।। মুহাম্মদ সাব্বির বিন জাব্বির ।।
“আমানতদার, সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক্বীন ও শহীদগণের সাথে অবস্থান করবেন”। উল্লেখিত কথাটি সাধারণ কোন ব্যক্তি বা ভূতপূর্ব কোন মনীষীর কথা নয় বা কোন গালগল্পও নয়। উক্তিটি বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাঃ এর অন্যতম একটি হাদিস। হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতে, হাদিসটি সহীহ্ অর্থাৎ বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত এসেছে। কিয়দাংশ লোক ছাড়া আমরা জীবনের পেশা হিসেবে ব্যবসাকে অধিকতর পছন্দ করি। ব্যবসা একটি স্বাধীন ও মুক্ত পেশা বটে, কিন্তু তার ফযিলত যে, কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীগণ নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে থাকবেন—আমরা হয়তো এটা অনেকেই ধারণাও করতে পারি না।
মহানবী সাঃ আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে সর্বোত্তম আদর্শ। তেমনি ব্যবসায়িক কাজেও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা ইতিহাস পাঠ করলেই হরহামেশাই দেখতে পাবো, নবীজি সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনের সাথে ব্যবসা ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল। তিনি বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক কাজে সিরিয়া, ইয়ামান, ইওয়থুপিয়াসহ আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে গমন করেছেন। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক হিসিবে ছিলেন সকলের মাঝে সমাদৃত। খুলাফায়ে রাশেদাদের প্রায় সকলেরই ব্যবসার সাথে মিতালি ছিল ঢের। মুহাজির সাহাবিদের অনেকেই ব্যবসা করতেন। বরেণ্য ইমামদেরও ব্যবসা ছিল। কিংবদন্তি ইমাম আবু হানিফা রহঃ ব্যবসা করতেন। যুগেযুগে বহু স্বনামধন্য ধনকুবের আলেম এ পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা এব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে বলেন,
“এমন বহু লোক রয়েছে, ব্যবসা ও কেনাবেচা যাদের আল্লাহর স্মরণ, সালাত কায়েম ও জাকাত আদায় থেকে বিরত রাখতে পারে না।” [ সুরা আন নূর, আয়াত: ৩৭ ]
আমাদের প্রিয় নবীজি সাঃ বলেন, “রিজিকের ১০ অংশের ৯ অংশই ব্যবসায়–বাণিজ্যের মধ্যে এবং এক অংশ গবাদি পশুর কাজে নিহিত।’ [ আল জামিউস সাগির, হাদিস : ৩২৮১ ]
নবীজি আরো বলেন, “উত্তম উপার্জন হলো, একজন মানুষের তার নিজের হাতের উপার্জন এবং সব ধরনের বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের উপার্জন ”।
অতএব আমরা কোন দুর্বোধ্যতা ছাড়াই বুঝতে পারি, ইসলামী শরীয়তে ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম ও তার একটি উঁচু স্থান রয়েছে। তবে প্রতিটি শরয়ী বিধানের যেমন ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক আছে, ঠিক এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পৃথিবীতে তাঁর একমাত্র ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্য প্রেরণ করেছেন। তাই মুমিন জীবনের প্রতিটি কাজ তাঁর সন্তুষ্টির নিমিত্তেই হতে হবে এবং তাই হওয়া উচিত। ব্যবসাও শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাও শরয়ীসিদ্ধ পদ্ধতিতে হওয়া আবশ্যক।
ইসলামের আলোকে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলনীতি
ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত মৌলিকভাবে দু’টি মূলনীতির উপর নির্ভর করে—
প্রথমত: ব্যবসায়িক পণ্য, উপাদান ও তার সাথে সম্পর্কিত বিষয় বৈধ হতে হবে। অর্থাৎ মদ, জুয়া, সুদ-ঘোষ ও ইত্যাদির সাথে জড়িত হওয়া বৈধ নয়।
দ্বিতীয়ত: ব্যবসা-বাণিজ্যের পন্থা বা পদ্ধতি বৈধ হওয়া। অর্থাৎ একাজে ধোঁকা, মিথ্যা শপথ, ভেজাল ইত্যাদি থাকতে পারবে না। পদ্ধতি যদি ইসলাম পরিপন্থী হয় তাহলে সে ব্যবসা শরীয়তসিদ্ধ ব্যবসা হিসেবে গণ্য হবে না। এ সংক্রান্ত আরও বেশ কিছু দিক আছে যেগুলো নিচে উল্লেখ করা হল—
আরও পড়ুন-
(ক) ব্যবসা-বাণিজ্যে ধোঁকা দেওয়া যাবে না
ব্যবসা-বাণিজ্যে ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি সম্পূর্ণ হারাম। অর্থাৎ পণ্য-দ্রব্যে ভেজাল, ভালো পণ্যের সঙ্গে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ , পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা ইত্যাদি যাবতীয় ধরনের প্রতারণা ইসলামে হারাম। জগতবিখ্যাত গ্রন্থ সহীহ মুসলিমের ১০২ নং হাদিসে এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে,
“একদিন নবীজি সাঃ বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার ( ব্যবসায়ী) পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভিতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভিজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে খাবারের পন্যের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসুল সা: বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? “যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়”।
এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, রাসূল সা: ধোঁকাবাজকে তার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত মনে করেননি। অবিসংবাদিত বরেণ্য ইমাম আল্লামা নববী রহিমাহুল্লাহ বিখ্যাত গ্রন্থ সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় বলেন,
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর বাণী “ যে ধো্ঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয় ” দ্বারা বুঝানো হয়েছে—আমরা যে হেদায়েত পেয়েছি, যে জ্ঞান ও আমল অনুসরণ করি তারা তা করে না। এখানে আমরা সহজেই বুঝতে পারলাম, ব্যবসা বাণিজ্যে ধোঁকা দেওয়া হারাম।
(খ) রিবা বা সুদ মেশানো যাবে না
রিবা বা সুদ মেশানো যাবে না । আল্লাহ তাআলা বলেন,আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ করেছেন, আর সুদকে করেছেন নিষিদ্ধ।’ [ সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৭৫ ] সুতরাং ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সুদের বিন্দু পরিমাণ সম্পর্ক থাকা শরীয়ত পরিপন্থী এবং তা হারাম। সুদের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তে কঠোর হুঁশিয়ারি ও ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা এসেছে। এমন কি আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে এরশাদ করেছেন—
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকাওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যদি তোমরা তা না কর, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শোন” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৮-২৭৯]
তাই, ব্যবসাকে হালাল রাখার জন্য সুদ বর্জন করা আবশ্যক।
আরও পড়ুন-
( গ) মজুদদারি করা যাবে না
মজুদদারির ব্যাপারেও বারণ করা হয়েছে । রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যবসায়ী পণ্য আবদ্ধ ও স্তূপ করে সে গুনাহগার।’ [ সহিহ মুসলিম : ১৬০৫ ]
( ঘ) ওজনে কম দেওয়া অবৈধ
ওজনে কম দেওয়া বৈধ নয় ।মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা ওজনে কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে কিয়ামতের দিবসে, যে দিন সব মানুষ দাঁড়াবে মহান প্রতিপালকের সামনে?। [ সুরা মুতাফ্ফিফিন ১-৬ ]
ওজনে কম দিয়ে ক্রেতাকে ঠকানো যেন আমাদের দেশে একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে ও কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। একটু ভাবুন, মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের সাথে প্রতারণা করে কিভাবে আপনি কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তায়ালার সামনে দাঁড়াবেন, যেখানে দুনিয়াতে আপনি অনু পরিমাণ ভালো কাজ করে থাকলেও দেখানো হবে পক্ষান্তরে অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করে থাকলেও তা প্রকাশ করা হবে!!
(ঙ) ব্যবসা-বাণিজ্যে মিথ্যা শপথ করা অবৈধ
আবু যার ( রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিবসে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। তাদেরকে ক্ষমাও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসুল তারা কারা? তারা তো বড় বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত। রাসুলুল্লাহ সা: বলেন, তারা হলো অনুগ্রহ করর পর তা প্রকাশকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী। [ সহি মুসলিম: ২৪৩ ]
( চ) সংশয়পূর্ণ লেনদেন থেকেও বিরত থাকা
সংশয়পূর্ণ লেনদেন থেকেও বিরত থাকা। যদি কোন ব্যবসার ক্ষেত্রে এমনটা হয় যে, হারামের কোন সম্ভাবনা ভবিষ্যতে হতে পারে তাহলে সেটা থেকেও বিরত থাকতে হবে। রাসূল সা: বলেছেন—
হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। আর এ উভয়ের মধ্যে এমন অনেক সন্দেহভাজন বিষয় আছে, যে ব্যাপারে অনেক মানুষই এগুলো হালাল, কি হারাম- এ বিষয়ে অবগত নয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় হতে বিরত থাকবে, তার দীন ও মান-মর্যাদা পুত-পবিত্র থাকবে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহে পতিত থাকবে, সে সহসাই হারামে জড়িয়ে পড়বে।[ সহীহ : বুখারী ৫২, মুসলিম ১৫৯৯ ]
আরও পড়ুন-
( ছ ) ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কারো ক্ষতি না করা
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কারো ক্ষতি করাও বৈধ নয়। রাসূল সা: বলেন—“নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়”।
( জ) নিজে ঠকা অথবা অন্যকে ঠকানো যাবে না
ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্যকে একবারেই ঠকানো যাবে না । ঐরকম নিজে ঠকছে কিনা সেটাও খেয়াল রাখতে হবে ।
রাসূল সা: বলেন, “যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয় করবে, তখন তুমি বলে দিবে যে কোনো প্রতারণা বা ঠকানোর দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিনদিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার রয়েছে”।
প্রতিটি ব্যবসায়ির উচিত ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি ও বিধি-বিধান অনুযায়ী সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। যেহেতু মুমিনের প্রতিটি কাজে আল্লাহ তায়ালার জন্য হওয়া উচিত সেহেতু এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যই ঘটা কাম্য নয়। এ পথ থেকে পদস্খলন ঘটলে আল্লাহর আদালতে আসামি হিসেবে দাঁড়াতে হবে এবং শাস্তির আওতায় পড়তে হবে।
রাসুল সা: বলেন, “ অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কিয়ামতের দিন পাপী হিসেবেই উপস্থিত করা হবে। তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎ কর্ম করে ও সত্য কথা বলে, তাকে ছাড়া”।[ তিরমিজি হাদিস না ১২১০]
আমাদের প্রতিটি কাজ মহান রবের জন্য হওয়া উচিত এবং তাই হোক বিতৌফী কিল্লাহ।
লেখক: মুহাম্মদ সাব্বির বিন জাব্বির, শিক্ষার্থী, মাদ্রাসাতুল হাদিস নাজির বাজার
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।