Ads

আমরা আমাদের জীবনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবো ?

।। জামান শামস ।।

হৃদয় মেরামত করতে গিয়ে গত দু’দিন হাসপাতালে ছিলাম। আমি বহু বছর ধরেই হৃদরোগী। ঢাকার হৃদয় মেরামতে বিখ্যাত একটি ভালো মানের হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। ২০০৬ সালে প্রথম এবং এরপর ধারাবাহিক ২০১৭ পর্যন্ত হৃদযন্ত্রে পাঁচটি স্ট্যান্টিং হয়। ২০১৯ ভারতের দেবী শেঠির নারায়ন হৃদয়ালয়ে একবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করি। গতকাল ফের আরেকটি এনজিওগ্রাম করি। সমস্যা স্বমূলে যায়নি, তবে ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষদের জন্য জীবনের প্রতিটি মুসিবত এক একটি আশীর্বাদ। যত বড় মুসিবত তত বড় পুরস্কার। অসুস্থতাও একটি বৃহদাকার মুসিবত। আল্লাহ নবী পয়গাম্বরগণকেও অসুস্থতা দিয়েছেন। কাউকে স্বল্পকালীন,কাউকে দীর্ঘকালীন। আইউব আঃ এর অবস্থা এমন হয়েছিল যে অসুস্থতার দিনগুলোতে তাঁর সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব সবাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করেছিলেন। দোয়াটি পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা উদ্ধৃত করেছেন। দোয়াটি হলো—

اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الضُّرُّ وَ اَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ

আমি তো দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’

(সুরা আম্বিয়া: ৮৩)

আমরা সুখে থাকি আর বিমারগ্রস্থ থাকি উভয়টাই আমাদের জন্য পরীক্ষা। সুখে থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ,কষ্টে নিপতিত হলেও আল্লাহর প্রসংশা। কষ্টের সময় আরো বেশী করে আল্লাহর স্মরণ জরুরত হয়ে পড়ে। আর সে ম্মরণের মাধ্যম হলো সালাত ও সবর।

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।(সূরা বাকারা ১৫৩)

হাসপাতালের বেডে শুয়ে কষ্টকাতর মানুষের জন্য অন্যতম একটি দুর্বল অবস্থা।কথায় আছে “হাসপাতালে যত সংখ্যা ও পরিমাণে মানুষ আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় মসজিদে অত সংখ্যা ও পরিমাণে আল্লাহর জিকর উচ্চারিত হয় না।” রোগে মহাপুরুষও মহাভীরু ব্যক্তি বনে যায়। মানুষেরা এতো পেরেশান হয়ে পড়ে যে তখন যে যাই বলে যাচাই বাছাই ছাড়া সেটাই সে শুনে।

আরও পড়ুন- সন্তানকে দ্বীনদার হিসেবে গড়ে তুলবেন যেভাবে

আরেকটি বড় গুরুত্বপূর্ণ কথা হাসপাতালের বেডে শুয়ে মাথায় আসলো যে এখানে রোগীকে যত আরামই দেয়া হোক,যত ভালো নার্সিং করা হোক,যত উত্তম মানের ডায়েটই দেয়া হোক সে হাসপাতালে উপশমের পর আর এক মুহুর্তকালও বিলম্ব করে না,বাড়ী ফিরে যায়। হাসপাতালের বেড এক রাতের জন্যেও তার কাছে স্থায়ী আবাসের মতো মনে হয় না। পূরো দুনিয়াটাই তো এমন,কয়েকদিনের সফর মাত্র।

রাসূল (সা.) বলেছেন-ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার শরীরের এক অংশ ধরে বললেন : পৃথিবীতে অপরিচিত মুসাফির অথবা পথযাত্রীর মতো জীবন-যাপন করো। আর প্রতিনিয়ত নিজেকে কবরবাসী মনে করো। (সহীহ বুখারী ৬৪১৬, তিরমিযী ২৩৩৩)

তাঁর ইন্তেকালের বেশ কয়েক বছর পরের কথা। সাহাবি আবু দারদা (রা.) তখনও জীবিত। তিনি খুব অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। লোকজন গিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করল-‘কেন আপনি অন্য সবার মতো সম্পদ ও অর্থকড়ি উপার্জন বা সঞ্চয় করেন না?’ আবু দারদা (রা.) উত্তরে বললেন- ‘রাসূল (সা.) একবার আমাকে বলেছিলেন- “তুমি ওজনে যত হালকা হবে, তোমার ঊর্ধ্বযাত্রা ততই সহজ হবে।” এ কারণেই আমি সব সময় সম্পদে হালকা থাকার চেষ্টা করেছি। (সহিহুল জামিউ ২০০১; আত তারগিব ওয়াত তারহিব ৩১৭৭)

আল কুরআনের সূরা কাহাফে যে বাগান মালিকের কথা বলা হয়েছে, তার উদাহরণও এক্ষেত্রে দেওয়া যায়। একজন ব্যক্তির বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ ও জমাজমি ছিল। একবার সে অহংকার করে বলল-‘আমার সম্পদ কখনো শেষ কত বলে মনে হয় না।’ কিন্তু একদিন প্রচণ্ড এক ঝড় এসে তার সকল সম্পদ বেগে করে দিয়ে যায়। এরপর সে প্রচণ্ড আফসোস আর হা-হুতাশ করতে থাকে।

এ ধরনের অহংকারী লোকেরা এমন পরিণতিই অহরহ বরণ করতে বাধ্য হয়। সম্পদে মোহাবিষ্ট এই মানুষগুলো কখনোই জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারে না। প্রখ্যাত ফরাসি লেখক মনটেইন বলেছিলেন-‘সৌভাগ্য এমন একটি বিষয়: যা গড়তে অনেক বছর লেগে যায়, কিন্তু তা ধ্বংস হতে সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

اَلۡمَالُ وَ الۡبَنُوۡنَ زِیۡنَۃُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ الۡبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیۡرٌ عِنۡدَ رَبِّکَ ثَوَابًا وَّ خَیۡرٌ اَمَلًا

‘এ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের একটি সাময়িক সৌন্দর্য-শোভা মাত্র। আসলে তো স্থায়িত্ব লাভকারী সৎকাজগুলোই তোমার রবের কাছে ফলাফলের দিক দিয়ে উত্তম এবং এগুলোই উত্তম আশা-আকাঙ্ক্ষা সফল হওয়ার মাধ্যম। (সূরা কাহাফ ৪৬)

আপনি যখন দুনিয়া ছেড়ে পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন, তখন সাথে যাবে কেবল ঈমান আর আমল। যদি আল্লাহর ওপর ঈমান থাকে, তাহলে নৈতিকতার সাথে জীবনযাপন করার চেষ্টা করুন। যেকোনো ধরনের বিচ্যালে জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন, তওবা করুন আল্লাহর কাছে। তাহলেই আপনি কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার অর্জন করতে পারবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَ اَنۡذِرِ النَّاسَ یَوۡمَ یَاۡتِیۡهِمُ الۡعَذَابُ فَیَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا رَبَّنَاۤ اَخِّرۡنَاۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ نُّجِبۡ دَعۡوَتَکَ وَ نَتَّبِعِ الرُّسُلَ ؕ اَوَ لَمۡ تَکُوۡنُوۡۤا اَقۡسَمۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلُ مَا لَکُمۡ مِّنۡ زَوَالٍ

সেই দিন সম্পর্কে এদের সতর্ক করো, যেদিন আজাব এসে এদের ধরবে। সে সময় এ জালিমরা বলবে-“হে আমাদের রব! আমাদের একটুখানি অবকাশ দাও, আমরা তোমার ডাকে সাড়া দেবো এবং রাসূলদের অনুসরণ করব।” কিন্তু তাদের পরিষ্কার জবাব দেওয়া হবে-“তোমরা কি তারা নও, যারা ইতঃপূর্বে কসম খেয়ে খেয়ে বলতে, আমাদের কখনো পতন হবে না?”(সূরা ইবরাহীম ৪৪)

নিজের বুকে একবার হাতটি ধরুন। অনুভব করতে চেষ্টা করুন হৃদয়ের স্পন্দন। বুঝতে পারছেন কি, আপনার আর অন্ধকার কবরের মাঝখানে এই সামান্য হৃদস্পন্দনটিই শুধু ব্যবধান? আপনার হৃদকম্পনটি থেমে যাওয়ার মানেই হলো আপনি মৃত। সেখানেই আপনার পরিসমাপ্তি। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবতেও চাই না যেন!

আরও পড়ুন- সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্য কি

আমরা কি বিনোদন করার জন্য দুনিয়ায় এসেছি? টাকাপয়সা উপার্জন করে উন্নত জীবনযাপন করাই কি জীবনের লক্ষ্য? নাকি স্থায়ী জীবনকে সুন্দর করার জন্যই আমাদের ক্ষণস্থায়ী এ জীবনটি দেওয়া হয়েছে? দুদিনের সুযোগসন্ধানী ব্যবসার তুলনায় আমাদের তাই এমন ব্যবসার দিকে ঝোঁকা উচিত, যা স্থায়ী মুনাফা প্রদান করবে।

আপনি কী প্রত্যাশা করছেন? যা এখন আপনার হাতে আছে, আপনি যা নিজের বলে মনে করছেন, তা খুব অল্প সময়ের জন্যই আপনার কাছে থাকবে। তারপর চলে যাবে অন্য কারও কাছে অথবা সে নিজেই ক্ষয় হয়ে যাবে। আপনি এই দুনিয়ায় কতটা অর্থশালী, ক্ষমতাবান এবং আধিপত্য বিস্তারকারী হতে পারলেন, তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কবরে আপনার ক্ষমতা,অর্থ-বিত্ত ও প্রভাব, রাজনৈতিক কৌশল সবকিছু নিষ্ফল প্রতিপন্ন হবে।

আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী লোকেরা এখন কবরে শুয়ে আছে। কবরগুলো ভর্তি হয়ে আছে অসংখ্য মানুষে! তারা একটা সময়ে এই পৃথিবীতেই ছিল; অথচ এখন অন্ধকার কবরে। আমরা দুনিয়াতে এসেছি আল্লাহর ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণ করার জন্য। এই সময়কালটি আমাদের জন্য পরীক্ষার। আমরা কী পরকালীন জীবনে পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নাকি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য-তা এখানকার কাজের দ্বারাই নির্ধারিত হবে। পৃথিবীর চমকপ্রদ ও ঝলমলে রূপের আকর্ষণকে যারা উপেক্ষা করতে পারে, তাদের পক্ষেই পরকালের স্থায়ী জীবনে বেশিসংখ্যক সফলতা আদায় করে নেওয়া সম্ভব। আর বীপরীতে কুফরীর ফলাফল বড় মন্দ।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, مَثَلُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِرَبِّهِمۡ اَعۡمَالُهُمۡ کَرَمَادِۣ اشۡتَدَّتۡ بِهِ الرِّیۡحُ فِیۡ یَوۡمٍ عَاصِفٍ ؕ لَا یَقۡدِرُوۡنَ مِمَّا کَسَبُوۡا عَلٰی شَیۡءٍ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الضَّلٰلُ الۡبَعِیۡدُ

যারা তাদের রবের সাথে কুফরী করে তাদের আমলসমূহের দৃষ্টান্ত হল এমন ছাইয়ের মত, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ের দিনে বাতাস প্রচন্ড বেগে যা বহন করে নিয়ে যায়। তারা যা অর্জন করেছে, তার মাধ্যমে কিছুই করতে পারে না। এ তো ঘোরতর বিভ্রান্তি। (সূরা মুহাম্মদ ১৮)

আল্লাহ আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় আখিরাতকে গুরুত্ব দিবার মন ও মনন দান করুন। আমিন।

লেখকঃ  কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা,গল্প,কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক!  আপনি আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন,“তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) ।আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক জামান শামস

আরও পড়ুন