।। প্রফেসর ড মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন ।।
উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে চাকরির অপেক্ষা না করে দ্রুত একটি ব্যবসা শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ের চাকরির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনেকের জন্যেই কঠিন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চাকরির বাজার অনেক সংকীর্ণ। এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে থাকি, তবে আমাদের মূল্যবান সময় ও সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। তাই চাকরির পরিবর্তে ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসায়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মূল চাবিকাঠি হলো নতুন কিছু করার সাহস, সঠিক পরিকল্পনা এবং নিরলস পরিশ্রম। প্রথমেই জানতে হবে কোন ধরনের ব্যবসা আপনি শুরু করতে চান। যেহেতু ক্ষুদ্র ব্যবসা হলো একটি ছোট আকারে শুরু করার উদ্যোগ, তাই মূলধনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তা করা সম্ভব। অনলাইন ব্যবসা এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে, কারণ এটি কম খরচে শুরু করা যায় এবং অনলাইনের বিস্তৃত বাজারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করা সম্ভব। আপনার বন্ধুরা যখন চাকরির জন্য অপেক্ষা করবে, আপনি তখন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের উদ্যোগকে আরও বড় করে তুলবেন।
উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হওয়ার জন্য, প্রথমে একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা গঠন করা দরকার। ব্যবসার ধরন এবং এর পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ এবং ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে আসতে পারে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে—ব্যবসা পরিচালনার কৌশল, বাজার বিশ্লেষণ, পণ্যের গুণমান এবং বিপণনের পদ্ধতি ইত্যাদি। এ ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থিতি এবং গ্রাহকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উদ্যোক্তা হওয়ার সময় একা নয়, বরং সঠিক দল গঠন করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজের বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে একটি দল গঠন করতে পারেন যারা একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক। দলগত কাজের মাধ্যমে একটি ব্যবসার সম্ভাবনা আরও বাড়ে। পাশাপাশি, একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আরও কিছু মূলনীতি মেনে চলা উচিত। যেমন, যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দক্ষতা অর্জন, নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, এবং ক্রমাগত শিখতে থাকা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সমাজ বা আশেপাশের মানুষেরা কী বলছে তা নিয়ে চিন্তা না করা। অনেকেই আপনাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করবে । কিন্তু তাদের কথায় কান না দিয়ে আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। সফল হতে হলে প্রচুর বাধা আসবে, কিন্তু আপনি যদি ধারাবাহিকভাবে পরিশ্রম করে যান এবং আপনার লক্ষ্য স্থির রাখেন, তাহলে একদিন অবশ্যই সফলতা আসবে। ইনশাআল্লাহ, আপনার উদ্যোগের সফলতা তখন এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, আপনার বন্ধুরা তখন আপনার কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদন করবে।
তাই চাকরির অপেক্ষায় সময় নষ্ট না করে, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করা বর্তমান যুগে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যারা নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে চায়, তাদের উচিত এখন থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া। এই প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও পদক্ষেপ নিচে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:
১. মানসিক প্রস্তুতি:
উদ্যোক্তা হওয়ার আগে আপনার মানসিকতা তৈরি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন উদ্যোগ শুরু করবেন, তখন চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির মুখোমুখি হবেন। কাজেই প্রথমেই মনে করতে হবে যে, যেকোনো সাফল্যের পেছনে পরিশ্রম ও ধৈর্যের প্রয়োজন। সফল উদ্যোক্তা হতে গেলে ধৈর্য ধরে চালিয়ে যেতে হবে এবং মাঝে মাঝে ব্যর্থতার মুখোমুখি হলেও তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পাশাপাশি, আশেপাশের মানুষজন কী বলবে তা নিয়ে না ভেবে নিজের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই সঠিক পথ।
২. প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন:
বিজনেস শুরুর আগে আপনাকে সেই ক্ষেত্র সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হবে। আপনি যে ব্যবসা করতে চান তার বাজার, প্রতিযোগিতা, সম্ভাবনা এবং ক্রেতাদের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এজন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কর্মশালা এবং অনলাইন কোর্সে অংশ নিতে পারেন। উদ্যোক্তাদের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউশন রয়েছে যেখানে ব্যবসা শুরুর কৌশল, মার্কেটিং, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এবং টিম বিল্ডিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
যেকোনো ব্যবসা শুরুর আগে অর্থনীতির প্রাথমিক ধারণা যেমন বাজেট তৈরি করা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা, এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা শেখা জরুরি। এ বিষয়ে ছোটখাটো কাজ করেও শিখতে পারেন, যেমন অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা বা ফ্রিল্যান্সিং করা, যেখানে আপনার সরাসরি ক্রেতার সাথে যোগাযোগের সুযোগ থাকে।
আরও পড়ুন-
৩. দল গঠন ও নেটওয়ার্কিং:
বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, একজন উদ্যোক্তার সাফল্য নির্ভর করে তার সহযোগী বা টিমের উপর। একা কাজ করা অনেক কঠিন, তাই যারা আপনার সাথে আগ্রহী, তাদেরকে একত্রিত করে একটা শক্তিশালী দল গঠন করুন। এই টিমের সদস্যরা যদি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ হয়, তাহলে ব্যবসা পরিচালনা করা আরও সহজ হয়। এর পাশাপাশি, বিভিন্ন উদ্যোক্তা গ্রুপ এবং নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া উচিত। একে অপরের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়া যায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সহায়তাও পাওয়া যায়।
৪. বাজার বিশ্লেষণ এবং লক্ষ্য নির্ধারণ:
যেকোনো ব্যবসার প্রথম পদক্ষেপ হল সঠিক বাজার বাছাই করা। যে পণ্য বা সেবা আপনি সরবরাহ করতে চান, তার জন্য সঠিক ক্রেতা খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য আপনি প্রথমেই বাজার বিশ্লেষণ করতে পারেন, যেমন কোন পণ্য বা সেবার চাহিদা বেশি এবং কোন এলাকায় তা প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বাজার বিশ্লেষণের পরে, আপনাকে আপনার লক্ষ্য এবং ব্যবসার উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এটি আপনাকে একটি সুসংহত এবং সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করতে সহায়তা করবে।
৫. ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করুন:
বেশিরভাগ সফল উদ্যোক্তাই ছোট থেকে শুরু করেছেন। ক্ষুদ্র আকারে ব্যবসা শুরু করার অনেক সুবিধা রয়েছে। প্রথমে সামান্য বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করুন এবং ব্যবসাটি ধীরে ধীরে বড় করুন। অনলাইনে বিক্রি করা বা সেবা প্রদান করা ছোট আকারে শুরু করার জন্য একটি ভালো উপায় হতে পারে। এতে করে ঝুঁকি কম থাকে এবং আপনি প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পান। সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে কিছু সময়ের মধ্যে তা বড় পরিসরে রূপ নিতে পারে।
৬. ধারাবাহিক শেখা ও উন্নতি:
ব্যবসার সফলতার জন্য ক্রমাগত শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি, বাজার এবং ক্রেতাদের চাহিদা সবসময় পরিবর্তিত হয়, তাই আপনাকেও সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। নতুন ট্রেন্ড, মার্কেটিং টেকনিক, এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে আপডেট থাকা জরুরি।
অন্যদিকে, ব্যর্থতা থেকে শেখার মানসিকতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো উদ্যোগে ব্যর্থও হন, তাহলে সেটিকে শেখার একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে গ্রহণ করুন এবং নতুন কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আবার শুরু করুন।
উদ্যোক্তা হিসেবে প্রস্তুতির করণীয়:
⊕ পড়াশোনা ও গবেষণা:
ব্যবসার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোতে আপনি অভিজ্ঞতা কম রাখেন সেগুলো নিয়ে গবেষণা করুন। প্রচুর বই, ব্লগ, ভিডিও এবং পডকাস্ট রয়েছে যা থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন নতুন ধারণা এবং কৌশল শেখা সম্ভব।
⊕ প্রশিক্ষণ:
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করুন। এটি আপনাকে নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে।
⊕ বিজনেস পরিকল্পনা তৈরি:
একটি কার্যকর ব্যবসা পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত যেখানে মূলধন, বাজার বিশ্লেষণ, ক্রেতার চাহিদা, এবং প্রতিযোগিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকবে।
⊕ ফিডব্যাক গ্রহণ:
ব্যবসা পরিচালনার সময়ে ক্রেতাদের থেকে নিয়মিত ফিডব্যাক সংগ্রহ করুন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী উন্নতি করুন।
⊕ নেটওয়ার্ক তৈরি:
উদ্যোক্তাদের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন উদ্যোক্তা সম্মেলন, গ্রুপ এবং ক্লাবে যোগ দিয়ে নতুন সম্পর্ক তৈরি করুন যা ভবিষ্যতে আপনার ব্যবসার সহায়ক হতে পারে।
সর্বোপরি, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য্য, এবং সঠিক প্রস্তুতি জরুরি। যখন একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করবেন, তখন ধীরে ধীরে আপনার ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে এবং একসময় তা সমাজের অনেক মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন