Ads

ইসরাইল-ফিলিস্তিন বর্তমান সংকট ঘিরে রাজনীতির খেলা

এম আর রাসেল 

ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইল উপর্যুপরি বোমা হামলা করছে। প্রাণহানি ঘটছে, অনেক মানুষ আহত হচ্ছে। এ হামলা কতদিন চলবে তা দেখতে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। হামলা শুরুর পর থেকেই বিশ্ব কূটনৈতিক মঞ্চ জমজমাট হয়ে উঠে।

বিশ্ব পরাশক্তিরা একদিকে উত্তেজনা কমাতে আহবান জানান, অন্যদিকে উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে গোপনে অস্ত্র সহায়তা, গোয়েন্দা সরবরাহ করেন। সাধারণ জনগণের প্রাণবায়ু কেড়ে নিয়ে স্বার্থ আদায়ের খেলায় মেতে উঠেন। মানবিক গল্পের সুর ছড়িয়ে রচনা করেন শ্রেষ্ঠতম অমানবিক ছায়াছবি।

বিশ্ব মানবতাবাদীরা এমনি মানবিক গল্প ছড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের ভূ-খন্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। হলোকাস্ট এর নির্মম সুর ছড়িয়ে মানুষকে সমব্যথী করেছেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে হিটলারীয় হলোকাস্টের চেয়ে ভয়াবহ হলোকাস্টের জন্ম দিয়েছেন। যা এখনও চলমান রয়েছে।

ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় এটা নির্জলা সত্য কথা। তবে একেবারে নয়, ধীরে ধীরে নানা পরীক্ষা চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চায়। এজন্যই প্রতি বছরের কোন না কোন অজুহাতে হামলা চালায়। সাম্প্রতিক সংকট ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলেরই অংশ এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের সূচনা, এর প্রধানতম কারণ এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা সকলেই জানি ফিলিস্তিনিদের দুঃখগাথা। বিগত ৭৩ বছর যাবত ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূ-খণ্ডেই আশ্রিতের মতো জীবনযাপন করছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আমাদের দেশে ফিলিস্তিন ব্যাপারে সবার মাঝে একই সুর বাজে। স্বাধীনতার পরপরই প্যালেস্টাইন বাংলাদেশ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বাংলাদেশে প্যালেস্টাইন দূতাবাসও রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেও এ ব্যপারে একই নীতি দেখতে পাওয়া যায়।

১৯৭৩ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশ ত্রাণ সহায়তা ও মেডিকেল টিম প্রেরণ করেছিল। ১৯৭৪ সাল ওআইসি সম্মেলনে ইয়াসির আরাফাত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বৈঠক হয়। ১৯৮৮ সালে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র ঘোষণার পর ১৩৭ টি দেশ সমর্থন দিয়েছিল এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই বছরে ইয়াসির আরাফাত বাংলাদেশ সফর করে।

১৯৮০ সালে প্যালেস্টাইন যোদ্ধাকে সাহসী আখ্যা দিয়ে ও আল আকসা মসজিদকে চিত্রিত করে ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসের রিপোর্ট মতে ১৯৮৭ সালে PLO – এর পক্ষে ৮০০০ বাংলাদেশি তরুণ স্বেচ্ছাসেবী অংশ নিয়েছিল। এমনকি বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীতে ফিলিস্তিনি তরুণেরা প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।

দুঃখের বিষয় হল ফিলিস্তিনিরা যোগ্য নেতার অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই অশান্তির আগুনে পুড়ছেন। হতভাগা এই মানু্ষগুলোকে নিয়ে সবাই এক গ্রেট গেমে মেতেছেন। আরব রাষ্ট্রগুলো মুখে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা দেখালেও কার্যকর কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। অনেকে বলতে পারেন আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

এ পর্যন্ত আরব ও ইসরাইলের মধ্যে ৫ টি যুদ্ধ হয়েছে। বলতে গেলে সব কয়টি যুদ্ধেই ফিলিস্তিন ছিল গৌণ বিষয়। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল অংশগ্রহণকারী আরব রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩, ১৯৮২ সালে সংঘটিত যুদ্ধগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠে। আর এখন তো অনেক আরব রাষ্ট্র প্রকাশ্যেই বলে থাকেন ইসরাইলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার রয়েছে।

এই দাবিটা আসলে ইসরাইলের হাসাবারার প্রডাক্ট। হাসবারা হল একটি টার্ম যা মূলত ইসরাইলি প্রপাগাণ্ডা ছড়ায়। এটা ইসরাইলি কূটনীতিরও প্রধান ভিত্তি। ইসরাইল রাষ্ট্রের ব্যাপারে ইতিবাচক তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার ফর্মুলাই হল হাসবারা। যেকোনো জাতিরই টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। এজন্য কোনো ভূমিদস্যুদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না।

এটা জানা কথা নিজের কাজ অপরকে দিয়ে করানোর প্রত্যাশা করার মতো বোকামি আর নেই। তাই ফিলিস্তিনিদের নিজেদেরকেই শক্তিশালী হতে হবে। তবে হতাশার দিক হল এখানে ফিলিস্তিনিরা ব্যর্থ। হামাস-ফাতাহ দ্বন্ধ, ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের করুণ অধ্যায় প্রভৃতি ঘটনা বলতে গেলে ইসরাইলকেই শক্তিশালী করেছে।

ইসরাইল যে নৃশংস উপায়ে ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা চালিয়ে আসছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একদিকে ইসরাইল ভূমি দখল করছে, অন্যদিকে নানা ধরণের অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য গিনিপিগ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ব্যবহার করছে ইসরাইল। রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারেরও কথাও শোনা যায়। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য ফোর্থ ইন্টারন্যাশনাল ২০০৬ সালে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল ইসরাইল লেবানন ও গাজায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে।

২০০৮, ২০০৯ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপর শ্বেত ফসফরাস ব্যবহার করেছিল। যা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। এখানে ‘Skunk Water‘ ব্যবহারের কথাও বলা যায়। ২০০৮ সালে ইসরাইল প্রথম এই অস্ত্র ব্যবহার করে। সম্প্রতি এই অস্ত্র প্রয়োগের খবর পাওয়া গেছে। এই পানীয়কে নর্দমার ময়লার চেয়েও অধিকতর খারাপ বলে অভিহিত করা হয়।

দুর্গন্ধযুক্ত এই পানীয় স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করে, তীব্র বমির উদ্রেক করে। ইসরাইলি কোম্পানি Odortec এই অস্ত্র তৈরি করেছে। কোম্পানির সেফটি শিট-এ বলা হয়েছে এটি ত্বক জ্বালাপোড়া, চোখ ও তলপেটে ব্যথার সৃষ্টি করে। ফিলিস্তিনিরা বলছে এটার মাথার চুলও পড়ে যায়। উচ্চ ডোজের ব্যবহার প্রাননাশ করতে পারে। এত কিছুর পরও পশ্চিমা বিশ্ব নীরব ভূমিকা পালন করে। ইরানের ন্যায় নতুন কোনো অপারেশন রেড ডন পরিচালনা করে না।

যাই হোক সাম্প্রতিক সময়ের হামলার রাজনৈতিক দিকটা নিয়েও কিছুটা আলাপ করা যাক। নেতানিয়াহু ও হামাস উভয়ই এই হামলাকে পুঁজি করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে বলে অনেক বিশ্লেষক মত দিয়েছেন। এখানে হামাস বেশ কিছুটা ফলও হয়েছেন বলে অনেকেই মত দিয়েছেন।

ইসরাইলে গত দুই বছরের মধ্যে ৪ টি নির্বাচন হয়েছে। কোনো নির্বাচনেই একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সর্বশেষ নির্বাচনেও নেতানিয়াহু সরকার গঠন করতে পারেননি। নেতানিয়াহু সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করছেন ক্ষমতা ধরে রাখতে। কারণ ইতোমধ্যে তার উপর ঘুষ গ্রহণ, জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আরোপিত হয়েছে। এখন ক্ষমতাচ্যুত হলে তাকে তার পূর্বসূরি এহুদ এলমার্টের মতো জেলে যেতে হবে।

এসব দিক মাথায় রেখে ধুরন্দর নেতানিয়াহু ধর্মান্ধ ইহুদী গোষ্ঠীকে লেলিয়ে দিয়েছেন অস্থিরতা তৈরি করতে। এই নিউ-ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদের নানাভাবে হেনস্তা করে থাকে, ভয় দেখিয়ে তাদের সম্পদ লুন্ঠন করে। এদেরকে সর্বদা প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে থাকেন নেতানিয়াহু। এই সব বর্ণবাদী ফ্যাসিস্টদের সহায়তায় কোয়ালিশন গঠন করে নেতানিয়াহু সরকার গঠন করতো। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফ্যাসিস্টরা মাত্র ৬ টি সিটে পেয়েছে।

ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সেখ জাররাহ এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গনে অরাজকতা সৃষ্টি করতে মদদ দিয়েছেন। আবার মে মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফিলিস্তিনের নির্বাচনের ব্যাপারেও ভেটো দিয়েছেন। এসব কারণ বিশ্লেষণ করলে বর্তমান ঘটনার ভিতরের কারণগুলো স্পষ্ট হয়ে যায়। ক্ষমতাপিপাসু শাসকেরা বরাবরই সাধারণ জনগণের রক্তের উপরেই নিজের স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ে তোলেন।

ফিলিস্তিনের বর্তমান সংকট হামাসকে বিরাট এক সুযোগ এনে দিয়েছে। হামাসের রকেট হামলায় ফিলিস্তিনরা উজ্জীবিত হয়েছেন। তারা তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে একমাত্র হামাসকেই দেখছেন। কেননা মাহমুদ আব্বাস সরকার ফিলিস্তিনিদের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইসরাইলের আক্রমণ প্রতিহত করে সাধারণ জনগণের পক্ষে তাদের দাড়াতে দেখা যায়নি। পক্ষান্তরে হামাস জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রকেট হামলা পরিচালনা করছে। এর ফলে হামাসের জনসমর্থন পূর্বের তুলনায় বেড়েছে।

বিভোক্ষকারীরা মাহমুদ আব্বাসকে যুক্তরাষ্ট্রের চর ও ইসরাইলের সহযোগী আখ্যা দিয়ে শ্লোগান দিয়েছেন। এতদিন ধরে গাজায় হামাস ও পশ্চিম তীরে ফাতাহ শাসন করছে। এবার পশ্চিম তীরেও হামাসের পক্ষে সমর্থন বাড়বে। বর্তমান সংকট শেষে নির্বাচন হলে জনগণের সমর্থন হামাসের দিকেই বেশি থাকবে এটা আন্দাজ করা যায়। মজার ব্যাপার হল হামাস প্রতিষ্ঠার ইসরাইলের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আর এখন হামাস ইসরাইলের প্রধান শত্রু। যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী দলভুক্ত করেছে।

ফিলিস্তিনে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে। এ বছর ২২ মে ও ৩১ জুলাই নির্বাচনের কথা ছিল। বর্তমানে এই নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনায় হামাসের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে ফিলিস্তিনে হামাস একটি প্রধান শক্তি। জেরুজালেম রক্ষা ও স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত হামাস সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। ‘জেরুজালেম হল আমাদের ভবিষ্যত’ এই থিম ফিলিস্তিনিদের মাঝে ছড়িয়ে সমর্থন আদায়ে কাজ করে যাচ্ছে হামাস।

সাম্প্রতিক রকেট হামলা যদিও ইসরাইলের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না, তবুও এর মধ্য দিয়ে হামাসের শক্তি প্রকাশ পেল। ফিলিস্তিনিরা এখন হামাসের চোখে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। হামাসের মাধ্যমেই জেরুজালেম রক্ষার সংগ্রাম চলতেই থাকবে। এর শেষ কবে হবে কেউ জানে না……..

 

আরও পড়ুন