।। জামান শামস ।।
ইসলামের বিবাহ-দর্শন অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদ থেকে আলাদা। ইসলামে বিয়েকে বলা হয় নিকাহ (نكاح), বা তাযবীজ (تزويج) । যার আভিধানিক অর্থ হল: মিলন (union), জোড়া সৃষ্টি করা (pairing)। নিকাহের প্রধানতম উদ্দেশ্যই যৌনমিলন। যৌনতা মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন। এটি পূরণও হতেই হবে, আবার একই সাথে একে নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। এই চাহিদা পূরণ ও একইসাথে নিয়ন্ত্রণের বিধিবদ্ধতা হচ্ছে নিকাহ, যার উদ্দেশ্যই দুই লিঙ্গের মানুষের union-কে বৈধ করা। যার এই ক্ষমতা নেই, তার জন্য নিকাহ হারাম, যেমন: পুরুষত্বহীন পুরুষ।
সুতরাং যৌনমিলন হচ্ছে নিকাহের প্রধানতম উদ্দেশ্য। এটা পশ্চিমা marriage-এর সাথে নিকাহ-এর প্রধানতম পার্থক্য। যৌনমিলন সম্ভব না হলে, নিকাহ (union) নিরর্থক। একজন স্বাধীনা নারীর যৌনাঙ্গ একজন পুরুষের জন্য বৈধ হবার আইনী ভিত্তিই হচ্ছে নিকাহ। পশ্চিমা সভ্যতায় এই ভিত্তি হল সম্মতি, আর আমাদের হল নিকাহ। সম্মতিতে বিবাহ ছাড়া কনজুগাল লাইফে সারাজীবনই থাকা যায়। শুনে থাকবেন নিশ্চয়ই যে পুরুষ ও নারী দু’জনের যৌন মিলনে চার পাঁচজন সন্তান হবার পর খেয়াল হলো এবার তারা বিয়ে করবে,তাই বিয়ে করা।ইসলাম নারী পুরুষ কাউকেই এক লহমার জন্যেও এমন অযাচিত যৌনাচারের সূযোগ দিবে না বরং এটাকে হারাম বলেই বিবেচনা করে।
ইসলামে নিকাহ-কেন্দ্রিক অন্যান্য বিধানাবলীও এই যৌনমিলনকে কেন্দ্র করে গঠিত। যেমন, যদি ‘মাহর’ বা compulsory marital dower নিয়ে আলোচনা করি তাহলে এই উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট হয়। ইসলামে নিকাহের সাথে মাহর বা মোহরানা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মোহর মূলত একটি সম্মানী যা স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে থাকে, যার মূল উদ্দেশ্যই হল নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। এটা নারীর মূল্য নয় যে, তা পরিশোধ করলেই মনে করা যাবে, নারী নিজেকে স্বামীর হাতে বিক্রি করে দিয়েছে। তেমনি এ শুধু কথার কথাও নয়, যা শুধু ধার্য করা হয়, পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে নয়; বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সাথে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দিবে, যা তাকে সম্মানিত করে। এজন্য শরীয়তের তাকাযা হচ্ছে মোহর এত অল্পও নির্ধারণ না করা, যাতে মর্যাদার কোনো ইঙ্গিত থাকে না। আবার এত অধিকও নির্ধারণ না করা, যা পরিশোধ করা স্বামীর পক্ষে সম্ভব হয় না। অন্যথায় হয়তো মোহর আদায় না করেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে, নতুবা জীবনের অন্তিম মুহূর্তে স্ত্রীর কাছে মাফ চাইতে বাধ্য হবে।‘মাহর’ নগদ অর্থ হতে পারে, গহনা হতে পারে, কোনো বস্তু হতে পারে এবং কোনো মূল্যবান শিক্ষাও হতে পারে (কুরআনের সূরা)। just give anything precious to the precious person of your life. হাদিস থেকে আমরা জানি নগদ দিরহাম, সোনার টুকরো, কুরআনের সূরা (তার আর কিছুই নেই) শিখিয়ে দেওয়াকেও বিয়ের মাহর (মোহরানা) হিসেবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গ্রহণ করেছেন।আল্লাহ বলেন,
وَءَاتُوا۟ ٱلنِّسَآءَ صَدُقَٰتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَىْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيٓـًٔا مَّرِيٓـًٔا
আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। (সূরা নিসা ৪)
وَّالۡمُحۡصَنٰتُ مِنَ النِّسَآءِ اِلَّا مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ ۚ کِتٰبَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ ۚ وَاُحِلَّ لَکُمۡ مَّا وَرَآءَ ذٰلِکُمۡ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا بِاَمۡوَالِکُمۡ مُّحۡصِنِیۡنَ غَیۡرَ مُسٰفِحِیۡنَ ؕ فَمَا اسۡتَمۡتَعۡتُمۡ بِہٖ مِنۡہُنَّ فَاٰتُوۡہُنَّ اُجُوۡرَہُنَّ فَرِیۡضَۃً ؕ وَلَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ فِیۡمَا تَرٰضَیۡتُمۡ بِہٖ مِنۡۢ بَعۡدِ الۡفَرِیۡضَۃِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا
সেই সকল নারীও (তোমাদের জন্য হারাম), যারা অন্য স্বামীদের বিবাহাধীন আছে। তবে যে দাসীরা তোমাদের মালিকানায় এসে গেছে, (তারা ব্যতিক্রম)। ২৩ এটা তোমাদের প্রতি আল্লাহর বিধান। আর এ ছাড়া অন্য নারীদেরকে নিজেদের অর্থ-সম্পদ খরচের মাধ্যমে (অর্থাৎ মাহর দিয়ে নিজেদের বিবাহে আনার) কামনা করাকে বৈধ করা হয়েছে, এই শর্তে যে, তোমরা (বিবাহ দ্বারা) চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার ইচ্ছা করবে, কেবল কাম চরিতার্থকারী হবে না। ২৪ সুতরাং তোমরা (বিবাহ সূত্রে) যে সকল নারী দ্বারা আনন্দ ভোগ করেছ, তাদেরকে ধার্যকৃত মাহর প্রদান কর। অবশ্য (মাহর) ধার্য করার পরও তোমরা পরস্পরে যেই (কম-বেশি করা) সম্পর্কে সম্মত হবে, তাতে তোমাদের কোন গুনাহ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।(সূরা নিসা ২৪)
وَاِنۡ طَلَّقۡتُمُوۡہُنَّ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَمَسُّوۡہُنَّ وَقَدۡ فَرَضۡتُمۡ لَہُنَّ فَرِیۡضَۃً فَنِصۡفُ مَا فَرَضۡتُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ یَّعۡفُوۡنَ اَوۡ یَعۡفُوَا الَّذِیۡ بِیَدِہٖ عُقۡدَۃُ النِّکَاحِ ؕ وَاَنۡ تَعۡفُوۡۤا اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ؕ وَلَا تَنۡسَوُا الۡفَضۡلَ بَیۡنَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
তোমরা তাদেরকে স্পর্শ করার আগেই যদি তালাক দাও এবং তোমরা (বিবাহকালে) তাদের জন্য মোহর ধার্য করে থাক, তবে যে পরিমাণ মোহর ধার্য করেছিলে তার অর্ধেক (দেওয়া ওয়াজিব), অবশ্য স্ত্রীগণ যদি ছাড় দেয় (এবং অর্ধেক মোহরও দাবী না করে) অথবা যার হাতে বিবাহের গ্রন্থি (অর্থাৎ স্বামী), সে যদি ছাড় দেয় (এবং পূর্ণ মোহর দিয়ে দেয়), তবে ভিন্ন কথা। যদি তোমরা ছাড় দাও, তবে সেটাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। আর পরস্পর ঔদার্যপূর্ণ আচরণ ভুলে যেয়ো না। তোমরা যা-কিছুই কর, আল্লাহ তা নিশ্চিত দেখছেন।(সূরা বাকারা ২৩৭)
হাদিসে এসেছে-
১.স্বামী তার সাথে সহবাস করলে তাতে সে মাহরের অধিকারী হবে। [আবু দাউদ ২০৮৩, তিরমিযী ১১০২. ইবনু মাজাহ ১৮৭৯, ১৮৮০] যদি বিয়ের সময় মাহরের পরিমাণ নির্ধারণ নাও করে, বিয়ে consummate করার সাথে সাথে স্ত্রী মাহর প্রাপ্য হবে। এই consummate অর্থ ‘স্বামী-স্ত্রী একান্ত হওয়া’ (private secclusion) । উমার রা. বলেন: ‘পর্দা টেনে দিলে বা দরজা বন্ধ করলেই পূর্ণ মাহর ওয়াজিব হবে’। এটাই মালিকী ছাড়া বাকিদের অভিমত।
২. উকবা ইবন আমির (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, শর্ত (চুক্তি)- সমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিপালনীয় গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, তোমরা যা দ্বারা (মহিলার) লজ্জাস্থান হালাল করবে, (অর্থাৎ মোহর আদায় করা)। [সুনানে আন-নাসায়ী নিকাহ্ ৩২৮১] মাহর নির্ধারণ না করলেও সহবাসের পর স্ত্রী মাহর প্রাপ্য এবং ওয়াজিব, যদি না স্ত্রী দাবি ত্যাগ করে। মাহর পরিশোধ না করে স্বামী মারা গেলে তার সম্পত্তি থেকে অন্যদের দেনা শোধের আগে শোধ করতে হবে স্ত্রীর মাহর।
আরও পড়ুন-
দাম্পত্য জীবনে সম্মতির শিষ্টাচার ও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিতর্কঃ এক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
৩. ইবনু যুহরী (র.) থেকে বর্ণিত: আবদুল মালিক ইবনু মারওয়ান জবরদস্তিভাবে যিনা করা হয়েছে এমন স্ত্রীলোকের ফয়সালা এই দিয়েছেন, ধর্ষণ যে করেছে, সে ঐ স্ত্রীলোকটিকে মোহর দান করবে। ইমাম মালিক (র.) বলেন আমাদের নিকট এই ফয়সালা যে, যদি কেউ কোন স্ত্রীলোকের উপর জবরদস্তি করে, চাই সে কুমারী হোক অথবা অকুমারী, যদি সে স্বাধীনা হয়, তবে তাকে মাহরে মিসাল দেয়া আবশ্যক। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক ১৪১০] (ইখতিলাফ আছে, স্রেফ ধারণাটা বুঝার জন্য, মাসয়ালা বলা উদ্দেশ্য না)।
৪. সা’ঈদ বিন মুসাইয়িআব (রহ) থেকে বর্ণিত যে, ‘উমার বিন খাত্তাব (রা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি কোন মহিলাকে বিবাহ করে, অতঃপর তার সাথে মিলন করতে গিয়ে দেখে যে, ঐ নারী শ্বেত কুষ্ঠরোগী বা পাগলী বা কুষ্ঠ রোগগ্রস্তা তাহলে ঐ স্বামীর উপর স্পর্শ করা (মিলন) হেতু মোহর আদায় যোগ্য হবে। তবে ঐ ব্যাপারে যদি কেউ ধোঁকা দিয়ে থাকে তাহলে তাকেই মোহরের জন্য দায়ী করা হবে। হাদিসটি সা’ঈদ বিন মানসুর, মালিক, ইবনু আবী শাইবাহ বর্ণনা করেছেন। হাদিসটির রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।
৫. যদি স্বামী সহবাস না করেই বা পরিপূর্ণ একান্ত না হয়েই তালাক দেয়, তাহলেও স্ত্রী অর্ধেক মাহর পাবে।
৬. আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, মাহর পরিশোধের আগ পর্যন্ত স্ত্রী চাইলে সহবাসের অনুমতি না-ও দিতে পারে। কিন্তু একবার অনুমতি দিয়ে ফেললে, আর অনুমতি স্থগিত করতে পারবে না। শুধু ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। সাহেবাইনের মতে পারবে না।
৭. অধিকাংশ আলিমগণের মতে (হানবালি ছাড়া বাকিদের মতে), মাহর নেবার পর যদি স্ত্রী সহবাসে অসম্মতি জানায় (শারঈ কারণ ছাড়া), তাহলে স্বামী মাহর ফেরত চাইতে পারবে। (Maqsad al-nabih, M ajma ‘ al-‘anhur and al-Fiqh ‘ala al-madhahib al-‘arba’ah) এবং স্ত্রী ভরণপোষণ পাবার অধিকার হারাবে।
৮. যদি বাতিল বিবাহ (যা বিবাহ হয়নি, যেমন ৫ম স্ত্রী) করে এবং সহবাস করে, তবে বিয়েটা বৈধ না হলেও সহবাসের কারণে মাহর ওয়াজিব হবে।
মাহরের আলোচনাটুকু এজন্য করা হল, নিকাহ ও মাহর উভয়ের ওতপ্রোত হওয়াটা বুঝানোর জন্য এবং মাহর নির্ধারণ ছাড়া নিকাহ অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু ‘একান্ত হওয়া বা সহবাস করা’র সাথে সাথে পূর্ণ মাহর ওয়াজিব হয়ে যাবে। আগে ধার্য করে না নিলেও সহবাসের সাথে সাথে ‘মাহরে মিসিল’ (তার বংশের অন্যান্য মেয়েদের সমপরিমাণ মাহর) – এর হকদার স্ত্রী হয়ে যাবে, যা পুরুষের উপর ওয়াজিব। অর্থাৎ মাহরের সাথে পরষ্পর একান্ত হবার সম্পর্ক রয়েছে। তবে একান্ত না হলেও মাহর দিতে হয়, যেমন:
মিলিত হবার আগেই স্বামী মারা গেলে পূর্ণ দিতে হয়। [security money-র মতো]- মিলিত বা একান্ত হবার আগেই তালাক দিলে অর্ধেক দিতে হয় [সম্মানী হিসেবে]।
মাহরের দ্বারা স্ত্রীর যৌনসম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মাহরের প্রতীকী বিনিময়ে স্ত্রীর শরীরের উপর স্বামীর আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। এ থেকে অনেকে বলে থাকে, তাহলে পতিতার ভাড়াও তো একই জিনিস, তাহলে স্ত্রীও স্থায়ী পতিতা? নাউযুবিল্লাহ। পতিতার ভাড়া কেবলই তার দেহের ভাড়া। আর স্ত্রীর মাহর তার সম্মানী; কেননা স্ত্রী শুধু যৌনসুখই দেয় না, একজন স্ত্রী তার স্বামীকে যা দেয়, তা অমূল্য ভালোবাসা,সম্মান ও সার্বক্ষনিক সেবা।কুরআনের ভাষায়,
وَمِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَجَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّرَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে।(সূরা রুম ২১)
স্বামীর অর্ধেক দীন পূর্ণ করে দেয়, গুনাহকে কঠিন করে দেয়, ধীর-স্থিরতা দেয়, প্রশান্তি-ভালোবাসা দেয়, পিতৃত্ব-সুখ প্রদান করে, ঘরে শান্তি-আরামের ব্যবস্থা করে, কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ায়, একাকীত্ব কাটায়, অসুখে সেবা করে, জীবনসাথী হিসেবে সুখ-দুঃখের ভাগী হয়। শিক্ষককে আপনি যত টাকাই দেন, সেটা তাঁর দেয়া ‘শিক্ষার’ মূল্য হয় না, সেটা সম্মানী হয়, Token of respect হয়। মাহর-ও তেমনি স্ত্রীর Token of respect, যা শুধু স্ত্রীরই নিজের, সে যেভাবে ইচ্ছে বৈধপথে খরচ করবে।
এজন্য পরিভাষার গুরুত্ব এতো ব্যাপক। পশ্চিমা marriage বা বিবাহে ধর্ষণ হতে পারে, আমাদের ‘নিকাহ’-তে ধর্ষণ বলে কিছু নেই। আমরা মুসলিমরা ‘marriage’ বা বিয়ে করি না, আমরা নিকাহ করি। ইসলামের বিবাহ-দর্শনে (নিকাহ) ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর কোনো স্থান নেই। এটা কোনো খেয়ালখুশি না যে, যা মনে চাইল তাই করলাম।
একে বলে ‘আকদ’ (عَقْد), যার অর্থ চুক্তি, মতৈক্য, বন্ধন ইত্যাদি। যেকোনো চুক্তির ফলে উভয় পক্ষের পরস্পর দায়বদ্ধতা থাকে, পরস্পরের উপর অধিকার থাকে, কর্তব্য থাকে, চুক্তি পূরণের প্রতিশ্রুতি থাকে, চুক্তি রক্ষার চেষ্টা থাকে। যখন খুশি বিনা উস্কানিতে চুক্তি বাতিল করে দেয়া গেলে, তা কোনো চুক্তিই নয়। বিবাহ নারী-পুরুষের মাঝে এমন বন্ধন তৈরি করে যা শুধু বস্তুবাদী বা শুধু ভাবের দৃষ্টিতে নয়, বরং সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার দাবি রাখে।
এই বন্ধন শরীয়াহ রক্ষা করে— হালাল কাজের ভিতর সর্বনিকৃষ্ট কাজ হল তালাক। (নিরুৎসাহ প্রদান)। কোনো নারী যদি বিনা কারণে স্বামীর কাছে তালাক চায়, জান্নাতের সুগন্ধও তার জন্য হারাম। [আবু দাউদ, আলবানী সহীহ]। তোমরা আল্লাহর বান্দীদের ব্যাপারে কঠোর হয়ো না। তার একটা জিনিস অপছন্দ হলেও আরেকটা জিনিস পছন্দ হবে। নারীদের ব্যাপারে সবর কর। একটা জিনিস খারাপ লাগলেই পশ্চিমের মত ডিভোর্সের চিন্তা করোনা।
আরও পড়ুন-
ঐতিহ্যবাহী ‘বিবাহ’ প্রথার যে যে উদ্দেশ্যগুলো ছিল, তা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে এবং পুঁজিবাদের বিকাশের দরুন বিবাহ ছাড়াই পূর্ণ করা যেতে পারে। সুতরাং প্র্যাক্টিক্যালি যৌন, আর্থিক, প্রজন্মগত, স্বাস্থ্যগত— কোনো কারণেই আধুনিক সভ্যতায় ‘বিয়ে’র দরকার নেই।
পশ্চিমা সভ্যতার আধুনিক বিবাহ-দর্শন হলো- বিয়ে কেবলই একটা চুক্তি, যেখানে সমান দু’জন মানুষ (primarily a personal contract between two equals) মনে করে, তারা একে অপরের সাথে বাকি জীবন কাটাতে সম্মতি দেয়। তারা বিশ্বাস করে এতে তাদের প্রেম-খুশি-স্থিরতা বাড়বে। এবং এই সংজ্ঞা থেকেই সমকামীরাও বিয়ে করে, কেননা বিয়ের এই সংজ্ঞায় তারাও শামিল। যেহেতু সন্তান জন্মদান এই সংজ্ঞায় নেই। পশ্চিমা বিবাহ-দর্শনে বিশ্বাসীরা ঠিক এই চিন্তাকাঠামো থেকেই প্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী বিবাহ-প্রথা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
সুতরাং, এই বাস্তবতায় সমান দুজন, যাদের কারও উপর কারও কোনো দাবি নেই, অধিকার থাকবে না। স্রেফ পরস্পরকে মানসিক সুখ দেয়া, কমিটমেন্ট, ভালোবাসা যে চুক্তির উদ্দেশ্য; সেখানে যদি বিন্দুমাত্রও একপক্ষের অসম্মতি থাকে, সে চুক্তি আর প্রাসঙ্গিক থাকে না। এটাই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর ক্যানভাস। ঐ বিশেষ বিবাহ-দর্শনে ঐ বিশেষ অসম্মতির আচরণ (যা চুক্তির আওতাধীন না) তখন অপরাধ হিসেবে পরিগণিত।
পশ্চিমা বিবাহ-দর্শন আরও স্পষ্ট হবে যদি তাদের ডিভোর্স-দর্শনটা একটু টেনে আনা যায়। ১৯৬৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে প্রথম পাশ হয় no-fault divorce আইন। যদি উভয়ের যে কারও বিবাহ কন্টিনিউ করতে ইচ্ছে না করে, সে নো-ফল্ট ডিভোর্স দিতে পারে, যেখানে সঙ্গী/সঙ্গিনীর কোনো দোষ উল্লেখের প্রয়োজন নেই। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশেই এই আইন রয়েছে। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়াও এই আইন করে। তাদের বিবাহ-দর্শনে কোনো দায়বদ্ধতা, কোনো স্বার্থত্যাগ, সন্তানের দিকে চেয়ে কোনো কম্প্রোমাইজের কোনো বিষয় নেই। আর তাই সেখানে বিবাহ বলে কোন বিষয়ের অস্তিত্ব নেই। ছেলে মেয়ে ম্যচুর হলে বাবা মা তাদের যথেচ্ছা যৌনাচারে বাঁধা দিতে পারেন না। মিস্যুয়্যাল কন্টেন্ট ইজ এনাফ। আর স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, আগেই বলেছি রেসপেক্টফুল।জোর করে ভোগ নয়। ইসলামে একটা তালাকও এ স্বামীর এ অপরাধে হয়নি যে সে স্ত্রীকে মিলনে জোর খাটায়।বরং ইসলামই বলে দিয়েছে তার স্ত্রীর প্রতিমাসে ঋতুকালীন সময়ে তার কাছে না যেতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ، ‘
আর লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে মহিলাদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে। তুমি বল, ওটা কষ্টদায়ক বস্ত্ত। অতএব ঋতুকালে তোমরা স্ত্রীমিলন হ’তে বিরত থাক। তাদের নিকটবর্তী হয়ো না পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর যখন তারা ভালভাবে পবিত্র হবে, তখন তোমরা তাদের নিকটে গমন কর, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ ( সূরা বাক্বারা ২২২)
ধর্ষণের সংজ্ঞা এখন ব্যাপক, যা শুধু পেনিট্রেশনের ভিতর সীমাবদ্ধ নেই। প্র্যাকটিক্যালি ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষা বাস্তবতা যা বুঝা যায়, ধর্ষণ- অনেকগুলো অপরাধের সমষ্টি। অসম্মতিতে সহবাসই শুধু নয়; অসম্মতির দরুণ শারীরিক প্রহার, চড়-থাপ্পড়-জখম, বাধা দেবার চেষ্টার (ক্রস লেগ) বিপরীতে প্রচণ্ড আঘাত করা, যোনিপথ জখম- এই অপরাধ কয়টির সম্মিলিত রূপ হল ধর্ষণ। নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসটা অসম্মতিতে করার অনুমতি থাকলেও বাকি কয়টা বড় ধরনের অপরাধ।
আর স্বাভাবিক তো এটাই যে, নিজ স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বাধা থাকবে দুর্বল, সাময়িক; ফলে সহবাসে অসম্মতি থাকতে পারে, তবে প্রতিরক্ষা থাকবে না। ফলে ধর্ষণের পাশবিকতা বা ভায়োলেন্স এখানে অনুপস্থিত। মনে অসম্মতি থাকলেও দৈহিক প্রতিরোধ প্রত্যাহার করে নেবে। ফলে স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা অপ্রয়োগযোগ্য এবং অযথার্থ। অসম্মতিতে সহবাস আর ধর্ষণ কখনোই এক জিনিস না। পশ্চিমা নারীবাদী লিবারেল নৈতিকতার কাগুজে সংজ্ঞায় তা পড়তে পারে, কিন্তু বাস্তবতা বিবর্জিত এসব ‘এসিরুম ডেফিনেশন’ -এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং এসব কাগুজে ধারণা মানতেও আমরা বাধ্য না। তবে যেটা হতে পারে, স্বামী জালেম হতে পারে। জুলুমের অংশ হিসেবে জোরপূর্বক সহবাস হতে পারে। ইসলাম সেটাকে জুলুম হিসেবেই দেখবে, আলাদা করে ধর্ষণ হিসেবে নয়।
লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।