।। শাফিকুন্নাহার ।।
বিশ্বজুড়ে আজ উদযাপিত হচ্ছে মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করা হয় এই দিবসটিকে। মূলত প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
শ্রমিক দিবসের শুরু যেভাবে:
১৮৮৬ সালের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবীতে আন্দোলন রত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে ১১ জন শহীদ হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় এইদিন পালিত হয় না। এ ছাড়া এই দিনে আরও কিছু ঘটনা রয়েছে যা আঞ্চলিকভাবে হয়তো পালিত হয়।
পূর্বে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হত, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন। বিপরীতে মজুরী মিলত নগণ্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত । ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১লা মে। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবী মেনে নিল না। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশবাহিনী তৎক্ষণাত শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন । অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি।
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার” দাবী অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। আর পহেলা মে বা মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবী আদায়ের দিন হিসেবে, পৃথিবীব্যাপী আজও তা পালিত হয়।
আরও পড়ুন-
কুরআন-হাদিসের আলোকে মালিক শ্রমিক সম্পর্কঃ
আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন শ্রমজীবী হিসাবে। মানুষ কাজ করে নিজেদের জন্য হালাল জীবিকা নির্বাহ করবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ঘোষণা করেন,
“যখন সালাত শেষ হবে, তখন তোমরা জীবিকা নির্বাহের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।” (সূরা জুমুআ, আয়াত-১০)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ ফরজ নামাজ আদায়ের পর রিজিকের সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শ্রমিক এবং মালিক দুজনই মানুষ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। (সূরা নিসা, আয়াত-১)। এখানেই স্পষ্ট, সূচনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সেই দিক দিয়ে সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই।
রাসূল (সা.) বলেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। (সহিহ বুখারি – ৬৪৮১)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১০)। সুতরাং, মালিক এবং শ্রমিক যাই হোক, আমরা যদি ইসলামের উপরোক্ত নির্দেশনার দিকে তাকাই, তাহলে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক হবে আপন ভাইয়ের মতো। বড় ভাই ছোট ভাইয়ের যে সম্পর্ক হয় সেটাই হবে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক। একজনের ওপর আরেকজনকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করেছেন মাত্র।
তিনি বলেন, আর আল্লাহ্ জীবনোপকরণে তোমাদের মধ্যে কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। (সূরা নাহল, আয়াত-৭১)। সুতরাং, সেই বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে শ্রমিকের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে হবে। তার জন্য তা-ই পছন্দ করতে হবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করি। তাকে তা খেতে দিতে হবে, যা নিজেরা খেতে পছন্দ করি।
রাসূল (সা.) বলেন, শ্রমিক বা তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং, যার ভাইকে তার অধীন করেছেন, সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায়, যা সে খায়। সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে এবং তাকে সামর্থ্যরে অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না, যদি এমনটা করতে হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে (সহিহ বুখারি-৫৬১৭)।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (সহিহ বুখারি)
আরও পড়ুন-
সুতরাং, মালিক শ্রমিকের ব্যাপারে এ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করলে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। কাজের সুন্দর পরিবেশ তৈরি হবে। শ্রমিককেও তার কাজের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।
মালিকের অবর্তমানে শ্রমিকের ওপর তার সব সম্পদ আমানতস্বরূপ। তাকে আমানতের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কাজে ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। মালিকের কাজকে নিজের কাজ মনে করে করতে হবে।
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) দীর্ঘ দশ বছর রাসূলের খেদমত করেছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে রাসূল (সা.)কে বলতে হয়নি, আনাস! এ কাজটি কেন করেছ কিংবা এ কাজটি কেন করনি। এজন্য শ্রমিকদেরও ভালোভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মালিকরাও শ্রমিকদের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দিতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা নিজেই কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যরে বাইরে দায়িত্ব দেন না। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৮৬)।
তাই, শ্রমিকদের ওপর এমন কাজের বোঝা দেওয়া যাবে না, যা করতে সে অক্ষম। এমন কাজ দিলে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। মজুরি বাড়িয়ে দিতে হবে। মালিক শ্রেণিকে সব সময় মনে রাখতে হবে, আল্লাহতায়ালা চাইলে আমাকেই শ্রমিক বানিয়ে তাকে আমার মালিক বানাতে পারতেন। আল্লাহতায়ালার এ অনুগ্রহকে স্মরণ করতে হবে।
সুতরাং, নিজের পক্ষে যা অসম্ভব, তা শুধু শ্রমিক হওয়ার কারণে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সামর্থ্য থাকার পরও শ্রমিকের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা যাবে না। আর ছোটখাটো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। নবি (সা.) বলেন, যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তার থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি। কেয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেব। (সহিহ বুখারি-২২২৭)।
শ্রমিককে তার যথাযথ প্রাপ্য না দেওয়া এবং তার সঙ্গে সুন্দর আচরণ না করার ফলেই মালিক শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাই, মালিক শ্রমিক স্ব স্ব জায়গা থেকে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে মালিক শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। ফলে উভয় উপকৃত হবে। মালিক শ্রমিক বৈষম্যও দূরীভূত হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখকঃ কলাম লেখক
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১)
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।