Ads

ফজরের সালাত যেভাবে মুসলিমদের জন্য উপকারী

।। জামান শামস ।।

“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম”- “ঘুম থেকে নামাজ উত্তম”

মুয়াজ্জিন মিনারচূড়ে দরাজকন্ঠে প্রতিদিন সুবেহ সাদিকে বলে-

হাইয়্যা আলাল সালাহ- সালাতের দিকে আসো,

হাইয়্যা আলাল ফালাহ-কল্যাণের দিকে আসো,

আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম- “ঘুম থেকে নামাজ উত্তম।

মুসলমানদের বিশাল একটি অংশই ফজরের সময় “নামাজ অপেক্ষা ঘুম উত্তম” ভেবে ঘুমিয়েই থাকি। হে ফজর পরিত্যাগকারী ভাই! ঠিক যে মুহুর্তে তুমি আজানের আওয়াজের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিছানায় ঘুমাচ্ছ, ঠিক ঐ মুহুর্তে হয়তো কোন কবরবাসী আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমার প্রভু! আমাকে পূণর্বার পৃথিবীতে যাওয়ার সুযোগ করে দিন, যেন আমি আমলে সালেহ করতে পারি! কিন্তু তা কি আসলে কস্মিনকালেও সম্ভব !!!

নামাজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই প্রত্যেক সুস্থজ্ঞান সম্পন্ন বালেগ মুসলমানের জন্য ফরয। প্রায় মুসলমানের ঘরে ফজরের সালাত মোটেও পড়া হয় না যদিও অন্য ওয়াক্তে তাদের সালাতে পাওয়া যায়।কোন এক ওয়াক্ত ছেড়ে বাকী চার ওয়াক্ত নামাজের বিষয়ে অনেক উলামাই “মুনাফিকের আলামত” বলেছেন। যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মুনাফিকদের ওপর সবচেয়ে কঠিন সালাত হলো, ইশা ও ফজরের সালাত। তারা যদি এ দুই সালাতের ফযিলত সম্পর্কে জানতো তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে উপস্থিত হতো। আর আমি ইচ্ছা করেছি যে, সালাত আদায় করার আদেশ দিব ও ইকামাত দেয়া হবে তারপর একজনকে বলব যেন সে মানুষদের নিয়ে সালাত আদায় করে। অতঃপর আমি কতক মানুষ যাদের সাথে থাকবে লাকড়ির বোঝা তাদেরকে নিয়ে সেসব লোকদের কাছে যাবো যারা সালাতে উপস্থিত হয় না এবং তাদের ওপর তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিব।” (বুখারী ও মুসলিম)।

ফজরের সালাত মুমিনদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সালাত। সূর্যের আলো যেমন রাতের অন্ধকার দূর করে পৃথিবীকে আলোকিত করে, পৃথিবীর প্রাণীদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ জন্মাতে সাহায্য করে। একইভাবে, ফজরের সালাত মুমিনদের আলো ও দিকনির্দেশনা দেয় যার ফলে তাদের অন্তর আধ্যাত্মিক শক্তিতে আলোকিত হয়। আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়ার মাধ্যমে তাই আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করি।

মূলতঃ সুন্নাহভিত্তিক লাইফস্টাইলেই আমাদের সর্বাধিক কল্যাণ নিহিত। নবী সা:-এর সুন্নাত হলো তাড়াতাড়ি ঘুমানো ও ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলে আমাদের শরীর পর্যাপ্ত রিলাক্সের সময় পায়। যেসব মানুষ কম ঘুমায় তাদের এনার্জি লেভেল কম থাকে এবং ডিপ্রেশন ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগে। যার ফলে তাদের মুড সুইং হয় এবং টেম্পার ট্র্যানট্রাম জনিত সমস্যায় ভোগে। অন্য দিকে রাতের পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। যার ফলে শরীরে রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি পায়,টিস্যু প্রতিস্থাপন ভালো হয়। রক্তচাপ কমায় এবং শরীরে আরামবোধ হয়। ব্যায়াম করার পর্যাপ্ত সময় থাকায় দেহ সংলগ্নতা ভালো হয়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণের মতে, লাইফস্টাইল জনিত রোগ, বিশেষ করে মহিলাদের ওবেসিটি, থাইরয়েড, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের (পিওএস) মতো সমস্যাগুলোর অন্যতম কারণ অপর্যাপ্ত ঘুম, উপযুক্ত খাবার ও ব্যায়ামের অভাব। কিন্তু যারা তাড়াতাড়ি ঘুমায় ও ভোরে ওঠে তাদের পর্যাপ্ত স্লিপ সাইকেল শরীরের অঙ্গসমূহের সঠিক কাজ করতে সাহায্য করে এবং হরমোন উৎপাদন স্বাভাবিক রাখে।

আরও পড়ুন-

স্বামী-স্ত্রী তালাকের পরও ভালো বন্ধু হতে পারে কি?।। ১ম পর্ব

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِدُلُوۡکِ الشَّمۡسِ اِلٰی غَسَقِ الَّیۡلِ وَ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ ؕ اِنَّ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ کَانَ مَشۡهُوۡدًا সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন।আর ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত উপস্থিতির সময় (সূরা ইসরা ৭৮)।আর قرآن الفجر বলতে ফজরের নামায। এখানে কুরআন অর্থ নামায। ফজরের নামাযকে কুরআন বলে এজন্য আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, ফজরে কিরাআত পাঠ লম্বা হয়।

হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, ফজরের সালাতের সময় দিবা-রাত্রির উভয়দল ফেরেশতা উপস্থিত থাকে এবং খুব মনোযোগের সাথে তিলাওয়াত শুনে। তাই ফজরের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন , ‘তোমাদের কাছে দিন ও রাত্রির ফেরেশতা পালাক্রমে যাতায়াত করতে থাকে। আর ফজর ও আসরের নামাজে তারা একত্র হন। তারপর যারা তোমাদের কাছে রাত কাটিয়েছেন তারা ঊর্ধ্বাকাশে চলে যান। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা আমার বান্দাদেরকে কী অবস্থায় ছেড়ে এসেছো? তারা বলেন, আমরা যখন তাদেরকে ছেড়ে এসেছি তখন তারা সালাতে প্রবৃত্ত ছিল। আর যখন আমরা তাদের কাছে গিয়েছিলাম তখনো তারা সালাতে ছিল’ (মুসলিম ৬৩২)

পরিপূর্ণ মুমিনের পথ পরিক্রমা ত্যাগ-তিতিক্ষার। তাই আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিতে মুমিন ভোরের আরামের ঘুম বিসর্জন দেয় অবলীলায়। কারণ সে জানে, ঘুম থেকে সালাত উত্তম। কিন্তু অপর দিকে, ‘মুনাফিকের ওপর ফজর ও এশার নামাজ অপেক্ষা অধিক ভারী সালাত আর নেই। যদি তারা এর ফজিলত ও গুরুত্ব জানত তাহলে হামাগুঁড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে উপস্থিত হতো’ (মুসলিম ৬৫১)। আর ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল সে যেন অর্ধরাত্রি ইবাদত করল আর যে ফজরের সালাত জামাতে আদায় করল সে যেন সারারাত সালাত পড়ল’ (মুসলিম ৬৫৬)।

ফজরের সময়টা সুন্দর এবং বরকতময়। তখন পৃথিবী নিশ্চুপ এবং স্থির থাকে। তাই ফজরের বারাকাহও চারপাশে অনুভূত হয়, যা আত্মিক স্বাস্থ্যের সুষমতা এবং প্রশান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে আমাদের প্রডাক্টিভিটিও সচল থাকে সারা দিন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের জন্য ভোরের সময়টাকে বরকতময় করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। তিনি তাঁর যুদ্ধ থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফজরের সময়ই করতেন। এ ছাড়াও সময়মতো সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পাই। সারা দিনের বাকি সালাতগুলোও একটা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করার অনুপ্রেরণা পাই। এতে করে সারা দিনের সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়।

Benzamin Franklin-এর বিখ্যাত কবিতার দু’টি লাইন আমরা সবাই জানি-Early to bed and early to rise, Makes a men healthy wealthy and wise.বাস্তবিকই যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য সকালের বিকল্প নেই। অধিকতর সফল মানুষরা জানে সকাল সার্থক তো জীবন সার্থক।

টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ছাত্রছাত্রী নিয়মিত সকালে উঠে তারা দেরিতে উঠা ছাত্রদের তুলনায় পরীক্ষায় ভালো স্কোর করে। আমাদের শৈশবে আমরা মুখস্ত করার বিষয়গুলো পড়ার রজনী ফজরের নীরব সময়টাকেই বেছে নিতাম।সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও ভোরে ওঠার উপকারিতা স্বীকার করেছে। তারা দেখেছে, যারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাদের চরিত্রের সব ইতিবাচক পারসোনালিটির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

আরও পড়ুন-

জাহান্নামীদের অধিকাংশই নারী-এ হাদীসটির তাৎপর্য কি ?

ফজরের সময়টা সর্বোত্তম সময় আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা লাভের। সময় মতো সালাত আদায়ের মাধ্যমে নফসকে আমরা পরাজিত করি। ফজরের সালাত আদায় আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নফসের শিকল থেকে। এটি একটি বড় এবং পবিত্র যুদ্ধ নিজের বিবেকের ও নফসের বিরুদ্ধে। ফজরের সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা নিজেদের অলসতা ও অসচেতনতা এবং অবসন্নতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি।

হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পেছনের অংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়- তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি শুয়ে থাকো। এরপর সে জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করলে একটি গিঁট খুলে যায়। পরে অজুু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। এরপর সালাত আদায় করলে বাকিটিও খুলে যায়। তখন তার সকাল হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য নিয়ে’ (বুখারি ১১৪২)।

ফজরের সালাতের সময়টা মেডিটেটিভ এক্সারসাইজের জন্যও উৎকৃষ্ট সময়। চারপাশের প্রশান্ত পরিবেশ সালাতে খুশুখুজু বজায় রাখতে সাহায্য করে। যা আমাদের দেহ ও মনকে সারা দিন অধ্যাত্মিক শক্তিতে ভরিয়ে রাখে। মেডিটেশন বা ধ্যানের শারীরিক ও আত্মিক সুফল অনেক। কিন্তু মুসলিমরা সালাত আদায়ের মাধ্যমে মেডিটেশনের সর্বোচ্চ সুফল পেতে পারে। ইসলামিক মেডিটেশনকে ‘মোরাকাবা’ বলা হয়। আল্লাহর স্মরণে তখন শরীর ও মন একাত্ম হয়ে থাকে। হেদায়াত, শোকর আর রবের দাসত্বের মহিমায় হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। যার ফলে আত্মিক প্রশান্তিতে দেহ ও মন ভরে থাকে।

আল্লাহ “ফজর” ও “আসর” নামে দু’টি পৃথক সুরাই নাজিল করেছেন।দুই ওয়াক্তই দিবসের প্রান্ত,একটি রজনীর আরেকটি দিনের।মজার বিষয় হলো,দু’ওয়াক্তের নামেই আল্লাহ কসম করেছেন। وَ الۡفَجۡرِ শপথ ফজরের, وَ الۡعَصۡرِ ۙ আসর বা মহাকালের শপথ। ফজর বলতে প্রত্যেক দিনের প্রভাতকাল উদ্দেশ্য। কারণ, প্রভাতকাল বিশ্বে এক মহাবিপ্লব আনয়ন করে এবং আল্লাহ্ তা’আলার অপার কুদরতের দিকে পথ প্রদর্শন করে।

দিনের প্রথম সালাত ফজর আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বারাকাহ ও নূর লাভ করি যা ভোরের সময়টাতেই শুধু পাওয়া যায়। যা আমাদের বিবেকের উদাসীনতা ও অসচেতনতা থেকে রক্ষা করে। ফজরের সালাত মুমিনদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ একটি ব্যালান্স ও হেলদি লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হওয়ার। আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়ার এই মহৎ সুযোগ মুমিনদের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভে সাহায্য করে। আল্লাহ আমাদের সালাত আদায়ের মাধ্যমে বারাকাহ লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-

[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।

মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে।  আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।

আরও পড়ুন