Ads

একজন স্নেহের ভগিনি এবং শ্রদ্ধেয় স্বামীর  স্ত্রী

-কাজী খাইনরুন্নেসা

৯ ই ডিসেম্বর ঘুরে ফিরে চলে আসে একজন বেগম রোকেয়ার ছবি।  নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্ম তারিখটা ৯ ডিসেম্বর ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ৯ ডিসেম্বরেই; ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। মাঝের সময়টা খুব একটা লম্বা ছিল না। তাঁর মাত্র ৫৩ বছরের নাতিদীর্ঘ সময়ের পুরোটা কাল অতিবাহিত হয়েছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
ছোট বেলাতেই রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। বাবা জহির উদদীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের প্রকৃত অর্থেই নারী শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন না। অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন পুথিগত বিদ্যা মেয়েদের চক্ষুলজ্জা কমিয়ে দেয়, যা সংসারের অশান্তির কারণ।
তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন পঞ্চম। তাঁর বড় ভাইদের মধ্যে ইব্রাহিম সাবের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাই খলিলুর রহমান সাবের, পরের জন ছিলেন ইসরাইল সাবের। তবে তাঁর সেজ ভাই ইসরাইল সাবের অল্প বয়সেই মারা যান। বোনদের মধ্যে প্রথম ছিলেন করিমুন্নেসা খানম, দ্বিতীয় ছিলেন বেগম রোকেয়া এবং তৃতীয় বোন হোমায়রা খানম। পরিবারে ছিল উর্দু ভাষার প্রচলন। তাঁদের বাবা মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী না থাকলেও ছেলেদের শিক্ষিত করে তুলতে কোনো কার্পণ্য করেননি। দুজনকেই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁদের মেধা ও মননে শিক্ষা ও সভ্যতার প্রচুর প্রভাব পড়েছিল। বেগম রোকেয়া ও তাঁর বোনদের জীবনের শুরুতে বৈরী পরিবেশ থেকে সৃষ্ট প্রচুর মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে।~~

কিন্তু  একজন পুরুষ _বেগম রোকেয়ার  বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতায় গভীর রাত পর্যন্ত মোমবাতির ক্ষীণ আলোতে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা।  বিষয়টি লুকানো গেল না; টের পেয়ে গেলেন বাবা। প্রতিক্রিয়া হিসেবে করিমুন্নেসাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বলিয়াদীর মাতামহের বাড়ি। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো তাঁর। এই বিয়ের মাত্র নয় বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। এই বোনের শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের দেলদুয়ারে বেড়াতে গিয়ে ইউরোপিয়ান গভর্ন্যান্সের কাছে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পান রোকেয়া। পরে এই শিক্ষাটা খুব কাজে লেগেছিল তাঁর।
সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বেগম রোকেয়া তাঁর এই বোনকে ‘মতিচুর’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। এই বোন ছাড়াও বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতার কথা তিনি বারবার করে বলেছেন বিভিন্ন লেখায়। বেগম রোকেয়ার ভাষায়, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করে। আর সেই সব গ্রন্থের দোহাই দিয়া নারীদের অন্তঃপুরে আবদ্ধ করিয়া রাখে তারা।’
রোকেয়া তাঁর বড় ভাইয়ের বদান্যতার কথা বললেও বাবার অন্ধকার গৃহকোণ তাঁকেও সম্মানজনক আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়নি। ১৯২৪ সালে লেখা ‘পদ্মরাগ’ বইটি রোকেয়া ইব্রাহিম সাবেরকে উৎসর্গ করে সেখানে লিখেছিলেন, ‘দাদা, আমাকে তুমিই নিজ হাতে গড়িয়া তুলিয়াছিলে।’
➡️ এমন বড় ভাইয়ের বোন যিনি ছোট বোনকে শিক্ষার আলো হতে বন্চিত করতে চান নি।এখানেই আমার ভালো লাগা।বড়ভাই হিসাবে নিজে শিক্ষিত নয় শুধু বোনকে ও দান করলেন  এই জ্ঞান। একজন পুরুষের খোলস ছেড়ে  নিজেকে একজন প্রকৃত ভ্রাতা রুপে পরিচয়  দিয়েছেন।সেই যুগে জ্ঞান  পিপাসু বোনের জন্য  এইটুকুই এনে দিল বিরাট পরিবর্তন। আমরা পেলাম একজন  মহীয়সী  বেগম রোকেয়া।
আবার দেখি অন্য চিত্র।১৮৯৬ সালে ষোলো বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় খাঁন বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। সাখাওয়াত হোসেন বিপত্নীক ছিলেন। তাঁর আগের পক্ষের একটি কন্যাও ছিল। সাখাওয়াত হোসেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে দায়িত্বরত ছিলেন তখন।  এই বিয়ে যেন আশীর্বাদ হিসেবেই এল রোকেয়ার কাছে। বেগম রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা নিজের অন্তর দিয়েই গ্রহণ করেছিলেন সাখাওয়াত হোসেন। এরই ফল সাহিত্যিক রোকেয়ার আত্মপ্রকাশ।
আমরা দেখি একজন সাখাওয়াত হোসেন রুপে এক স্বামী। যে যুগে স্ত্রী  চরণদাসী, সে যুগে সাখাওয়াত  সাহেব স্ত্রী কে দিলেন কাব্য  চর্চার সুযোগ।
১৯০৪ সালে রোকেয়ার প্রথম গ্রন্থ ‘মতিচুর’ প্রকাশিত হলো। পরের বছর প্রকাশিত হলো ‘সুলতানার স্বপ্ন’। একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো বিখ্যাত এই লেখাটি। ১৯০৮ সালে তাঁর স্বামী জীবিত থাকাবস্থায়ই এটি বই আকারে বের হয়েছিল। এই বইয়ে রোকেয়া তাঁর কল্পনা শক্তির সাহায্যে এমন এক নারী সমাজের কথা বলেছেন, যেখানে পুরুষ সমাজকে অবরোধ করে রাখা হয়েছে, আর নারীরা বাইরের দুনিয়ায় বিচরণ করছেন এক ঐশী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। সেখানে কোথাও কোনো পুরুষনির্ভর কাহিনি নেই।
নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও চিন্তা করেছিলেন তিনি। সাখাওয়াত হোসেন এই জন্য বেগম রোকেয়াকে দশ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন বিবাহিত জীবনে সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারলেন না রোকেয়া। স্বল্পায়ু নিয়ে জন্ম নেওয়া তাঁর দুই মেয়ে মাস কয়েকের ব্যবধানে মারা গেলে তিনি প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে পড়ে যান। এই অবস্থায় সাখাওয়াত হোসেনও মারা গেলেন ১৯০৯ সালের ৩ মে।
১৯১১ সালে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে নতুনভাবে শুরু করলেন স্কুল। এই স্কুলটি ছিল ইংরেজি ভাষায়।
রোকেয়া একজন উঁচু মানের সমাজসংস্কারকও ছিলেন।   ১৯১৬ সালে কলকাতায় আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ১৯১৭ সালে ওই সংগঠনের ৫০ জন মহিলা সদস্যের উপস্থিতিতে ১৫ এপ্রিল প্রথম বার্ষিক সম্মেলন করে একটা যুগান্তকারী ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৩০ সালের দুই ডিসেম্বর প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে উড়োজাহাজে চড়ে আকাশভ্রমণের সুযোগও গ্রহণ করেছিলেন রোকেয়া। তাঁর এ-সংক্রান্ত লেখা ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
রোকেয়ার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। মাত্র পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে ‘পদ্মরাগ’, ‘মতিচুর’ (দুই খণ্ড), ‘অবরোধবাসিনী’ ও ‘সুলতানার স্বপ্ন’। মৃত্যুর পর বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপের একটি সংকলন বের হয়েছিল। সেখানে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘যদি কিছু টাকা পেতাম, বড় শখ ছিল একটা মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার।’ সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাননি তিনি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা গেলেন মহীয়সী এই নারী। যে রাতে মারা গেলেন, ওই রাতেও লেখালেখি করেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর টেবিলে পেপারওয়েটের নিচে ‘নারীর অধিকার’ শীর্ষক একটি অর্ধসমাপ্ত লেখা পাওয়া গিয়েছিল। (তথ্য সূত্রঃ প্রথম আলো)

➡️ একজন নারীর নারী হয়ে উঠার পেছনে অবশ্যই তার ইচ্ছা শক্তি কে কাজে লাগাতে হয়।সৃষ্টি কর্তা অনেক কিছু  দিয়ে পাঠালো ও পুরুষের  খোলসে থাকা কেউ কেউ কর্তা হওয়ার  ইচ্ছায় জলাঞ্জলি  দেয় একজন বোনের একজন স্ত্রীর ইচ্ছে। আবার কোন কোন পুরুষের  সহায়তায়  হয়ে  উঠে একজন  নারী পূর্ণ।নিজেকে পূর্ণ করতে গেলে পড়াশোনা করতে হবে আর জানতে হবে অনুকূল পরিবেশে সঠিক প্রয়োগ।যা বেগম রোকেয়া  দেখিয়ে  দিয়েছেন  অনেক যুগ আগেই। আজকের নারীরা ও তাদের চিন্তা , চেতনা আর মননে হয়ে উঠুক এক একজন নিজের জগতের সুলতানার স্বপ্নের মত রাণী,পরিবেশ  পরিস্থিতি  যেন তার জন্য  বাধার কারণ হয়ে  না দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন