Ads

কর্মজীবী বা গৃহিণী যাই হন মূল পরিচয় ‘মা’

চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ী মহিলারা কি গৃহিণী নয়?

তাদের কি ঘরের কাজ করতে হয় না?

তাদের কি নিজে রান্না করতে হয় না কখনো?

নিজে রান্না না করলেও; কী রান্না হবে, কার কোনটা পছন্দ সেই মতে রান্নার মেন্যু বলে দিতে হয় না?
অনেক গৃহিণীও নিজে রান্না করেন না।

কোন কাপড়ের সাথে কোন কাপড় ধোয়া যাবে না, কোন কাপড়গুলো লন্ড্রিতে পাঠাতে হবে; তার খোঁজ কি তারা নেয় না?

তারা কি সন্তানের অসুস্থতায় রাত জাগে না? ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ নেয় না? স্কুলে ঘটে যাওয়া গল্প কি তারা শোনে না?

ঘরে কোন রুমে কোন রং-য়ের জানালার পর্দা হবে, বসার ঘরটায় কী কী শোপিস দিয়ে সাজালে সুন্দর লাগবে— সেসব খবর কি তারা রাখে না?

এমন কোন বিষয়টা আছে যা শুধু গৃহিণীরাই করে কিন্তু যারা চাকুরী অথবা ব্যবসা করে তারা করে না? যদি থাকে তবে বাসায়-থাকাদের আলাদা ভাবে গৃহিণী বলা যায় নচেৎ আমার কাছে সংসারের কাজে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা প্রতিটি মেয়েই তো গৃহিণী।

ভুলেও কখনো এটা বলবেন না যে, গৃহিণী মায়েরা সন্তান-সংসারের প্রতি বেশি কেয়ারিং চাকুরীজীবীদের চেয়ে। হতে পারে তারা ক্ষেত্রবিশেষে সময় কম দিতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা ঘরের প্রতি কম কেয়ার অনুভব করে।

কোন এক কোম্পানি একটা এড বানিয়েছিলো, সেখানে স্টেজে উঠে প্রতিটি সন্তান তার মা সম্পর্কে বলছিলো—

আমার মা ডাক্তার, আমার মা শিক্ষক, আমার মা ডিজাইনার। ওখানে একজন মা ছিলেন যিনি শুধুমাত্র ঘরের কাজ করেন অর্থাৎ জব কিংবা ব্যবসা করেন না— অন্য বাচ্চাদের মুখে মায়েদের প্রফেশনের কথা শুনতে শুনতে তার মুখ শুকনো হয়ে যাচ্ছিলো।

কিন্তু যখন তার সন্তান বলতে শুরু করলো— তার মা ডাক্তার, শিক্ষক, ডিজাইনার আরো অনেক কিছু তখন তার মুখে হাসি ফুটলো।

নিঃসন্দেহে খুবই স্পর্শকাতর একটি এড এবং সত্যিই আমাদের সকলের মা-ই অলরাউন্ডার। কিন্তু এডটাতে কিন্তু সব মা’কে অলরাউন্ডার হিসেবে দেখানো হয়নি শুধু দেখানো হয়েছে ঘরে থাকা মা’কে এবং যখন অন্য মায়েদের সম্পর্কে বলছিলো সন্তানেরা তখন সেই মায়ের মলিন মুখ বলে দিচ্ছিলো, “আমি মা হিসেবে সাধারণ কারণ আমি অন্যদের মতো বাহিরে কাজ করি না।’

‘সাধারণ’ কেন বললাম সে প্রসঙ্গে নিজের একটি গল্প বলি—

আমি একজন গৃহিণী। আমার ছেলের বয়স যখন দেড় বছর একদিন তার বাবা বাসায় এসে আমাকে প্রশ্ন করে— আচ্ছা, এই যে তুমি চাকরী করতে পারছো না, তোমার কষ্ট হয়?

আমি তাকে উল্টো প্রশ্ন করি, তুমি কি আমায় চাকরী করতে নিষেধ করেছো?

সে বললো, ‘না’।

আমি বললাম, আমার কাছে এই সময়টা উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। ঘর, সংসার, সন্তান; এর বাহিরে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এসবের ভেতরেই থাকতে ভালো লাগছে।

সত্যি বলতে সেই সময়টাকে উপভোগ করেছি আমি। আমার সন্তান যদি স্টেজে উঠে বলে, আমার মা গৃহিণী; আমার মুখ মলিন হবে না কারণ এটাকে আমি ভালোবেসে গ্রহণ করেছি। ‍এর বাহিরে কোনো কিছুই যেহেতু করতে আমার ইচ্ছে হয়নি তাহলে আমি কেন বড় মুখে বলতে পারবো না যে, ‘আমি গৃহিণী’?

তো, সেই মায়ের মলিন মুখ দেখে আমার মনে হলো, সে তার অবস্থান নিয়ে খুশী নন এবং এই অবস্থা আমাদের বেশিরভাগ মায়েদেরই।

কেন?

কারণ সে বড় কিছু একটা করতে চেয়েছিলো কিন্তু সংসার নামক ক্ষেত্রটির জন্য তার সেই ‘বড় কিছু একটা’ করা হয়ে ওঠেনি। কারো ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী, কারো ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ী বা নিজ পরিবারের মানুষদের নিষেধ তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

বিষয়টা আমার কাছে আসলে এমন— আপনার সামনে দুটো অপশন খোলা; দুটোই কষ্টদায়ক তবুও যখন একটি বেছে নিতে হয় তখন সেটিকেই বেছে নেন যেটার মূল্যায়ন আপনার কাছে অধিক। মানে আপনার কাছে ক্যারিয়ারের থেকে সংসারের জায়গাটা একটু হলেও বেশি বলেই তো সেটা মেনে নিয়েছেন তাহলে কেন হাসি মুখে বলতে পারছেন না, আমি গৃহিণী? নিজেই কেন নিজের ভেতর হীনমন্যতা তৈরী করছেন? সন্তানকে কেন আপনাকে সব উপাধি দিয়ে খুশী করতে হয়?

মূল কথা হলো, যা-ই করুন ভালোবেসে করুন; নিজেকে নিজে সন্মান দিতে শিখুন। নিজ অবস্থানকে আপনি সন্মান না দিতে পারলে অন্যরা যতো কথাই বলুক দিন শেষে আপনি তাই হয়েই থাকবেন যা আপনি অনুভব করেন। এবং যারা চাকুরী করে তাদেরকে সম্মান দিতে শিখুন। তারা কিন্তু ঘর বাহির দুটোই সামলাচ্ছেন। নিশ্চয়ই আপনি হলেও পারতেন কিন্তু আপনি করছেন না বা পারছেন না; তারা করতে পারছে। তাই সেটাকে বাঁকা চোখে না দেখে বরং প্রশংসার চোখে দেখুন। অপরদিকে যারা কর্মজীবী তাদেরও কোনভাবেই উচিত নয় যারা শুধুমাত্র ঘরের কাজ করে তাদেরকে ক্ষুদ্র করে দেখার। এই ক্ষুদ্রতা আপনার নিচু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি এমন অনেককেই জানি যারা সন্তানকে আরো বেশি সময় দেওয়ার জন্য এবং সন্তানের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার জন্য তার ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়েছে এবং সে সন্তানের সাথে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করে নিজেকে গৃহিণী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে।

অনেক মানুষের ধারণা কর্মজীবী মায়েরা সন্তানকে সময় দিতে পারে না এবং তাদের সাথে সন্তানদের মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়। সত্যি? তাহলে কি বাবাদের সাথেও সন্তানদের মানসিক দূরত্ব কাজ করে? আসলে যে সন্তানের সাথে মানসিক সম্পর্ক তৈরী করতে পারে না সে ঘরে সারাক্ষণ বসে থাকলেও পারে না। কাজ কোনভাবেই অজুহাত হতে পারে না তবুও যারা মনে করেন কাজের জন্য যথেষ্ট সময়ট দিতে পারছেন না, তাদের উচিত আগে সন্তানকে সময় দেয়া; কারণ আপনার নিজের জায়গা তৈরী করার আগেও যা প্রয়োজন তা হলো সেই সন্তানটিকে সুস্থ সময় এবং পরিবেশ নিশ্চিত করা। যাকে আপনি পৃথিবীতে এনেছেন তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার চেয়ে আপনার ক্যারিয়ার কোনভাবেই বড় হতে পারে না।

একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা কেউ কিন্তু পারফেক্ট নই। যারা শুধু ঘরে কাজ করে তাদের শুনতে হয়— ‘সারাদিন ঘরে বসে কী করো তুমি?’ আবার যারা বাহিরে কাজ করে তাদেরকে শুনতে হয়— ‘তোমার তো ঘরের দিকে মন নেই।’

এর মানে এই নয় যে, পুরুষদের এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না? তাদেরও হয় এবং সেটাও এই সমাজের তৈরী। সেটা নিয়েও একদিন লিখবো। ‍আজকের মতো বিদায়।

 

লেখকঃ

শ্রাবণী মজুমদার

প্রকাশক, আনন্দম

আরও পড়ুন