Ads

ধার্মিকতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব যেমন হবে

।। অধ্যাপক গোলাম আজম ।।

ধর্মের ভিত্তিতে যে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এর প্রমাণ আমার জীবনেই পেয়েছি । ১৯৫০ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে যখন রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি, তখন সিনিয়র অধ্যাপকদের বেশির ভাগই হিন্দু ছিলেন । স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু ও মুসলিম সকল অধ্যাপকের সাথেই পরিচয় হল ।  আমি যেহেতু ধর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা করা পছন্দ করতাম, সেহেতু অধ্যাপকগণের  মধ্যে যারা ধর্মচর্চা করতে আগ্রহী ছিলেন, তাদের সাথে আমার সম্পর্ক অন্যদের তুলনায় একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো । বলা বাহুল্য যে, কয়েকজন মুসলিম অধ্যাপকের সাথেই প্রথমে এ সম্পর্ক গড়ে ওঠে । টিচার্স কমনরুমে মাঝে মাঝে অবসর সময়ে ধর্ম, নৈতিকতা ও চরিত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপকদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হতো ।

আমরা ছাত্রদেরকে পড়াই যাতে তারা ডিগ্রী পেতে পারে । কিন্তু তাদেরকে চরিত্রবান বানাবার কোনও চেষ্টা করা কি আমাদের উচিৎ নয়? এ জাতীয় আলোচনা উঠলেই ধর্মের কথা এসে যেতো । কারণ চরিত্র গঠনের জন্যই ধর্মের প্রয়োজন । ধর্মই এ কথা শেখায় যে, আমার একজন স্রষ্টা আছেন । তিনি আমাকে অন্য পশুর মতো বিবেকহীন জীব বানাননি । ভালো ও মন্দের বিচারবোধ আমাকে দিয়েছেন । আমার এ নৈতিক চেতনা অনুযায়ী আমি চলছি কিনা, সে কথা আমার স্রষ্টা নিশ্চয়ই একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন । তা না হলে আমাকে বিবেক শক্তি দেবার যৌক্তিকতা থাকে না । ধর্মের এ চেতনাই উন্নত নৈতিক চরিত্রের উৎস ।

ধর্মই মানুষের মধ্যে এ দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করে যে, দুনিয়ার জীবনে ভাল কাজ করলে এবং বিবেকের দাবী অনুযায়ী চললে মৃত্যুর পর এর ভাল ফল অবশ্যই পাওয়া যাবে ।

তেমনি বিবেকের বিরুদ্ধে জীবন যাপন করার কুফলও পেতে হবে । এটা যুক্তি ও কমনসেন্সেরই দাবী । ভাল ও মন্দ কাজের একই রকম পরিণতি হতে পারে না ।

ধর্মের এ সব মৌলিক বিষয় নিয়ে আমি ছাত্রদের মধ্যেও চর্চা করতাম । দুপুরের পর ৪৫ মিনিট বিরতি চলাকালে আমি ধর্মালোচনার জন্য আলাদা একটা ক্লাসে ছাত্রদের নিয়ে প্রায়ই বসতাম । ছেলেরাও আমাকে ধর্মীয় ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন করতো । আমি তাদেরকে যুক্তি দিয়ে ধর্মের কথা বুঝাবার চেষ্টা করতাম ।

কলেজের রুটিনের বাইরে টিচার্স কমনরুমে বা বিরতির সময় ক্লাসে ছাত্রদের মধ্যে আমার ধর্মচর্চা অধ্যাপকদের মধ্যে সবাই সমান চোখে দেখতেন না । মুসলিম অধ্যাপকদের মধ্যেও বেশির ভাগই এ সব আলোচনায় উৎসাহ দেখাতেন না । হিন্দু অধ্যাপকদের মধ্যে বাবু গৌর গোবিন্দ গুপ্ত নামে দর্শন বিভাগের পৌড় একজন অধ্যাপক এ তৎপরতায় আমাকে উৎসাহ দিতেন । আমি এতে বিস্ময়বোধ করতাম । ধীরে ধীরে তার সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগলো । তিনি আমাকে তার বাসায় নিয়ে ধর্মীয় আলাপ শুরু করলেন ।

আরও পড়ুন-

অমুসলিমদের সাথে আচরণে ইসলামের নির্দেশনা

আমি তার মধ্যে এমন এক খোদা-প্রেমিক মন পেলাম যে, আমাদের মধ্যে বয়সের তারতম্য স্বত্বেও গভীর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়ে গেল । তিনি আমাকে রাম কৃষ্ণ পরমহংসের চরিতামৃত শুনাতেন যাতে এমন সব ভাব প্রকাশ পেত, যা আল্লাহর কুরআন ও রাসুলের অনেক বাণীর সাথে মিলে যেতো । আমি কোরআন থেকে বা রাসুলের হাদিস থেকে অনুবাদ করে শুনাতাম, তখন তার মধ্যেও এমন আবেগ সৃষ্টি হত যে তার চোখে পানি এসে যেতো ।

মাঝে মাঝে আমাদের দুজনের বৈঠক দীর্ঘ সময় ধরে চলতো এবং ধর্মীয় আলোচনা উভয়কে সমানভাবে তৃপ্তি দিত । তার সাথে আমার এ ভালোবাসার সম্পর্ক একমাত্র ধর্মের কারণেই গড়ে উঠেছিল । এ জাতীয় সম্পর্ক যে কত গভীর হয় , তার সাক্ষী আমি নিজেই । পার্থিব স্বার্থের ভিত্তিতে এমন পবিত্র সম্পর্ক হতেই পারে না ।

রংপুর কারমাইকেল কলেজ অবিভক্ত বাংলার ৫টি বড় কলেজের একটি ছিল । বিরাট এলাকা দখল করে আছে কলেজের বিল্ডিং, ছাত্রদের হোস্টেল ও অধ্যাপকের বাসা । গৌর বাবু বড় বাসাগুলোর একটায় থাকতেন । তার মধ্যে একটা কামরা পুঁজার জন্য নির্ধারিত ছিল ।  আমি তার বৈঠকখানায় যখনই যেতাম তাকে হয় পাঠরত পেতাম অথবা পুঁজার ঘর থেকে বের হতে দেখতে পেতাম । তার ধির স্থির সৌম্য চেহারা আমার মনে শ্রদ্ধারই আসন করে নিয়েছিল ।

চাকুরী থেকে গৌর বাবু অবসর গ্রহণ করে যখন কলেজের বাসা ছেড়ে দেবার প্রস্তুতি নিলেন, তখন আমাকে আবেগের সাথে বললেন, ‘এ বাসায় দীর্ঘ ৩৩ বছর কাটিয়েছি । এ বাসা তৈরি হবার সময় থেকেই আমি এখানে আছি ।  এখানে কোনও অধার্মিক লোক বাস করেনি আমার পর এখানে যদি কোনও অধার্মিক লোক বাস করে, তাহলে আমার মনে ব্যথা লাগবে । তাই আমার যাবার আগেই দেখে যেতে চাই যে, আপনার মতো লোক যেন এখানে থাকে । আপনার যদি এ বাসায় আপত্তি না থাকে তাহলে আমি প্রিন্সিপালের কাছে আমার বিদায়কালীন আবেদন জানাবো যাতে তিনি আপনার নামে এ বাসাটা এলট করে দেন ।’

তার আবেগ-ভরা, স্নেহ-মাখা ও হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলো রীতিমত অভিভুত করলো । আমি নতুন অধ্যাপক এবং আমার পরিবার ছোট বলে এত বড় বাসা পাওয়ার আশা করিনি । কিন্তু শ্রদ্ধেয় গৌর বাবুর আবদার প্রিন্সিপাল ফেলতে পারলেন না ।

আরও পড়ুন-

আন্তঃধর্ম বিবাহে ইহকাল ও পরকালের প্রাপ্তি

যদিও এ ঘটনা ও বিষয়টা একান্তই ব্যক্তিগত, তবুও ঘটনাটি থেকে এ  ধারণা আমার অন্তরে বদ্ধমূল হয়েছে যে , ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও ধর্মের ভিত্তিতেই বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠা স্বাভাবিক । অপরদিকে এক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত দু’জনের মধ্যেও ধার্মিকতার অভাবে শত্রুতা থাকতে পারে।

তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান দেশবাসীর মধ্যে যারা ধর্মকে ভালোবাসেন এবং মানুষের নৈতিক উন্নয়নের জন্য ধর্মের গুরুত্ব অনুভব করেন, তারা রাজনৈতিক অঙ্গনেও অধার্মিক নেতৃত্ব পছন্দ করবেন না । সৎ ও চরিত্রবান নেতৃত্ব ব্যতীত দেশের উন্নতি হতে পারে না । জামায়াতে ইসলামী ঐ নেতৃত্বই গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে ।

রাজনৈতিক ময়দানে এদেশের অমুসলিমদের মধ্যে যারা ধর্মেরও গুরুত্ব অনুভব করেন, তাদের পক্ষে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করার পথে কোনও বাঁধা থাকার কথা নয় । তারা ধর্মীয় ব্যাপারে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান থেকেই জামায়াতে ইসলামীর সংগঠনে যোগদান করে এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শরীক হতে পারেন । অমুসলিম নাগরিকগণকে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠনে যোগদান  করার সুযোগ দেবার যে ফরম রয়েছে, তা আশা করি তাদের নিকট সহজেই গ্রহণযোগ্য হবে ।

লেখকঃ লেখক, প্রাবন্ধিক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও  বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা

সূত্রঃ ‘ধার্মিকতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব’ অধ্যায়, পৃষ্ঠাঃ ৩৪-৩৭ , বইঃ  ‘অমুসলিম নাগরিক ও জামায়াতে ইসলামী, লেখকঃ অধ্যাপক গোলাম আজম

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-

[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।

মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে।  আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।

 

আরও পড়ুন