।। এস এম আবু নাছের ।।
নরম্যান ভিনসেন্ট পিলের বিখ্যাত বই “The Power of Positive Thinking” পড়ছিলাম। সেখানে তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরেছেন। একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করছি-
“একজন ভদ্রলোক একদিন লেখককে ফোন করে হতাশা ও ব্যকুলতা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন যে,
-জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব শেষ হয়ে গেছে, সব শেষ।
– হ্যালো, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? আমি নরম্যান বলছি। হ্যালো!
– জ্বী বলুন। ফোনের ওপাশ থেকে ভদ্রলোক বেশ অস্বস্তি নিয়ে জবাব দিলেন।
– বলছি, আপনি কি আমার অফিসে একবার আসতে পারবেন? ঠিকানাটা জানেন তো?
– জ্বী জানি। কিন্তু আমার জীবনের সব নিরাশায় পরিণত হয়েছে। গভীর অন্ধকারে ডুবে আছি আমি। আমি নিজেকেই হারিয়েছি। আমি কীভাবে বাঁচবো?
– স্মিত হেসে লেখক আবারও উনাকে অফিসে আসতে আমন্ত্রন জানালেন।
পরদিন সকালে লেখক ও সেই আগন্তুক অফিসে বসে আছেন।
– আসুন, আপনার পুরো জীবনের উপর একটা নজর বুলানো যাক।
– না, না। তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি আর এ জীবনের দিকে তাকাতেই চাইনা।
– আচ্ছা, ঠিক আছে।
একটা কাগজের মাঝ বরাবর লেখক উলম্বাকারে একটি রেখা আঁকলেন।
– এই নিন, রেখাটির বাম পাশে আপনার জীবন থেকে যা যা হারিয়েছেন তার একটা তালিকা তৈরি করুন। আর ডান পাশে এখন পর্যন্ত যা রয়ে গিয়েছে তার তালিকা তৈরি করুন।
– এইটার কোন প্রয়োজনই নেই। আপনি বরং শুধু বামপাশের অংশটি রাখুন। আমার জীবনে এমন কিছুই নেই যা এই রেখার ডানপাশে স্থান দেওয়া যায়।
লেখক সাদা কাগজটি টেনে নিলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন-
– আচ্ছা, বলুন তো, আপনার স্ত্রী কতদিন আগে আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে? আর তিনি এখন কোথায়?
– কী বলছেন আবোল তাবোল? আমার স্ত্রী বিগত ৩০ বছর যাবত আমার সাথেই আছেন। আর সে আমাকে অনেক বেশি ভালবাসে।
– খুবই চমৎকার! তাহলে এই প্রথম বিষয়টিই কাগজের ডানপাশে লেখা যেতে পারে? কি বলেন? লেখক জিজ্ঞাসা করলেন।
– হুম, তা লিখতে পারেন। কিন্তু সত্যিই আমার জীবনে বেঁচে থাকার মত আর কিছু দেখতে পাচ্ছিনা।
– আচ্ছা, আপনিত নিঃসন্তান। তাইনা? তা এ নিয়েইতো আপনার অনেক কষ্ট।
– আপনি আবারও ভুল করছেন। আমার দুইটা ছেলে আছে।
– ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার ২ টা ছেলে আছে তো। হ্যাঁ, আমিই ভুলে গিয়েছিলাম। তা, আপনার ছেলেরা কবে থেকে জেলে বন্দী?
-আপনি বড্ড উলটাপালটা কথা বলছেন। আমার ২ টা ছেলের কেউই জেলে নেই বরং উচ্চশিক্ষা গ্রহনের উদ্দেশ্যে তারা কাছে থাকতে পারেনা।
– যাক, খুবই আশা জাগানিয়া বিষয়। তাহলে কাগজের ডানপাশে আমরা লিখতে পারি যে, আপনি নিঃসন্তান নন। প্রভু আপনার প্রতি কৃপা করে দুইটা সন্তান দিয়েছেন। আর তারাও সুস্থ আছে।
এরকম আরো কিছু প্রশ্ন করার পর আগন্তুক প্রানখোলা হাসিতে বললেন, “তাইতো, জীবনের সমীকরণটা কিভাবেই না বদলে যায়! শুধু চিন্তার ধরনটা পাল্টিয়ে নিতে হয়।
এবার চলুন রাসূলের জীবনী থেকে আরেকটি ঘটনা জানি-
সকালের অরুন রাঙ্গা সূর্য্য কিছুটা উপরে উঠেছে। এক মহিলা ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক করছেন, মনের মাঝে অস্বস্তি বোধ করছেন। স্বামী মসজিদ থেকে ফজরের সালাতের পরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ফিরবে অথচ আজও উনার মুখের সামনে দেওয়ার মত কোন খাবার নেই। ভগ্ন মনোরথে ভাবছেন যে সারাদিন অভূক্ত থেকেও তার স্বামীকে কত কঠোর পরিশ্রম আর দায়িত্বশীলতার মধ্যে দিয়ে পার করতে হবে অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না।
আরও পড়ুন-
কিছু পরেই প্রতিদিনের ন্যয় সহাস্য ও প্রফুল্লচিত্তে স্বামী ঘরে প্রবেশ করলেন, স্ত্রীকে সম্ভাষণ জানালেন ও জিজ্ঞেস করলেন,
– “ঘরে আমাদের জন্য খাবার কিছু আছে কি”?
– না, ঘরে কোন খাবারই নেই।
– বেশ, তাহলে আজ আমি সিয়াম রাখবো।
কী ভাবছেন? কার কথা শুনলেন এতক্ষণ? স্ত্রীর ভুমিকায় যিনি, তিনি আর কেউ নন আমাদের মা হযরত আইশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও স্বামী হলেন শ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ছোট্ট একটি কথপোকথন কিন্তু এ থেকে আমাদের শিক্ষনীয় বিষয় অনেক বেশি।
একটু ভেবে দেখুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন শুনলেন যে কোন খাবার নেই; তখন আর দশটা মানুষের ন্যয় তিনি খাবার না থাকাটার বিষয়ে, সারাদিন অভূক্ত থাকতে হবে সেই বিষয়ে মনযোগ নিবদ্ধ না করে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে বিষয়টিকে ঘুরিয়ে নিলেন। অভূক্ত থাকা বা খাবারের অভাবের বিষয়টি থেকে তিনি কত সুন্দরভাবে একটি ইতিবাচক, উপকারী ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন যা খাবার থাকা বা না থাকার বেড়াজাল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও কাজটির মর্যাদা অনেক উপরে।
জীবনের প্রতি আমরা অনেক সময়েই হতাশ হয়ে যাই। আমরা নিজেদের হতভাগ্য মনে করি। সত্যিকার অর্থে আমাদের জীবনে প্রাপ্তি আর সুন্দর বিষয়ের সমাহারের মাঝে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপ্রাপ্তি ও অসামঞ্জস্যতার দিকে না তাকালেই বরং জীবন সুন্দর হয়। অসুন্দরের আর অশান্তির পানে ধাওয়া করা বা সবসময় তার মাঝে ডুবে থাকা বরং অধিক অশান্তি নিয়ে আসে।
কোন ঘটনা বা বিষয়কে আমরা যতটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙিতে দেখতে পারবো ততই সমস্যার সমাধান দ্রুততর হবে। একবার এক নাস্তিক ব্যক্তি এসে কাগজের এক লেখাকে পড়তে লাগলো “God is no where” তার পাশেই আরেকজন এসে সেই লেখাটিকেই পড়লেন “God is now here”.
প্রকৃত বিষয় হল, আপনি কোন বিষয়কে কী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করছেন তার উপর। দৃষ্টিভঙ্গির ধনাত্মক/ইতিবাচক পরিবর্তন আপনার জীবনের সবখানে প্রভাব রাখবে, আর তা আপনার সফলতার পথে একধাপ এগিয়ে নিবে। পৃথিবীতে সকল সফল মানুষদের একটা বিষয়ে মিল পাওয়া যায় তা হল জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও আকাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার জন্য নিরলস সাধনা।
দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণের ইতিবাচক দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রে আমরা সহসাই একটি উদাহরণ দিয়ে থাকি যে, একটি গ্লাসে অর্ধেক পানি পূর্ন থাকলে কেউ এটাকে অর্ধেক পরিপূর্ণ বলবে আবার কেউ বলবে অর্ধেক খালি। যদিও দুটোই সত্য কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। একজন অর্ধেক পানি আছে বলে সেইটাই ধনাত্মক ভাবে উপস্থাপন করেছেম, আরেকজন বিষয়টিকে হতাশার চোখে দেখেছেন।
জীবনের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন দিয়ে নিজেকে গড়তে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ নিজেকে বদলে ফেলার এ যাত্রায় দূর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা করুন৷ নিজের সাথে সাথে অপরকেও বদলে দিন স্বমহিমায়৷ দু:খকে হাসিতে রূপান্তর করুন৷ গোস্বাকে সহনশীলতা ও কার্পণ্যকে দানশীলতায় ভরিয়ে দিন৷ খুব কঠিন কাজ নয়৷ আপনার স্থির সংকল্প আর প্রচেষ্টায় পারে আপনাকে অনন্য হিসেবে গড়ে তুলতে৷
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এমন অজস্র ঘটনা ঘটে যায় যেখান থেকে একটু চেষ্টা করলেই ভাল দিকটি খুঁজে নেওয়া যায়; দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়ে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করা যায়। রাব্বে কারীমের দরবারে সিজদায় লুটিয়ে বলা যায়-
আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী বিনি’মাতি ওয়া তাতিমুস সালিহাত।
লেখকঃ ব্যাংকার ও লেখক
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।