান ভালো না।
কিন্তু বাস্তবে দুই বাচ্চা পালতে গেলে কোনটা যে ভালো আর কোনটা যে ভালো না, মন চায়, সবকিছুর ক্যাথা পুড়াই!
চাচা আপন জান বাঁচা’র মত অবস্থা হয় রিয়েল লাইফে, তখন কার্টূন কেনো, বাপ যা ইচ্ছা তা দেখ, তাও আমাকে দুই মিনিটের জন্য মাফ কর- টাইপ অবস্থা হয়! কিন্তু এর মধ্যেই খেয়াল করলাম,এখনো আমাদের চারপাশে অনুকরন করার মত, শেখার মত প্যারেন্টস আছে, যারা বাসাতে টোটালি টিভি-ই রাখে না!!

ছোটবেলা থেকে আমার ধারণা ছিলো,আমার বাপ-মা-ই বুঝি ডিফরেন্ট, কারন এমন কাউকে চিনতাম না যাদের বাসায় টিভি ছিলো না!এমনকি আমাদের বাসার বুয়া রুবীর মা’র বাসাতেও একটা সাদাকালো টীভি ছিলো!
কিন্তু আমাদের বাসায় ছিলো না!তখন ছোটবেলায় বিষয়টা কিছুতেই মানতে না পারলেও, আব্বুম্মুকে দুনিয়ার সবচে’ স্ট্রীক্ট প্যারেন্টস মনে হলেও,এখন বড় হয়ে বুঝি,জীবনে যতটুকু পড়েছি, যত সামান্যটুকুই পড়েছি,আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যেই যে পড়ার নেশা আছে,তার যদি একটা মেইন কারণ বলতে বলা হয়, তা হবে- আমাদের বাসায় টিভি না থাকা।

আমার পরিচিত এখন অনেক ইয়াং বাবা-মা-দেরকেই দেখি বাসায় টিভি কিনে না!এমন না যে তাদের বাচ্চারা টোটালী কোনো ধরনের স্ক্রীন থেকে ডীটাচড। তা না।কিন্তু টিভি না থাকলে বাচ্চাদের স্ক্রীন টাইম কন্ট্রোল করতে অনেক সহজ হয়।তবে ছোটবেলায় টিভি না থাকায় মানুষের বাসায় আব্বুকে লুকিয়ে লুকিয়ে টিভি দেখতে যাওয়ার যে বিদঘুটে অভিজ্ঞতা,তার কারণে আমি বলি, টিভি থাকুক। কিন্তু উইকডেইজে, সপ্তাহের পাঁচদিন, বাসায় কোনো টিভি চলবে না।

এই নিয়ে তাদের বাপের সাথে খিটমিট লাগে,‘একটু দিলে কী হয়’-তাদের বাপের প্রশ্ন,কিন্তু বাচ্চাদের সামনে সে এ ব্যপারে কোনো প্রশ্ন তুলে না।এই একটা বিষয় বাবা-মা হিসেবে দু’জন খেয়াল করে চলতে চেষ্টা করি শুরু থেকেই।
বাচ্চাদের সামনে কেউ কারো প্যারেন্টিং নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনা।আমি বলি ‘বাবা ঠিক’সে বলে ‘মা ঠিক’কিন্তু ঠিকই বাচ্চাদের পিছনে ঠ্যাশ দিয়ে বলে, ‘তুমি যা বুঝো তাইই! এত স্ট্রীক্ট হওয়ার কোনো মানে হয়? একটু আধটু স্ক্রীন তো রিফ্রেশমেন্টের জন্যও দরকার’।

ভুল কী ঠিক জানিনা।

কিন্তু ‘উইক ডেইজে নো স্ক্রীন এলাউড’ এই রুলস করার পর থেকে আমি নিজে খেয়াল করেছি- দুই মেয়ের মধ্যে অনেক চেইঞ্জ এসেছে। হ্যা, অসম্ভব বিরক্ত করে! হ্যা, একেক সময় মনে হয় নিজের চুল নিজে টেনে ছিঁড়ে ফেলি!
হ্যা, দুই বোনের মধ্যে রেফারীগিরি করতে করতে এক পর্যায়ে এমন চিৎকার চেঁচামেচি করি যে ওরা নিজেরাই ভয় পেয়ে চুপ মেরে যায়!হ্যা, আমার নিজের এক/দুই মিনিটের যে ব্রেকগুলো মিলতো, সেগুলোও মিলে না!হ্যা, সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে ‘মা এখন কী করবো?’ ‘মা কিছু তো করার নাই!’ ‘মা শুধু এক সেকেন্ড টিভি দেখি?’ ‘মা আমি বোওওওওরররড!’ ‘মা আমি কী খেলবো? খেলনা নাই তো!’ ‘মা ওগুলো সব পুরানো খেলনা, কী দিয়ে খেলবো?’ ‘মা প্লীইইইইইজ একটু কার্টূন দেখি? জাষ্ট এক মিনিট?’

হ্যা, এখন সারাক্ষণ ‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ শুনতে শুনতে একেক পর্যায়ে গিয়ে মনে হয় ব্রেনের সেলগুলো এখনই যেন ফেটে যাবে! এখনই মাথার ভিতর শর্ট সার্কিট হয়ে আমি বার্ষ্ট হয়ে যাবো! হ্যা,তারপরওএত ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যানের পরও খেয়াল করেছি, এখন যেহেতু মেয়েরা জানে যত আকুতি মিনতি করুক, কোনো ধরনের স্ক্রীন পাবে না, শেষে বাধ্য হয়ে নিজেরা নিজেরাই কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আগের কালের স্বাভাবিক বাচ্চাদের মত তখন হয় আঁকতে বসে! নয় পেইন্টিং করতে বসে!না হয় দুই বোনে মিলে দুইটা তরকারীর চামচকে তলোয়ার আর বন্দুক বানিয়ে সুপার হিরো খেলে! অথবা আর কিছুই না পেলে গল্পের বই টেনে নিয়ে বসে!সেদিন দেখি দুই বোন রুমের দুই প্রান্তে বসে হাতে একটা কাগজকে রোলের মত বানিয়ে প্রিটেন্ড-ফোন বানিয়ে একজন আরেকজনের সাথে ফোনে কথা বলার খেলা খেলছে!আরেকদিন দেখি বড়বোন ছোটবোনকে পড়ালেখা করাচ্ছে! এলফেবেট শেখাচ্ছে, আর ঠিক যেভাবে আমি তাকে শাঁসাই, সেভাবে সে তার ছোট বোনকে শাঁসাচ্ছে!!

নিজের চোখে দেখা রেজাল্ট এগুলো।অতএব মেয়েদের বাবা যতই অবজেকশান দিক,যতই মেয়েদের পিছনে আমাকে বলুক ‘মাঝে মাঝে তো একটু দাও!’আমি ভান করি যেন শুনিনি!চুপচাপ আয়রন লেডী সেজে বসে আছি আমি এ ব্যপারে।
‘নো ওয়ে!’ উইকেন্ডে যত ইচ্ছা তত টিভি দেখুক, কার্টূন দেখুক, মুভি দেখুক উইকডেজে জিরো স্ক্রীন!

ইউটিউবে একটূ ঘাটাঘাটি করলেই পাবেন কীভাবে স্ক্রীন বাচ্চাদের ব্রেইনের সেলগুলোকে অসম্ভব রকম স্টিমুলেট করে!
যারা টেক জগতের গুরু, তাদের পার্সোনাল ইন্টারভিউগুলো শুনলে বা দেখলেই পাবেন, তারা নিজেরা সারাক্ষন স্ক্রীন নিয়েই ক্যারিয়ারে চব্বিশ ঘন্টাই স্ক্রীনের সাথেই জড়িয়ে থাকলেও নিজেদের বাসায় বাচ্চাদের জন্য তাদের স্ক্রীন টাইম বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব মিনিমাম!

কোথায় যেন পড়েছিলাম, বাচ্চাদের জন্য ‘বোরড’ হওয়াটা খুবই দরকারী। কিন্তু যেসব বাচ্চারা স্কুল থেকে এসে পড়তে বসার আগে, বা পড়ার মাঝখানে দশমিনিটের জন্য, বা সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে পাঁচমিনিট, বা রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে আরেকটুখানি, এরকম করে স্ক্রীনে অভ্যস্থ হয়ে যায়, ঐ বাচ্চার ব্রেইন ‘বোরড’ হওয়ার সময় কই?!
ঐ বাচ্চার ব্রেইনের না আছে বিশ্রাম! না আছে কোনো কিছু ধীর স্থীরভাবে চিন্তা করার সময়! তার ব্রেইন অসম্ভব রকম সুপারসনিক গতিতে সারাক্ষন স্ক্রীনের সাথে সাথেই মুভমেন্ট করে যাচ্ছে!

এই যে ‘আচ্ছা কয়েক মিনিট দেখুক!’- এটাই সবচে’ ভয়ংকর! কারণ বাচ্চার মন সারাক্ষণ ঐ ‘কয়েক মিনিট’ স্ক্রীন দেখার জন্যই অস্থির হয়ে থাকে সারাক্ষণ।

আমার দুই মেয়ের উপর উইকডেইজ নো স্ক্রীন- রুলস জারি করে দেখেছি একমাত্র স্ক্রীনের উপর আমি যখন ট্রীক্ট থাকি তখনই তারা স্বাভাবিক বাচ্চাদের মত ‘ইমাজিনেটিভ’ খেলাধুলা বানিয়ে নেয়। নিজেরা নিজেরা মারামারি কান্নাকাটি করলেও শেষ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ঐ নিজেরা নিজেরাই খেলে। ঘুরে ফিরে যখন দেখে আর কিছুই করার নেই, তখন শেষ পর্যন্ত ঐ গল্পের বইয়ের কাছে ফেরত যায়।

তবে কথা আছে আরেকটু, এ ক্ষেত্রে আয়রন লেডী সেঁজে থাকলেও মাঝে মাঝে ধুম ধাম হঠাৎ ছেড়ে দেই! নিজেই হয়তো ওদেরকে নিয়ে ‘রিজারেকশান আর্তূগরুল’ বা ‘মানি হাইস্ট’ দেখতে বসে যাই! বড্ডা বলতে থাকে, ‘মাআআআআ!!! ইয়্যু আর ব্রেকিং ইয়্যূর ওওন রুলস!’ আমি নির্বিকারে বলি, ‘সামটাইমস রুলস আর মেন্ট টু বী ব্রোকেন!’মেয়ে পুরাই কনফিউজ হয়ে যায়! আমি ইচ্ছা করেই মেয়েকে কনফিউজড করে ছেড়ে দেই।

মেয়ে তখন আমার সাথে ডীলে আসে, যেহেতু আজকে আমি আমার সিরিজ দেখছি, সেহেতু তাকে আগামী কোনো একটা উইকডেইজে তার কোনো একটা কার্টূন দেখতে দিতে হবে।আমি শর্ত জুড়ে দেই, তাকে আগে হোমওয়ার্ক শেষ করতে হবে।অতঃপর আমাদের নেগোসিয়েশান শেষ হয়।তবে এমনটা খুব রেয়ার।খুবই রেয়ার। খুবই খুবই রেয়ার।নিয়ম ভাংগার মজাটা রেগুলার করে ফেললে নিয়ম ভাংগার আর মজা থাকে না!মোটের উপর এই হলো কাহিনী।ঠিক করছি নাকি ভুল করছি জানিনা।নিজে এখনো মা হওয়া শিখছি।আমার মা হওয়ার বয়স মাত্র আট বছরে পড়লো! এখনো অনেক অনেক শেখার বাকী।অতএব ভুল হলেও হতে পারে, খুব স্বাভাবিক।

কিন্তু এই চারটা কারণকে যখন থেকে আইডেন্টিফাই করে নিজে বই পড়া বাড়িয়েছি, রেগুলার সপ্তাহে একদম রুটিন করে লাইব্রেরীতে নেয়া শুরু করেছি, বই পড়ার জন্য মাঝে মাঝে পুরুষ্কার দেয়া শুরু করেছি, উইক ডেজে যে কোনো ধরণের স্ক্রীন একদম টো-টা-লি বন্ধ করে দিয়েছি বাসায়, তখন থেকে নিজের চোখের সামনেই রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছি।
হ্যা, অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে সে টয়লেটে বসে বসেও এখন মাঝে মাঝে বই পড়ে!রাতে টর্চ দিয়ে কম্বলের তলে বই পড়ে!

গাড়ীতে যখন সূরা শেখানোর জন্য চিল্লাতে থাকি, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এতক্ষন আমার বকা এক ফোঁটাও তার কান দিয়ে ঢুকেনি, কারন সে বইয়ের ভিতর ঢুকে গিয়েছে অলরেডী!মেজাজ খারাপ হয়!কিন্তু বকা দিতে গিয়েও দেই না।উলটা না দেখার ভান করি।করুক বাড়াবাড়ি!বই নিয়েই তো করছে!

লেখকঃ মোটিভেশনাল লেখক ও প্রবাসী বাংলাদেশী, অস্ট্রেলিয়া

 

আরও পড়ুন