Ads

নৌযানে মসুলমানদের অবদান (১ম পর্ব)

আল মারুফ

সময়টা ঠিক ওমর (রা) এর শাসনামল।তাঁর নেতৃত্বে মসুলমানরা পারস্য উপসাগর থেকে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অতিক্রম করে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমির একক অধিপতি ছিলেন। যারা কিনা মরুভূমির প্রতিটি বালুকার সাথে পরিচিত।যাদের ঘোড়ার পদচারণায় খুরের আঘাতে সৃষ্ট ধুলিঝড় দিগন্তে আঁধার নামাতো। কিন্তু মজার বিষয় হলো! তখনো তারা সমুদ্রের উর্মির সাথে, জলতরঙ্গের সাথে মোটেও পরিচিত ছিলেন না।

হিজাজ অধিবাসীর বীরত্বগাঁথা কাহিনী আমাদের সকলের জানা। ঘোড়ায় চেপে মরুপথে দিগন্ত বিলীন যেন তাদের মামুলি ব্যাপার। ইসলাম পূর্ব ও প্রথমিক যুগে মরুপথ তাদের যতটা চেনা ঠিক ততটাই অচেনা সমুদ্রপথ। জলপথে তারা মোটেও অভ্যস্ত ছিলেন না। এমন কী সমুদ্রপথে তারা ভীষণ ভয় পেতেন।

যখন মিশর ও সিরিয়ার উপকুল ইসলামী পতাকার অধিনে ঠিক তখন মসুলমানরা প্রথম রোমানদের যুদ্ধ জাহাজ ও সমুদ্র যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করলেন এবং সাথে সাথে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার স্বার্থে নৌ-বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এগিয়ে এলেন আলা ইবন আলহাযরমী। তিনি ওমর (রা) এর অধীনে বাহরায়নের শাসনকর্তা ছিলেন।

আলা ইবনে আলহাযারমী’র দৃঢ় ইচ্ছা ছিলো ইরানের উপকুলবর্তী এলাকাগুলোকে ইসালমী পতাকার অধীনে আনা। কিন্তু তার এ ইচ্ছার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় পারস্য উপসাগর, কারণ বাহরাইন থেকে পারস্য উপসাগর ব্যতীত ইরান উপকুলে সৈন্য প্রেরণের আর কোনো গন্তব্য ছিলো না।তাই তিনি নৌ-পথেই সৈন্য পরিচালনা করেন।কিন্তু তাদের এ পথে অনভিজ্ঞতার কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ও পরাজিত হতে হয়।

লক্ষণীয়, আলা ইবনে আলহাযারমী এই যুদ্ধের জন্য খলিফা হযতর উমর (রা) এর অনুমতি নেন নি। হযতর ওমর রা তাঁর এই সেচ্ছাচারিতার জন্য প্রচন্ড রাগান্বিত হন এবং আলা ইবনে আলহাযরমীকে সরিয়ে কুফার শাসনকর্তা সাদ ইবনে আবি ওক্কাস (রা) কে স্থলাভিষিক্ত করেন এবং সাথে সাথে অপরাপর গভার্নরদের প্রতি এ বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কেননা তখন তিনি স্থল পথ আরো শক্তিশালী করার পক্ষে মনোনিবেশ করে ছিলেন। তাঁর মতে তখনো নৌ বাহিনী গঠনের সময় হয়নি।

হযরত মুয়াবিয়া (রা) খলিফাতুল মুসলিমিন ওমর (রা) এর অধিনে সিরিয়া ও পশ্চিম জর্দান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন।তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও দক্ষ সমর নায়ক। রোমান বাহিনীর সাথে প্রায় তাকে মোকাবেলা করতে হতো। তিনি উপলব্ধি করলেন রোমানদের মোকাবেলার জন্য নৌ-বাহিনী খুবই অপরিহার্য। আর তাই তিনি নৌ-বাহিনী গঠনের জন্য হযরত ওমর রা এর অনুমতি চাইলেন।

হযতর ওমর রা মিশরের গভর্নর আমর ইবনুল আমের নিকট সমুদ্র ভ্রমণ সম্পর্কে জানতে চেয়ে একটি চিঠি লিখলেন।তিনি প্রতিত্তরে যে কথাগুলো বলেছিলেন–

“আমিরুল মুমিনীন! সমুদ্র যেন আল্লাহর এক মস্তবড় সৃষ্টি।তার উপর আল্লাহর এক ক্ষুদ্র সৃষ্টি মানুষ আরোহণ করে। সমুদ্রে বসে আকাশ আর পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন হয়, তাহলে পিলে চমকে উঠে।আর সমুদ্র যদি উর্মি মুখর হয় তাহলে মুর্ছা যাওয়ার অবস্থা দাঁড়ায়।এরুপ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্দেহ হ্রাস পায় এবং একীন বেড়ে যায়।মানুষের সমুদ্র যাত্রারম্ভ অবস্থা এরুপঃ একটি ভাসমান কাঠখন্ডের ওপর যেনো একটি পতঙ্গ উড়ে পড়লো।কাঠখন্ডটি যদি উল্টে যায়,তাহলে পতঙ্গটি ডুবে যাবে আর কান্ঠখন্ডটি সঠিকভাবে কিনারে পৌছলে পতঙ্গটি সোল্লাসে উড়ে যাবে”

আমর ইবনুল আমের এই উত্তর পেয়ে খলিফা ওমর রাঃ আমিরে মুয়াবিয়া রাঃকে পত্রযোগে সিদ্ধান্ত জানান —

“আমি সে সত্তার শপথ করে বলছি, যিনি হযরত মুহাম্মাদ (সা) কে সত্য নবিরুপে প্রেরণ করেছেন,আমি সমুদ্র অভিযানে একজন মসুলমানকেও প্রেরণ করবো না ”

হযরত আমিরে মুয়াবিয়া একজন নাছোড় বন্দা,তিনি পরবর্তীতে হযরত উসমান রা এর খিলাফাত আসলে পুনরায় প্রস্তাব করেন।অবশেষে হযতর উসমান রা শর্তসাপেক্ষে তা মঞ্জুর করেন। আর তা হলো যারা সমুদ্র যুদ্ধে সেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক কেবল তাদেরই নেওয়া যাবে কাউকে জোর করা যাবে না।

অবশেষে হযরত মুয়াবিয়া রা সব শর্ত মেনে নিয়ে ২৮ হিজরিতে এ বাহিনীর গোড়াপত্তন করেন।

নবগঠিত নৌবহর নিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক অভিযান প্ররিচালনা করেন সাইপ্রাসে।সাইপ্রাস বাসীরা ৭২০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ  এর সাথে সন্ধি চুক্তি করেন।প্রথম অভিযান সফলতায় মুসলিম বাহিনীর উদ্দিপনা বহুগুন বেড়ে যায়।

উল্লেখ্য, সেদিন থেকে পৃথিবীতে বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত নৌ-পথে তারা এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি রুপে আত্মপ্রকাশ করে।

(চলবে)

লেখকঃ সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

 

আরও পড়ুন