Ads

জ্ঞান- বিজ্ঞানে কেন আমরা পিছিয়ে, উত্তরণের উপায় কি?

।।  প্রফেসর ড. মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন ।।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম! “ইকরা” শব্দটি ইসলামের প্রথম ওহির অংশ, যা মুসলিমদের জ্ঞানার্জন এবং অধ্যয়নের গুরুত্ব নির্দেশ করে। আল্লাহ তায়ালা প্রথম ওহিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আদেশ দিয়েছেন,

“পড়ুন, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আলাক, আয়াত ১)।

এই আদেশটি মুসলিমদের জন্য জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত হওয়ার একটি প্রধান নির্দেশনা। কিন্তু আজকের মুসলিম সমাজে বিজ্ঞান, গবেষণা ও জ্ঞানের দিক থেকে সেই অগ্রগতি আর দেখা যায় না, যা একসময় মুসলিমরা দুনিয়ায় দেখিয়েছে। কেন এই অবনতি এবং কীভাবে এই পতন থেকে উত্তরণের উপায় বের করা যেতে পারে, তা বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।

মুসলিমদের প্রাচীন সাফল্যের কারণ:

ইসলামের শুরুর সময় থেকে মুসলিমরা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, এবং প্রযুক্তিতে বিশাল অবদান রেখেছিল। কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:

১. বায়তুল হিকমা (জ্ঞানাগার):

আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ ও তার পুত্র আল-মামুনের শাসনামলে বাগদাদে স্থাপিত হয় বায়তুল হিকমা (জ্ঞানাগার)। এখানে মুসলিম বিজ্ঞানীরা গ্রিক, ফার্সি, হিন্দু, এবং অন্যান্য সভ্যতার জ্ঞানকে অনুবাদ করে তা পরিপূর্ণতা দেন।

২. ইবনে সিনা ও আল-ফারাবী:

ইবনে সিনার “কানুন” এবং আল-ফারাবীর চিন্তা দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং মনস্তত্ত্বের উপর বিশাল প্রভাব ফেলে, যা ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময়েও অনুসরণ করা হয়।

৩. আল-খাওয়ারিজমি:

গণিতের বিশ্বে আলজেব্রার বিকাশে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। “আলজেব্রা” শব্দটিই এসেছে তার বইয়ের নাম থেকে।

আরও পড়ুন-

ক্রিকেটের নাকি শিক্ষার উন্নতি আগে দরকার?

বর্তমান অবস্থা:

আজকের দিনে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানের চর্চা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:

১. শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা:

অনেক মুসলিম দেশেই শিক্ষাব্যবস্থায় পর্যাপ্ত মান বজায় রাখা হয় না। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে সমর্থন এবং উৎসাহের অভাব রয়েছে।

২. গবেষণায় বিনিয়োগের অভাব:

গবেষণার ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হয় না। গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় মুসলিম দেশগুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

৩. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা:

মুসলিম বিশ্বে অনেক দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে শিক্ষার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

৪. জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি:

ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞানের প্রতি যে আকর্ষণ এবং শ্রদ্ধা ছিল, তা অনেকাংশে বিলীন হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিকভাবে জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে।

কীভাবে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে ফিরে আসা সম্ভব?

আবারও জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং আবিষ্কারে মুসলিমদের অগ্রগামী হতে হলে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

১. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার:

শিক্ষাকে ইসলামের মূল নীতি অনুযায়ী উপস্থাপন করতে হবে, যেখানে ধর্মীয় ও আধুনিক বিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রতি জোর দিতে হবে।

২. গবেষণার প্রতি বিনিয়োগ বৃদ্ধি:

মুসলিম দেশগুলোকে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণায় অর্থায়ন বাড়াতে হবে এবং তা শুধুমাত্র তত্ত্বীয় জ্ঞানে সীমাবদ্ধ না রেখে তা প্রয়োগমূলক ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে হবে।

৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা:

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা শিক্ষার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অভ্যন্তরীণ সংকটের সমাধান ও বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ও গবেষকরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবে।

৪. উৎসাহ প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধি:

মুসলিম যুবকদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের, অভিভাবকদের এবং সামাজিক নেতাদের উচিত তাদের প্রেরণা দেওয়া এবং জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা।

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর সাথে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নত শিক্ষা ও প্রযুক্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।

৬. ধর্মীয় এবং আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়:

ইসলামের প্রাথমিক যুগের মতো ধর্মীয় জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করে বরং সমন্বয় করার চেষ্টা করতে হবে। ইসলাম সবসময়ই জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে, এবং সেই ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে।

উপসংহার:

মুসলিমরা একসময় জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং গবেষণায় পৃথিবীর শীর্ষে ছিল কারণ তারা ইসলামের মূলনীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আজকের মুসলিমরা যদি সেই শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে তারা পুনরায় বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। “ইকরা” শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জ্ঞানার্জন ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং মুসলিমদের উচিত তা পুনরায় তাদের জীবনে ফিরিয়ে আনা। মহান আল্লাহ দয়া করে সকলকে কবুল করুন।  আমিন!

লেখকঃ প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন