Ads

অমুসলিম দেশ নিয়ে সমীক্ষার ফলাফল ও ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য !

।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক অধ্যাপক হোসাইন আসকারীর একটি গবেষণা রিপোর্ট বেশ কিছুকাল ধরে ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে এবং মুসলিম বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইসলামী দেশগুলো ইসলামী অনুশাসন কতটুকু মেনে চলে তা অনুসন্ধান করাই ছিল তার গবেষণার বিষয়বস্তু। গবেষণায় তিনি দেখেছেন যে, রাষ্ট্র ও সমাজের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য ইসলামের যে অনুশাসন সত্যিকার অর্থে ইসলামী দেশগুলো সেগুলো মেনে চলে না বরং যারা তা অনুসরণ করে তারা অমুসলমান দেশ। অধ্যাপক হোসাইন আসকারীর গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ইসলামী অনুশাসন মানা দেশগুলোর মধ্যে ( Most Islamically Comptiant Country ) প্রথম যে দেশটির নাম আসে তা হচ্ছে নিউজিল্যান্ড; এরপর লুক্সেমবার্গ। তারপর হচ্ছে আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড। ষষ্ঠ স্থানে ডেনমার্ক এবং এক্ষেত্রে কানাডার স্থান সপ্তম। গ্লোবাল ইকোনমি জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ার স্থান ৪৮তম, বাহরাইনের ৬৪তম, সৌদী আরবের ১৩১তম এবং বাংলাদেশের অবস্থান সৌদী আরবের নীচে অর্থাৎ ১৩২তম।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মুসলমানরা তাদের নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, হিজাব, দাড়ি, জুব্বা এবং কুরআন হাদিস তেলাওয়াতের ব্যাপারে সজাগ কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবন পরিচালনায় ইসলামী আইন ও অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে তারা খুবই শিথিল। এতে আরো দেখা গেছে যে, মুসলমানরা দুনিয়ার অন্যান্য যে কোন জাতির তুলনায় ধর্মীয় আলোচনা ও ওয়াজ নসিহত বেশি শুনেন। গত ৬০ বছরের তারা জুমআর নামাজের খুতবা শুনেছেন কমপক্ষে ৩৫০০ বার। কিন্তু এগুলো তাদের চরিত্রে কোনও পরিবর্তন এনেছে বলে মনে হয় না।

গবেষণা রিপোর্টে একজন চীনা ব্যবসায়ী প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন যে, মুসলমান ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসে দু’নম্বরী মালের ফরমাস দেন এবং অনুরোধ করেন যে, এই মেকি মালের উপর যেন তাদের চাহিদা অনুযায়ী খ্যাতনামা কোম্পানিসমূহের লেভেল এটে দেয়া হয়। পরে যখন আমরা আমাদের সাথে তাদের খাবার দাওয়াত দেই তখন তারা এই বলে এড়িয়ে যান যে, এটা আমাদের জন্য হালাল নয়, কাজেই আমরা খেতে পারবো না। প্রশ্ন হচ্ছে বিখ্যাত কোম্পানির খাঁটি মাল বলে মানুষের কাছে নিম্মমানের মেকি মাল বিক্রি করা কি হালাল?

জাপানের একজন নওমুসলিমের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক হোসাইন আসকারী তার গবেষণা রিপোর্টে বলেছেন উক্ত নওমুসলিম এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে, পাশ্চাত্যের অমুসলমানদের তিনি বেশি বেশি করে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে দেখেছেন, কিন্তু মুসলমানদের তা করতে দেখেননি। তিনি ইসলাম গ্রহণের জন্য নিজেকে ভাগ্যবান অভিহিত করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং আক্ষেপ করে বলেন যে, প্রাচ্যের দেশগুলোতে আমি ইসলাম দেখেছি, মুসলিম দেখিনি। ইসলাম ও নামধারী মুসলমানদের মধ্যে বিরাজিত তফাৎ দেখে আমি বিস্মিত হই।

শুধু নামায রোজা করার নাম ইসলাম নয়। ইসলাম হচ্ছে একটি জীবন ব্যবস্থা। এই জীবন ব্যবস্থা তার অনুসারীদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কিভাবে চলা ফেরা, লেনদেন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে সে শিক্ষা দেয়।

আরও পড়ুন-ইতিহাসের অজ্ঞতা গোলামী ডেকে আনতে পারে ।। ১ম পর্ব

একজন ব্যক্তি নামায পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দিতে পারে, রোজা রাখতে পারে কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের অনুশাসনগুলো মেনে না চললে আল্লাহর দৃষ্টিতে সে ইসলামের প্রকৃত অনুসারী নয়। একজন মুসলমান আল্লাহর কুরআনের কিছু অংশ গ্রহণ ও কিছু অংশ বর্জন করতে পারেন না।

গবেষক তার বক্তব্যে ইসলামকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন।  এক. ঈমান আনার প্রকাশ্য ঘোষণা; দুই. ঈমান সংক্রান্ত ইহসান যা ইসলামের সামাজিক অনুশাসনসমূহ বিধি অনুযায়ী পালনের মাধ্যমে আদায় করা হয়। এই দু’টি বিষয় যদি এক সাথে পালন করা না হয় তাহলে ইসলাম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। নামধারী মুসললিম দেশসমূহে প্রকৃতপক্ষে তাই হচ্ছে। তিনি জর্জ বার্নার্ড শ’র একটি উদ্ধৃতিও দিয়েছেন যাতে তিনি বলেছিলেন যে, “Islam is the Best religion but Muslim are the worst followers” (ইসলাম হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম কিন্তু মুসলমানরা হচ্ছে সর্বনিকৃষ্ট অনুসারী )।

একদল লোক আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে, মুসলমানরা যা করেন তাই ইসলাম হতে বাধ্য। তাদের চালচলন ও কথাবার্তা থেকে বুঝা যায় মুসলমান ইসলাম অনুসারে চলতে বাধ্য নয় বরং ইসলামই মুসলমানের খায়েশ পূরণ করে চলতে বাধ্য। তারা তাই পাশ্চাত্য দেশের সকল রীতিনীতিকে এ দেশে আমদানি করাকেই ইসলামের বড় খেদমত বলে বিশ্বাস করেন। এই বিশ্বাসের সঙ্গে তাদের আমলের পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্য রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদের যারা ধারক ও বাহক তাদের এই শ্রেণীভুক্ত করা যায়।


আবার একটি মহল আছে যারা মার্কসীয় মতবাদকে ইসলামের লেবাস পরিয়ে দিয়ে এই দেশে প্রবর্তন করাকে ইসলামের বড় খেদমত মনে করেন। তারা এর নাম দিয়েছিলেন ইসলামী সমাজতন্ত্র। ষাটের দশকে এদের দাপট খুব বেশি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া ও চীনের পুঁজিবাদে ফিরে আসার পর এদের শক্তি এখন নাই বললেই চলে। আবার এমন কিছু লোকও আছেন যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেমনটি আছে তেমনটি থাকতে দিয়েই মদ, জুয়া, বেশ্যাবৃত্তি, সুদ ইত্যাদি ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দিয়ে অথবা এগুলোর উপর কৌশলী নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একজন ধর্মমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করলেই রাষ্ট্র ইসলামী হয়ে যাবে বলে মনে করেন।
ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের এই ভিন্ন ভিন্ন ধারণার ফলে দেশের ভবিষ্যত নেতৃবৃন্দ তথা যুব সমাজের বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। অধ্যাপক হোসাইন আসকারীর গবেষণা কর্মটি অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে আরো বেশি বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। অবশ্য অধ্যাপক আসকারী একটা কথা যথার্থভাবে বলেছেন যে, ইসলাম নিছক একটি ধর্ম নয়, একটি জীবনব্যবস্থা। তবে তিনি পাশ্চাত্য দেশসমূহের কিছু মানবিক গুণের অনুসরণকে ইসলামী অনুশাসনের অনুসরণের যে কথা বলেছেন, তা সঠিক নয়। পাশ্চাত্যে যে ধর্মের ধারণা তা হচ্ছে  স্রষ্টার উদ্দেশে পূজা উপাসনায় নিবেদিত কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানের নাম। ব্যক্তি জীবনে পূজা-পার্বন ও কতিপয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ছাড়া তাদের ধর্মে আর কোনো নির্দেশ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খৃস্টান প্রভৃতি সকল ধর্মই এখন আচারসর্বস্ব। এসব ধর্মের অনুসারীরা ব্যক্তি জীবনে স্তবস্তুতি করার পর ধর্মমুক্ত। সমষ্টিগত জীবনে ধর্মের নাক গলাবার কোনো এখতিয়ার নেই।

আরও পড়ুন-রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট করবেন যেভাবে ।। পর্ব -১

ইসলামী জীবনাদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করার পর মানুষের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক  নিয়ম প্রথা, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, তাহজিব-তমদ্দুন, চালচলন, কথাবার্তা ইত্যাদি সকল বিষয়ে খোদায়ী নির্দেশ তথা ইসলামী অনুশাসনের আনুগত্য করতে হয়। এই আনুগত্যোর জন্য একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা হয় না। যারা ইসলামী জীবনাদর্শে বিশ্বাস করেন না, তারা মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না; মুসলিম প্রধান দেশ হলেই ইসলামী রাষ্ট্র হয় না। ইসলামী রাষ্ট্র হতে হলে তার কতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে :

ক) সার্বভৌমত্ব :

১) সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি। সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যক্তি, গোত্র, শ্রেণি বা বিশেষ জনসংখ্যা সার্বভৌমত্বের অধিকারী। যেমন মুসলিম প্রধান হলেও বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু ইসলাম তা অনুমোদন করে না। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একমাত্র আল্লাহই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। দুনিয়ার বিভিন্ন মুসলিম ও অমুসলিম দেশে কর্মরত ইসলামী আন্দোলন সংস্থাগুলোর গঠনতন্ত্রে আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে তাদের ঘোষিত আকিদার অন্তর্ভুক্ত করায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন আদালতের দোহাই দিয়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, কেননা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ। মুসলিম বিশ্বে যারা পশ্চিমা গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করে তাদের প্রায় সকলেই জনগণের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সৌদি আরব একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। রাজতন্ত্রে রাজা বা বাদশাহই হচ্ছেন সার্বভৌমত্বের মালিক। অবশ্য সৌদি সরকার তাদের ইসলামী বলে দাবি করে। তাদের Motto হচ্ছে কালিমা : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। তাদের কোনো স্বতন্ত্র সংবিধান নেই। ১৯৯২ সালে সৌদি বাদশাহ এক রাজকীয় ফরমান জারি করে কুরআন ও সুন্নাহকে তার দেশটির সংবিধানের আইনগত (Dejure) মর্যাদা দিয়েছেন। দেশটি বাদশাহর মন্ত্রী পরিষদ, শূরা ও ওলামা কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত, সার্বভৌমত্বের বিষয়টিকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে এবং মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বকে যাবতীয় জুলুম-অত্যাচার ও অন্যায়-অবিচারের মূল কারণ হিসেবে গণ্য করে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আর কোনো শক্তি নেই। আইনদাতা, বিধানদাতা নেই। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে তার ইবাদাত এবং তার প্রতিটি কাজের জন্যই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবে।

পবিত্র কুরআনের সূরা ইউসুফের ৪০নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ ছাড়া আদেশ করার আর কেউ অধিকারী নয়। তিনিই আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অপর কারুর দাসত্ব করা চলবে না, আর এটাই হচ্ছে জীবনযাপনের সঠিক পন্থা।’ সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সতর্ক হও, তার সৃষ্টিতে তারই হুকুম চলবে।’

২) সরকার ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক ইসলামী রাষ্ট্রের এটা হচ্ছে দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। এই সম্পর্ক আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর তার রাসূলের ও তোমাদের মধ্যে আদেশ দানকারী দায়িত্বশীল লোকদের। কোন বিষয়ে তোমাদেরও পারস্পরের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তা আল্লাহ ও রাসূলের (সা.)-এর দিকে ফিরিয়ে দাও।’ (সূরা আন নিসা : ৫৯)।
আনুগত্য করতে হলে নির্দেশ ও নিদের্শনার প্রয়োজন। এই নির্দেশ ও নির্দেশনা পবিত্র কুরআন ও রাসূলের  সুন্নাহর মধ্যে পাওয়া যাবে। এর আলোকে রাষ্ট্রের পরিচালকরা যে নির্দেশনা দেবেন তা মেনে চলতে হবে। তবে এখানে একটি বিষয় জানতে হবে এবং সেটা হচ্ছে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ মানা তথা আনুগত্য করা শর্তহীন, রাষ্ট্র নেতাদের বা সমাজপতিদের নির্দেশ মানা শর্তযুক্ত। এর অর্থ হচ্ছে তাদের নির্দেশ ততক্ষণ মানা যাবে যতক্ষণ তা আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশের পরিপন্থী না হবে। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) কর্তৃক বিদায় হজ্বে প্রদত্ত তার ভাষণে নির্দেশনাও স্পষ্ট। তিনি বলেছেন যে, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এইগুলো হচ্ছে আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ। যতদিন তোমরা এগুলো আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমাদের কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারবে না।

আরও পড়ুন-মানুষের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে কুরআনে উল্লেখিত মন্তব্য

খ) উদ্দেশ্য ও ভাল মন্দের মানদণ্ড

এখানে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেক্যুলার রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন। সেক্যুলার রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ইচ্ছা পূরণ। তারা যদি শরাব পান করাকে ভালো মনে করে তবে তা ভালো বিবেচিত হবে। বেশ্যাবৃত্তি, জুয়া কেসিনোর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উপযোগী মনে করে তাহলে এই ব্যবসাগুলোর প্রসারের জন্য সরকারিভাবে লাইসেন্স দেবে। এগুলো সমাজের জন্য কল্যাণকর কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য তাদের নিকট স্থায়ী কোনো মানদণ্ড নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একবার মদ পান, উৎপাদন ও বিক্রয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বছর না যেতেই জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছানুযায়ী এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হয়। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রে প্রকৃত মালিক আল্লাহর ইচ্ছা পূরণ ও তার সন্তুষ্টি অর্জন।

সূরা হজ্জে আল্লাহ পরিষ্কার বলেছেন, ‘(যারা মুমিন) তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত প্রবর্তন করে, নেক কাজের আদেশ দেয় এবং অন্যায় ও অকল্যাণ কাজ থেকে সকলকে বিরত রাখে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমার রাসূলদিগকে সুষ্ঠু প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে কিতাব ও মানদ- প্রেরণ করেছি যেন তারা মানুষের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।’

রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যের পরই আসে রাষ্ট্রের মর্যাদার প্রশ্ন। ইসলামী রাষ্ট্র একটি খেলাফত। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তার খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। খলিফা মালিক নন, বরং মালিকের অধীনস্থ ব্যক্তি। মনিবের আনুগত্য স্বীকার করে তারই বিধি-নিষেধের আওতায় মনিবের আদেশ নিষেধ কার্যকর করা তার কাজ। খেলাফত যেহেতু সার্বজনীন সেহেতু এর পরিচালককে অবশ্যই নির্বাচিত হতে হয়। যতক্ষণ তিনি জনগণের আস্থাভাজন থাকবেন ততক্ষণ তিনি খলিফা। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের নামে জনগণের উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়নি। আইনের শাসন ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আইন সকলের জন্য সমান। এখানে পদস্থ লোকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না।

ব্যক্তি স্বাধীনতা, সরকারের সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ইসলামী রাষ্ট্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। এখানে বিনাবিচারে কাউকে আটক রাখার বিধান নেই। তা বেআইনি। এই রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান রয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রভৃতি সার্বজনীন মৌলিক অধিকারের নিরাপত্তা এই রাষ্ট্র দিয়ে থাকে। এখানে অমুসলিমরাও বাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং রাষ্ট্র তাদের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বেশ কিছু ভালো কাজ করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, ক্ষেত্র বিশেষে বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু জনহিতকর কাজ। এসব দেশের বেশির ভাগ মানুষ পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, পণ্যমানের ব্যাপারে সতর্ক এবং মান ও পরিমাপের ব্যাপারে মানুষের সাথে প্রতারণা কম করে। তাদের মধ্যে মিথ্যাচারও কম দেখা যায়। এগুলো স্বাভাবিক মানবিক গুণ। ইসলামও এই গুণাবলীকে সমর্থন করে। ঐ দেশসমূহের বাসিন্দাদের এই গুণগুলোকে ইসলামী আখ্যা দিয়ে মুসলিম দেশসমূহের বাসিন্দাদের সাথে পাইকারীভাবে তুলনা করা সমীচীন নয়। মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কি আছে। ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সরকার ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করছে। সৌদি আরব যদিও রাজতন্ত্র তথাপিও সেখানে শাসন ব্যবস্থায় ইসলামের কিছু প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে শিক্ষা ও চিকিৎসা সুযোগ ফ্রি। অন্যান্য দেশগুলোতে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী চরিত্র ও আচার-আচরণের অভাব প্রকট। এই দেশগুলোর অধিকাংশই বৃটিশ, পর্তুগীজ, ফরাসী, স্পেনিশ ও মার্কিনীদের কলোনী ছিল। এই সময় তারা এই দেশগুলোর ইসলামী চরিত্রকে শুধু ধ্বংসই করেনি, শিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে মুসলমানদের সন্তানরাই এখন ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন-নারীবাদ প্রাচ্যকেও যেভাবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেবে

ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে অধ্যাপক আসকারী যে অমুসলিম দেশগুলোকে শীর্সে স্থান দিয়েছেন সে দেশগুলোর শতকরা প্রায় একশ’ ভাগই খৃস্টান অধ্যুষিত। তাদের নিজেদের সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের অবস্থা কি তা গবেষণায় আনা হয়নি। যৌনাচার ও সমকামিতা এসব দেশে ব্যাপক’ আইন করে তারা সমলিঙ্গের বিয়েকে বৈধ করেছে। কোন ধর্মের অনুশাসনে এটা বৈধ? এই দেশগুলোর মধ্যে কিছু কিছু দেশ আছে যারা দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যশস্য দুধ প্রভৃতির মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য অমানবিকভাবে লাখ লাখ টন সমুদ্রের পানিতে ডাম্পিং করে। দরিদ্র দেশগুলোতে সেগুলো বণ্টন করলে কোটি মানুষ বাঁচতে পারতো।

তাদের অস্ত্র প্রতিযোগিতা, মদ ও মাদকাসক্তি, জুয়া কেসিনো প্রভৃতির ন্যায় অনৈতিক কাজ বিশেষ করে বিবাহ বহির্ভূত লিভ টুগেদার, কুকুর সংস্কৃতি, কুকুর নিয়ে রাত্রি যাপন প্রভৃতি মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের দেশে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, পারিবারিক বন্ধন বলতে কিছু নেই বললেই চলে। বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সংস্কৃতি এসব দেশে জারজ সন্তানের সংখ্যা বৈধ সন্তানের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই অবস্থানগুলো পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস হবার জন্য যথেষ্ট এবং ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। এই শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য ইসলামী আন্দোলনগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন