Ads

ক্রিমিয়াঃ এক দূর্ভাগা মুসলিম জাতির ইতিহাস

আয়েশা সিদ্দিকা

ক্রিমিয়া কৃষ্ণ সাগরের কোল ঘেষে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি রাজ্য। এর পশ্চিমে রয়েছে কৃষ্ণসাগর, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর। একদিকে ইউক্রেন এবং অন্যদিকে kerch strait দ্বারা রাশিয়া থেকে পৃথক হয়েছে।। ক্রিমিয়ার আয়তন প্রায় ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। রাজধানী সিমফারোপল। রুশ বাহিনী দেশটি দখল করার পর এই নাম দেওয়া হয়েছে।

আগে এর নাম ছিল আক মসজিদ। তাতারি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে সফেদ মসজিদ।
খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে পারস্য জাতি সাইথিয়ানরাই প্রথম ক্রিমিয়া অধিকার করে। এরপর গ্রিক, রোমান,তাতার,অটোম্যান,মঙ্গোল,রাশান,তুর্কি একে একে ভোগ করতে থাকে এই অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

তাতার মুসলিমরা প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ক্রিমিয়া শাসন করে। তাদের শাসনামলে ক্রিমিয়া হয়ে ওঠে বিপুল ঐশ্বর্যমন্ডিত ও সভ্যতা সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল।

১৪২৮ খ্রিস্টাব্দে ইউক্রেনের অধিবাসী হাজী দৌলত খান ক্রিমিয়ার মসনদে আসীন হন। ১৪৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্রিমিয়ান খানাত রাজ্য ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ক্রিমিয়ান খানাত উসমানীয়দের অনুগত ছিল। উসমানীয় শাসকরা দূর্বল হলে ক্রিমিয়ান খানরাও বিপর্যস্ত হন। ১৭৮৩ সালের ১৮ এপ্রিল রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথরিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেন। এতে ক্রিমিয়ার মুসলিমরা প্রতিবাদ জানালে শুরু হয় তাদের ওপর রুশ বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচার।

ক্রিমিয়া যুদ্ধ ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মিত্রশক্তির ( তুরস্ক, ব্রিটেন,ফ্রান্স) কাছে রাশিয়া পরাজিত হয় এবং তুরস্ক ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার নৌঘাঁটি সেভাস্তোপোল দখল করে নেয়। এ যুদ্ধের পরেই রুশরা বেশি চড়াও হতে থাকে তাতার মুসলমানদের ওপর।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লব হলে ক্রিমিয়ার মুসলিমরা জারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সমর্থন দেয়। ফলে ক্রিমিয়ার মুসলমানদের ওপর রুশদের অত্যাচার আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। সোভিয়েত নেতারা মুসলিমদের কৃষিজমি বাজেয়াপ্ত করলে ক্রিমিয়ায় দেখা দেয় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ(১৯২১-১৯২৩)। এই দূর্ভিক্ষে এক লাখ ৫০ হাজার মুসলিম অনাহারে মারা যায়।

১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। একদিকে স্টালিনের সোভিয়েত অন্যদিকে হিটলারের জার্মানি ব্যাটলগ্রাউন্ডে পরিণত হয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ।
বিশাল কৃষ্ণ সাগরের নিয়ন্ত্রণে ভৌগোলিকভাবে ক্রিমিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪১ সালে হিটলার সোভিয়েত রাশিয়াকে পরাজিত করে ক্রিমিয়া দখল করে।কিন্তু ১৯৪৪ সালে আবার জার্মানিকে হটিয়ে স্টালিনের রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে। যুদ্ধে তাতার মুসলিমদের জার্মানির পক্ষে অংশগ্রহনের মিথ্যা অভিযোগে স্টালিন তাতার মুসলিমদের ক্রিমিয়া হতে বিতাড়িত করে।

স্টালিনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান বীরপুরুষ বলা হয় কারণ তার নেতৃত্বে হিটলারের শক্তিশালি নাৎসীদের পরাজিত করা হয়েছিল। তাঁকে নিয়ে কত গল্প কবিতা রচিত হয়েছিল। এমনকি বাংলাতেও একজন লিখেছিলেন – স্টালিন তোমার নামে গর্ভিনীর সুখ প্রসব হয়। কিন্তু পরে জানা যায় স্টালিন তার দেশেই প্রায় ৫০মিলিয়ন বা ৫ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে মিথ্যা সন্দেহে বা আক্রোশের বসে।

১৯৪৪ সালে ১৮ মে তাতার মুসলমানদের সেই চরম দূর্ভোগের দিন। তাদের মালবাহী ট্রেনের নোংরা বগিতে ঠাসাঠাসি করে পাঠানো হয় অজানা গন্তব্যে। সাইবেরিয়া বা উজবেকিস্তানে নির্বাসন দেওয়া হয়। সূদীর্ঘ বিরামহীন যাত্রায় অনাহারে, অসহ্য গরমে মারা যায় প্রায় ৫০ হাজার তাতার মুসলিম। পরবর্তীতে ১৮ মে তাতাররা শোক দিবস হিসেবে পালন করে।

১৯৫৪ সালে সোভিয়েত রাশিয়া কোনো পক্ষের আবেদন ছাড়াই ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে। ১৯৪৪-১৯৪৬ পর্যন্ত নির্মূল অভিযান চলে।
১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংস নির্মূল অভিযান ও হত্যাযজ্ঞের জন্য দূঃখ প্রকাশ করে। এবং একটি আইন পাস করে যেখানে বলা হয় সোভিয়েত নাগরিক সোভিয়েত ইউনিয়নের যেকোনো অঞ্চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে পারবে। ফলে দলে দলে রাশিয়ানরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ক্রিমিয়াতে এসে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু নির্বাসিত তাতার মুসলিমদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
উজবেকিস্তানের তাতারীরা যখন আন্দোলন শুরু করল তখন সোভিয়েত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ১৯৮৯ সালে তাদেরকে ক্রিমিয়ায় ফিরে আসার অনুমতি দেয়।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে বাকী তাতাররাও দলে দলে ক্রিমিয়ায় আসতে শুরু করে। তাতাররাই একসময় ক্রিমিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কিন্তু বর্তমানে তাতার মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশেই পরবাসী ক্রিমিয়ান মুসলিমরা।

১৮৮৩ সালে যেখানে তাতারিদের সংখ্যা ছিল ৯ মিলিয়ন ১৯৪১ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র আট লাখ ৫০ হাজার। বর্তমানে ক্রিমিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা মাত্র দুই লাখ ৬০ হাজার। তাতাররা রাশিয়ানদের বিরোধিতা করে এবং তুলনামূলক ইউক্রেনকে পছন্দ করে। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী সের্গেই অক্সিনভের এক পাতানো গণভোটে পুতিনের রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়।

লেখকঃ আন্তর্জাতিক বিষয়ে কলাম লেখক 

আরও পড়ুন