।। জামান শামস ।।
এ এক অবর্ণনীয় বঞ্ছনার ইতিহাসই বটে। ১৯৮৪ সালে প্রথম ব্যাচ প্রবেশানারী অফিসার হিসাবে ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করি। কোন আনুকুল্যে নয় কমপিটিটিভ লিখিত ও সামনা সামনি মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হই। বলা হয়ে থাকে জামায়াত শিবির করলেই ইসলামী ব্যাংকে চাকুরী পাওয়া যায়। না,এটি সম্পূর্ণ একটি ভূল ধারনা। তিন হাজারের বেশী প্রতিযোগী পরীক্ষা দেয়, তার মধ্যে আঠাশ জনকে প্রথম ব্যাচে নির্বাচিত করে।
একথা অনস্বীকার্য যে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিংসহ ইসলামের মৌলিক বিষয় ও আধূনিক বিশ্ব ব্যবস্থার উপর যাদের পড়াশোনা ছিলো তারাই পরীক্ষায় পাশ করে।এমনকি মৌখিক পরীক্ষায়ও আমার সকল প্রশ্ন রাজনীতি বিজ্ঞান সম্পর্কিত ছিলো। এরপর লোকাল অফিস,মতিঝিল ঢাকাতে যোগদান করি। কয়েক মাস পর চট্টগ্রাম আসি একমাত্র শাখা আগ্রাবাদ বানিজ্যিক এলাকায়। তখনই শুধু নয়,এখনো আপনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জরীপ চালাতে পারেন যে কারা কারা যুগোপযোগী ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ। এক কথায় জবাব হলো-যারা ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত। লেখাপড়া এদের অন্যতম সাংগঠনিক কাজ। নিয়মিত তার হিসাব রাখতে হয় এবং উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের তা জানাতে হয়। ছাত্রশিবির করলে ভালো ছাত্র হবেই।
আমি সংগঠন করেছি ১৯৭৬-৮৪।ব্যাংকে প্রবেশের পর আর সক্রিয় থাকতে পারিনি।ব্যাংকের ব্যস্ততায় জীবনের বহু কিছু বিসর্জন দিয়েছি। যেখানে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে তা যথাসাধ্য পূর্ণ আমানতদারী ও ইনসাফের সাথে পালন করেছি। দিন রাত বলে কিছু তফাৎ করিনি এমনকি পরিবারকেও সময় দিতে পারিনি। মনে পড়ে, সরকারী ছুটির দিনগুলোতেও নিয়মিত অফিস করতে হয়েছে।লেনদেন না থাকলেও বুকস অব একাউন্টস এর ব্যালাঞ্চিংগুলো ছুটির দিনে করা হতো।এখনকার মতো তখন তো ডিজিট্যাল সিস্টেম ছিলোনা,সব কাজ হাতে আর ব্রেনে করতে হতো।
বিভিন্ন পজিশনে শাখা ও বিভাগ মিলে ২০১৯ এর ১০ জুলাই অবধি আমার ব্যাংকিং পেশার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর পাঁচ মাস পাঁচ দিন। নিয়ম মতে ষাট বছর বয়সে রিটায়ার্ড হলে আমার প্রস্থানের তারিখ হতো ২০১৭ সালের ২৯ আগষ্ট। এর মধ্যে ৫ জানুয়ারী ২০১৭ ঘোয়েন্দা সংস্থার সমর্থনে ব্যাংকের মালিকানা বদলে যায়। শুরু হয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে নানা রকমের ষড়যন্ত্র। নতুন নিয়োগ পাওয়া পরিচালকগণের মধ্যে কয়েকজনের তো প্রচন্ড গাত্রদাহ ছিলো ব্যাংকের প্রতি, আমাদের মতো উচ্চপদের অফিসারদের বোর্ডরুমেই হেনস্তা করা হতো।শামীম আফজাল নামের ইফার তখনকার ডিজি তো প্রায়ই বোর্ডসভায় মারমুখী থাকতেন। তার মূখে জামায়াত শিবির জিকির সদা জারী থাকতো। পরে অবশ্য তাকে বাদ দেয়া হয়।
শামীম আফজালের কাজই ছিলো ব্যাংকের তথ্য উপাত্ত গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা। তারই প্ররোচনায় এসবি, এনএসআই,ডিজিএফআই সম্মিলিতভাবে ইসলামী ব্যাংকের পূরো জনশক্তির রাজনৈতিক আনুগত্য শিরোনামে একটি বইও প্রকাশ করে। আমরা এই বই’র নাম দিয়েছিলাম “দি ব্ল্যাক বুক” যেখানে এগারো শত জনকে তারা সরাসরি জামায়াত শিবিরের প্রোডাক্ট বলে ঘোষণা করে। এই বই ধরে ধরে পরিকল্পনা ছিলো সবাইকেই ছাটাই করা। এটি ২০১৮ সালের এপ্রিলে চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয় প্রথম ব্যক্তি হিসাবে আমাকে অপসারনের মাধ্যমে। অপসারনে আমার সাথে আমীরুল ইসলাম ছিলো দ্বিতীয়। তার অপরাধ ছিলো তার ভাই শামসুল ইসলাম জামায়াতের প্রথম সারির নেতা ও সাবেক সাংসদ।
আমাদের ৩ এপ্রিল ২০১৮ অপরাহ্নে বোর্ডের চেয়ারম্যান আরাস্ত খান স্যার তার চেম্বারে ডাকেন। সেখানে পূর্ব থেকেই তখনকার ইসি চেয়ারম্যান মে.জে. আবদুল মতিন স্যার ও এমডি মাহবুব আলম উপস্থিত ছিলেন। বুঝে গিয়েছিলাম যে উনারা আমাকে কোন দুঃসংবাদ দিতে ডেকেছেন। উনারা কে আমাকে বিষয়টা বলবেন তা নিয়ে ইতস্তত করছিলেন।আমি বললাম, “স্যার সমস্যা নেই।বলেই ফেলুন!”চেয়ারমযান স্যার বললেন,আমরা গত তিন ঘন্টা ধরে বহু দেন দরবার করেছি কিন্ত আর পারিনি।আপনাদের আর রাখতে পারছি না। সরি। এরপর ঐ রুমেই আমাকে ও আমীরুল ইসলামকে টারমিনেশান লেটার ধরিয়ে দেওয়া হয়।
কি করাণে চাকুরি থেকে অব্যাহতি তা চিঠিতে উল্লেখ ছিলোনা।আমরা পরে জেনেছি-ডিজিএফআই ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে লিখেছে,” গোয়েন্দা সুত্রে জানা যায় যে জনাব শামসুজ্জামান জামায়াতের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত।তিনি নিয়মিত জামায়াতকে অর্থ সাহায্য করেন।তিনি জামায়াতের লোকদের জ্ঞানগত প্রশিক্ষণও দেন। সুতরাং অনতিবিলম্বে তাকে চাকুরী হতে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।”
এঘটনার পর তিনজন ডিএমডি যথাক্রমে মো. হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া, আবদুস সাদেক ভূঁইয়া ও মো. মোহন মিয়া কে ডেকে নিয়ে এমডি স্যার বলে দেন যে আপনারা এখনই স্বেচ্ছায় রিজাইন করেন,নতুবা আপনাদেরও টার্মিনেট করা হবে। উনারা সকলেই সেদিনই রিজাইন করতে বাধ্য হোন। পরদিন ৫ এপ্রিল ২০১৮ বাংলা ট্রিবিউনে লিখে…
-কোট-
ইসলামী ব্যাংকের তিন ডিএমডিসহ পাঁচজনকে অপসারণ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই পাঁচ ব্যক্তি পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. শামসুজ্জামান, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া, আবদুস সাদেক ভূঁইয়া ও মো. মোহন মিয়া এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আমিরুল ইসলাম।
একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকে যে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছিল, এটি তারই ধারাবাহিকতা।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তিনজন ডিএমডিসহ পাঁচজনের পদত্যাগ পত্র পেয়েছি। তারা নিজেরাই পদত্যাগ করেছেন। কোনও চাপ দিয়ে কাউকে পদত্যাগ করানো হয়নি।’
ইসলামী ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ২৯ মার্চ ব্যাংকের বোর্ড সভায় এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা হয়। পরে ৩ এপ্রিল মো. শামসুজ্জামানসহ দুইজনকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। বৃহস্পতিবার (৫ এপ্রিল) বাকি তিন ডিএমডিকে পদত্যাগ করতে বলা হলে তারা পদত্যাগ করেন।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন আসে। ব্যাংকের তৎকালীন এমডি আব্দুল মান্নানকে অপসারণের মধ্য দিয়ে শুরু, এরপর ব্যাংকে যুক্ত হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানসহ নতুন নেতৃত্ব। এর মধ্য দিয়ে ব্যাংকটিকে জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তকরণ শুরু হয়।
-আনকোট
আমার বিন্দুমাত্র এতে চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটেনি। চেয়ারম্যান স্যারের চেম্বারে চিঠি নিয়ে বলেছিলাম, স্যার আল্লাহ আমাদের যথাযথ পুরস্কার দিয়েছেন। য়ে নীতি ও আদর্শের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং কে চাকুরী হিসাবে না নিয়ে ইবাদত হিসাবে নিয়েছিলাম সে নীতিরই বরং জয় হয়েছে। বলাবাহুল্য ২০১৭ সালের ২৯ আগষ্ট আমি নিয়মিত অবসরে যাবারই ছিলাম কিন্ত আমাকে আরো একবছর প্রাথমিভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। পরিবর্তিত বোর্ড আমার পারফরমেন্স দেখে ঐ বছরই জানুয়ারী থেকে আমাকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতিও দেয়।এটা চরম মিথ্যা কথা,আমরা কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি। আমাদের দু’জনকে বাধ্যতামূলক অপসারন করা হয় আর তিনজনকে ডেকে নিয়ে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
চলবে-
[লেখকের আসল নাম মো. শামসুজ্জামান ]
লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।