Ads

সংসারের কাবিখা প্রকল্পের নায়িকারা

শেখ সাফওয়ানা জেরিন

বাঙ্গালী সমাজে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে “সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে  “।  ছোটবেলা থেকে সব রমণী-পুরুষ এই প্রবাদ শুনে শুনে বেড়ে উঠে । তাই স্বাভাবিকভাবেই বাঙ্গালী সমাজে বেড়ে উঠা পুরুষদের মাথার মধ্যে ঢুকে থাকে সব  দায়িত্ব তাহলে  একজন নারীর; তথা একজন স্ত্রীর, একজন বোনের, একজন মার আর পরবর্তীতে একজন কন্যার । তাই তাদের চিন্তা-চেতনায় রয়ে যায় সংসার সুখী হয় নারীর কারণে আবার সংসার দুঃখের হয় নারীর কারণে ।  সংসারের মানুষগুলোকে সুখে রাখার জন্য একজন পুরুষের ইনকাম করা ছাড়া আর কোন দায়িত্ব আছে বলে পুরষজাতি জানে না এবং  বোঝেও না ।  অধিকাংশ বাঙ্গালী পরিবারে তাই অর্থ আয় ছাড়া সংসারের কাজে আর যত আত্মনিয়োগ এবং আত্মত্যাগের  গল্প থাকে তার সবটায় যেন নারীকে ঘিরে । সংসার আর সংসারের মানুষগুলোর সুখের কথা চিন্তা করতে করতে একজন নারীর যে সুখ বলে আর কিছু থাকে কি না স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারবেন । বাঙ্গালী নারীর দৈনন্দিন জীবনে অতিবাহিত সময় এবার একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক-

ধরা যাক একটা পরিবার, ধরলাম পরিবারটা একান্নবর্তীই। বড় বড় হাঁড়িতে এখানে রান্না করা হয়। সদস্য সংখ্যা কতো হবে? এই ধরা যাক ১০-১২জন। এই ১০ জনের রান্না করেন বাড়ির মহিলারা , ধরলাম সেই সংখ্যাটাও ২-৩ জন।
বাড়ির মহিলারা ঘুম থেকে ওঠেন সেই ভোরবেলা।নামায পড়েই তাদের শুরু হয় রুটিবেলা। একজন বেলেন তো আরেকজন ছ্যাকেন। এই বাড়ির ছেলেরা রুটি ছাড়া অন্য কিছুই খাবেন না। খিচুড়ি মানবে সে শুধু বৃষ্টি বা ছুটির দিনে। মহিলাদের রুটি বানাতে ঘাম ছুটে যায়, যিনি বেলেন তিনি সারারাত হাতের ব্যাথায় ছটফট করেন। একটা দুটা রুটি তো না! কোনোদিন ৫০ টা রুটিতেও হয়না। বাড়ির ছেলেগুলো গামলা ভর্তি ভাত নিমিষেই হাওয়া করে ফেলতে পারে। আর রুটি তো নস্যি বিষয়। তাও মোটা করে বেলা যাবেনা মিহি করে পাতলা করে বেলতে হবে। নাহলে প্লেট ভাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে একেকজনের। রুটি বেলে ভাজি করে চা খেয়ে উঠতে উঠতে ১০টা বাজে। এরপর শুরু হয় দুপুরের রন্ধনযজ্ঞ। ছুটির দিন মানে এই বাড়ির মহিলাদের শনির দশা। ছুটির দিন না হলেও কর্তারা না থাকায় দুপুরের খাবার সাজানো থেকে যে খুব একটা নিস্তার মে লে তাও না। বাড়ির বাচ্চারা স্কুল শেষে দুপুরে বাসায় খায়। ১১টা থেকেই শুরু হয় দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি। বিরাট পাতিলে ভাত চড়ানো হয়, বড় বড় গামলায় সবজি কাটা হয়, মাছ ডাল রান্না করে উঠতে ঊঠতে দুপুর আড়াইটা। এরপর গোসল নামায সেরে গিন্নিরা বাচ্চাদের ও খাইয়ে দিতে দিতে বেলা ৪টা। একটু শুতে যাবে তখনই হয়তো বাচ্চারা এটা খাবে ওটা খাবে বায়না ধরবে আর গিন্নি যাবেন বিকেলের নাস্তা বানাতে। নাস্তা বানিয়ে সার্ভ করতে করতে সন্ধ্যা ঘনায়। মাগরিব পরে গিন্নিরা যায় খাবারগুলো জাল দিতে। এ বাসায় দুটো ওভেন নস্ট পড়ে আছে। পুরুষদের ঠিক করার সময় নেই। রান্নাঘরে এ্যাডজাস্টার পাখাটাও নস্ট। দেখার কেউ নেই। সন্ধ্যা হতেই কর্তা বাসায়। কর্তা আসতেই আসে চায়ের হুকুম। গিন্নিরা চা বানিয়ে নাস্তা সাজাতে লেগে যায়। এরপর চা পরিবেশন এবং কর্তার ফুটফরমায়েশ খাটতে খাটতেই রাতের খাবারের সময় হয়ে যায়। খাবার খেয়ে এঁটো একটা বাসন ও কেউ গিন্নিদের এগিয়ে দেয়না, কখনো কখনো খাবার ঢেকেও রাখেনা কেউ। গিন্নিদের এতক্ষণে অল্প অল্প করে শরীরের শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে। রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে পরিশিষ্ট খাবার গুছিয়ে বিছানায় যেতে রাত ১১টা।এরপর আর তাদের নিজের জন্য কিছু করার আগ্রহ ইচ্ছা বা শক্তি থাকেনা। এভাবেই গিন্নিদের দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর হয়। এই বাড়ির বউদের হাতে কোন টাকা থাকেনা, যা লাগে কর্তারাই কেনে। এই বাড়ির বউরা বাজারে বা মার্কেটে যায় না, স্বামীই বাচ্চাদের কাপড়, গিন্নির কাপড় কেনেন। গিন্নির পছন্দ না হলে? গিন্নির আবার পছন্দ কী? কাপড় তো অন্য পুরুষকে দেখানোর জন্য পড়বে না, যে দেখবে তার তো পছন্দ হয়েছে বলেই এনেছে। 

এ বাসার ছেলেদের কাপড় আয়রন করে দেওয়াটাও গিন্নিদের কাজ। কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলো সারাদিন এতো কাজের পরে এই আলগা ঝামেলা তাদের শরীরে সয়না। তখন কর্তারা মুখে ঝামটা মেরে ন্যাকা আর আলসে বলে গালমন্দ করেছিল। আলসে কারা এই বাড়ির গিন্নিরা কিন্তু ঠিক জানে! দোকানে কাপড় দিয়ে আসতে আর আয়রনের পড়ে নিয়ে আসাতেই যে সমস্ত আলসেমি সেটা তারা বোঝে। এই বাড়ির ছেলেরা বাড়ির একটা কুটাও নেড়ে দেখেনা, অফিস থেকে এসে কাপড়টাও খোলে না , সেই অবস্থায়ই শুয়ে পড়ে মোবাইল হাতে। ভারচুয়াল জগতে মহান কথার তুবড়ি ছুটিয়ে দেশ সমাজ উদ্ধার করে।

বাড়ির সবার শুক্রবার ছুটি হয়, সেদিন কর্তারা পায়ের উপর পা তুলে চা খান আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়েন কিংবা মোবাইলে বুদ হয়ে থাকেন। বাচ্চাদের ও ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়া হয়। ছুটি নেই শুধু বাড়ির মায়েদের, বউদের তথা গিন্নিদের।

কোন ছুটির দিন বাচ্চারা বাবার সাথে বেড়াতে গেলে সেদিন বাড়ির বউরা একটু শ্বাস ফেলে, একটু অনিয়ম করে অথবা একটু নিজের ইচ্ছামতো কিছু করে।  বাড়ির কর্তী হলেও একেকজন গৃহিণী যেন প্রোগ্রাম করা কোন মেশিন চালিত রোবট।তাদের ক্লান্তি নেই, কস্ট নেই, সাধ আহ্লাদ হাসি কান্না নেই। তারা কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রোজেক্টে কাজ করা শ্রমিকের মতো। সারাদিন কাজের বিনিময়ে ৩ বেলা খাবার আর ঘুমানোর জন্য মাথার উপরে ছায়া দেওয়া হচ্ছে সংসার নামক সামাজিক সেটাপের মাধ্যমে। সংসারের প্রতিটা প্রাণী ধরে নিয়েছে এতেই বাড়ির বঁধুরা খুশি। কিন্তু একঘেয়ে এই কাজ বছরের পর বছর করে যাওয়া যে একটা আত্মত্যাগ এটা কেউ বুঝেনি। ত্যাগেও হয়তো সুখ আছে, যদি যাদের জন্য ত্যাগ করা হয় তারা একটু বোঝে! কিন্তু কাবিখা প্রোজেক্টে খেটে যাওয়া বঁধুদেরকে এসব জিজ্ঞেস করে কেউ আদিখ্যেতা করেনি। এইসব বঁধুরা রান্না ঘরের পড়ে থাকা নষ্ট বাতিল জিনিষগুলোর মতোই বাড়ির পুরুষদের কাছে গুরুত্বহীন, মেরামতে প্রয়োজনহীন। এই বাড়িতে খাবার রান্না হলে কেউ মজা হয়েছে না বললেও লবন কম বেশিতে মেয়েদের লাঞ্ছিত অপমানিত করা হয়। খাবার ঠিক মতো রান্না করাটাই এই বাড়ির মেয়েদের একমাত্র কাজ, আর তার বিনিময় খাবারই। কাজে ভুল হলে অপমানিত হতে হলেও খাবার কখনো বন্ধ হবেনা এই বাড়ির বউদের সেরকম একটা নিশ্চয়তা আছে, কারন এটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এখানের দায়বদ্ধতা মৃত্যুঅবধি।বাড়ির পুরুষেরা যে পরিমাণ পরনির্ভরশীল কে জানে বঁধু  মরে গেলেও হয়তো কবরের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করবে- আমার শার্টটা  কোথায়?

 

আরও পড়ুন