।। জামান শামস ।।
গত ১১ এপ্রিল ভিয়েতনামের একটি আদালত ট্রুং মাই ল্যান নামের এক ব্যবসায়ীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। বিগত ১১ বছর ধরে দেশটির একটি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার জালিয়াতি করার দায়ে তাঁকে এই সাজা দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে চার হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। ওই মামলার সব আসামিকেই দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ভিয়েতনামের আইনে কোনো ব্যাংকে ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার যে বিধি-নিষেধ রয়েছে তার তোয়াক্কা না করে ট্রুং মাই ল্যান শত শত শেল কোম্পানি এবং তাঁর প্রক্সি হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিদের মাধ্যমে কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হয়েছিলেন। নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেসব শেল কোম্পানির নেটওয়ার্কে শত শত ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিতেন। এসব ঋণের ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাই করা হতো না, ঘুষের বিনিময়ে অনুমোদন দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়ায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে এবং এ জন্য একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ট্রুংকে কোনো খুন করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। ব্যাংকের অর্থ বা ঋণ জালিয়াতি করার কারণে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ রকম ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটে আসছে। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে নয়-ছয় খেলা বাংলাদেশে অনেকটা রুটিন ঘটনা। এখানে রাজনৈতিক পরিচয়ের ছদ্মাবরণে ঋণ খেলাপী হয়,খেলাপী হয় ব্যবসা প্রতিকুল পরিবেশ হলে, আরো স্পষ্টভাবে মহামারী, সাইক্লোন,বন্যা ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঋণ খেলাপী হয়। আবার ব্যাংকের টাকাকে মেরে দিবার অভ্যাসের কারণেও ঋণ পরিশোধ করেনা।
পনেরো বছরে আওয়ামী লীগের অব্যাহত দুঃশাসনের ফলে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা আর্থিক চিত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। তিন মাসেই ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ গত মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক আজ বৃহস্পতিবার এই তথ্য সাংবাদিকদের জানিয়েছে।দেশে এর আগে খেলাপি ঋণ বেড়ে কখনো এতটা হয়নি।
আরও পড়ুন-
ইসলামী ব্যাংকে শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিতকল্পে শরীয়াহ কমিটির ভূমিকা ।। ১ম পর্ব
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। পাশাপাশি খেলাপি হওয়া সুদ যুক্ত হওয়ার কারণেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোতে তদারকি বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক কাজ করছে। এসব কথা বেশুমার বলা হয়েছে,অনেকটাই গতানুগতিক। সুদ যুক্ত হয়ে খেলাপী বেড়েছে এমন মন্তব্যকারী তো ব্যাংকারই না,সে লোক আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। আসল কথা লুকাতে লুকাতে তাদের মুখ এখন বন্ধ। তাদের সাপোর্ট আর সহায়তার কারণেই আজ ঋণের এমন দুর্দশা। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ঋণের এক টাকা ফেরত না দিয়েও ঋণমান ঠিক রাখা যায় এবং নতুন ঋণ পাওয়া যায় কেবলমাত্র তথাকথিত নীতি সহায়তার নামে। গত পনেরো বছরে ,বুকে হাত দিয়ে বলুন, কতবার এমন আকাম করেছেন ?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ফলে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে সরকারি–বেসরকারি, বিদেশি ও বিশেষায়িত—সব ধরনের ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে গতি ফিরিয়ে আনতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা সেই পথে না গিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখিয়ে সবাইকে কাগুজে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে আর্থিক সংস্থান না করেই সরকার যে বিশাল অঙ্কের বাজেট করেছে, তার জন্য ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতের ওপরই নির্ভর করতে হবে। সরকার ব্যাংকগুলো থেকে বাজেট–ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করলে বেসরকারি খাত ঋণ থেকে বঞ্চিত হবে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যে গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বরং গত ১৫ বছরে বেসরকারি ব্যাংকমালিক ও ঋণখেলাপিদের একের পর এক অন্যায্য ও অন্যায় সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ছাড় দেওয়া হয়েছে।
২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা বলা হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।যদিও অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা ব্যাংকিং খাতের এই অবস্থার জন্য সরকারের ভুল নীতিকেই দায়ী করেছেন।
আরও পড়ুন-
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যিনি গতকালই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি গত মাসে এক সভায় বলেছেন,
‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে ১১ শতাংশ। বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর্থিক খাত বেশি দিন চলতে পারে না। তদারকির অভাবে আমাদের মুদ্রাবাজার হাতছাড়া হয়েছে, মূল্যস্ফীতিও হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে।’ ঋণ আদায় না করেই ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখানোকে আহসান এইচ মনসুর ‘ঘরের থালাবাটি বেচে কোরমা-পোলাও খাওয়া’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সুতরাং আর কোন ছাড় নয়। ব্যাংকের আমানত জনগণের টাকা। ঋণ নিলে তা সময়মতো ফেরত দিতেই হবে, কোন বাহানা আর নয়। রাজনৈতিক সরকারের আমল আমরা দেখেছি কোন নীতিই সেখানে কাজ করে না। এবার আমরা একটি তদারকি সরকার পেয়েছি যেখানে অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর দুজনই ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। ভিয়েতনামের মতো মৃত্যুদন্ড না দিন অন্তত ঋণ খেলাপীকে আর কোন ছাড় দিবেন না,তাদের পাসপোর্ট বাতিল করুন,বিদেশ যাওয়া বাতিল হবে। তাদের সম্পদ নিলামে তুলুন। বিদ্যুৎ,গ্যাস, পানি ও ফোনের মতো জরুরী সেবা বন্ধ করে দিন। কোন ফোরামের সদস্য হলে সদস্যপদ বাতিল করুন। তাকে সামাজিকভাবে বয়কটের আইন করুন। তার সংগে যেন কেউ কোনদিন আত্মীয়তা করতে না পারে। তার জীবনযাত্রার সীমানা সংক্ষেপ করে দিন। বাসা-বাড়ী ও গাড়ীর সীমা বেঁধে দিন। তার সন্তানদের ভালো স্কুলে যাবার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করুন। এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এবার শুরু হোক,দেখুন তার ফলাফল কত দীর্ঘ হয়।
লেখকঃ কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।