Ads

আমি নসিমন -ডার্ক এভিল(এইচ বি রিতা)

আমি নসিমন
ডার্ক এভিল(এইচ বি রিতা)

পর্ব -০১. বিলাপঃ
একটা সময়ের পর, প্রতিটা মানুষই বোধহয় খুব একা হয়ে যায়। সে সময়টা ঠিক কখন বলা মুশকিল। এমনও হতে পারে, মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির শুরুটাই একাকীত্বের শুরু। কিংবা আংগুলের কড় গুনে হিসাব নিকাশ বুঝতে পারাটাই হতে পারে একাকীত্বের শুরু।
একাকীত্ব মানেই কি মানুষহীন, সঙ্গীহীন একা? জনমানবহীন অরণ্য বুকে ধারণ করা খুব জরুরী কি? নাহ, তা না। একাকীত্ব আমরা ধারণ করি বুকে, শূন্যতার ঠিক অতলে যেখানে বিষাক্ত কাদায় মাখামাখি হাঁটুজল থৈ থৈ। এর জন্য নির্জনতার প্রয়োজন হয়না। মানুষ হাজারো সুখের ভিরে নিজেকে একা আবিস্কার করতে পারে। লোকালয়ে শতক মানুষের ভিরে নিজেকে একা অনুভব করতে পারে। একাকীত্বের জন্য লোকালয় বা নির্জনতা, সুখ বা দুঃখ আপেক্ষিক নয়।
আমাদের মন একটি খোলা স্কুল ঘর। এখানে জ্ঞান আহোরণ হয়, বিতরণ হয়। পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় নীতিমালা, সংস্কার ও নৈতিক মূল্যবোধের দীক্ষা ছড়ানো হয়। বীজ পুতা হয় উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও সুখ-সাফল্যের। কিন্তু সেই খোলা স্কুল ঘরে, বেতাগীর সুমন বিশ্বাসের মত বিষাক্ত কীট, অন্যায়, পাপ, অপরাধ, আকাঙ্খা কখন যে নিজের লিপ্সা পূরণে লেজ সুরসুর করে সবার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়ে, তা কেবল সময়ের দাবী। তারপরই নষ্ট হয় মন, স্কুল ঘরটির মত! আর মনকে ধারণ করা মানুষ হয় বিপর্যস্ত, নিঃস্ব ঠিক বেতাগীর শিক্ষিকাটির মত।
আর এমনই সূবর্ণক্ষনে একাকীত্ব সুযোগ বুঝে নিজের জায়গা করে নেয় বিপর্যস্ত তিক্ত মনে।
মনের কোন সীমানা নেই। শেষপ্রান্ত বলে কিছু নেই। আয়তন-ঘনত্ব-আকার বা দরজা জ্বানালা নেই। একাকীত্ব এখানে হুটহাট ঢুকে পড়ে, তারপর অবাধে বিচরণ করে।
হোক রাজ পালঙ্কে কারো বাস! হোক পাশে পড়ে থাকা সুখের সম্পর্ক! সবকিছুর অলক্ষ্যে একাকীত্ব ঠিকি শুয়ে পড়ে দু’টি প্রাণের মধ্যখানে। তারপর দুঃখ গুলো জেগে উঠে কারণে অকারণে। মনের ঘরে অস্থিরতা হেটে বেরায় ঝুনঝুন শব্দে। দামী পালংকে শুয়েও, নির্ঘুম রাত কাটে । সযত্নে পাশে রক্ষিত ভালবাসার হাতের স্পর্শে তখন আর শিহরন জাগেনা।
এ তো গেল “সুখে থেকেও ভূত দেখা”র পালা। কিন্তু যার সুখ নেই? রাজপালঙ্কে পাশে শুয়ে থাকা ভালবাসার স্পর্শ নেই? তার জন্য একাকীত্ব কি তবে বিনা নিমন্ত্রনে খোলা বারান্দায় আসন পেতে বসা নয়?
যিনি অতিমাত্রায় আহার করায় পেটের পীড়ায় হাঁফসাফ করছেন রাতভর, চোখে ঘুম নেই, তার চেয়ে বরং খেতে না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় হাঁফসাফ করে নির্ঘুম রাত পাড়ি দিচ্ছেন যিনি, তার যন্ত্রনা, তার পীড়া কি বেশী নয়? এ কেমন বিচার? কেউ খাবে! কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে!

মন বড় অদ্ভুত অদৃশ্য নিরাকার এক বস্তু। এ মন কারণে অকারণে ব্যকুল হয়। একাকীত্ব থেকে পালাতে হাড়িয়ে যাওয়া অতীত খুঁজে খুঁজে পাগল হয়। ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতো জোড়া দেওয়ার বৃথা চেস্টা করে। আলো না আঁধার ঠিক বোঝেনা, নিঃস্বঙ্গতা এড়াতে চোখ বুজে সোনার হরিণের খুঁজে এদিক ওদিক ছুটে। নীতিজ্ঞানের পাপ-পূন্যের গভিরতা খতিয়ে দেখেনা।
মানুষ বড় নির্লজ্জ্ব। সুযোগ পেলেই নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পর্কের শোকে, জীবন্ত সম্পর্কগুলোকে জ্যান্ত পুতে ফেলে। যা হাড়িয়েছে, যা অতীত, যা মুছে গেছে চিরতরে, তার খুঁজে মধ্যরাতে কষ্টবিলাসী হয়ে উঠে। তারপর বুকের এপাশ ওপাশ হাতড়িয়ে মরে! কোথায় তার ব্যাথা! বুকের ঠিক কোনখানটায় নীলচে জমিনে পোকামাকরের আনাগুনা, ঠিক বুঝে উঠেনা।

অবশেষে আমিও জেনে যাই মানুষ বড় একা! মন খারাপের একা রাতে আনমনে পথে নামি। দেখি রাস্তা সরে যায় দুর থেকে দুরে। সারি সারি গাছের আড়ালে নৈঃস্বর্গিক নিঃসঙ্গতা হাত বাড়িয়ে ডাকে। আমি নিশ্চল; এগিয়ে যাই এক পা দু’পা! পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়; তবুও হেঁটেই যাই।
নীরবতার কথোপকথন শুনি কান পেতে। চুপিচুপি রাত এসে পাশে দাড়ায়! আচমকা আকাশ কেঁদে উঠে হু হু ! আকাশের বুক ফেটে দুঃখ ঝড়ে পরে আমার মুখে, আমার বুকে! আমি মৃদু হেসে উঠি; জীবন্ত পোস্টার হয়ে দুঃখ লেগে যায় আমার গায়ে! মাঝে মাঝে মাঝরাতে চোখ মেলে বড্ড বিষন্ন লাগে! আত্মার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা নির্লিপ্ত সমঝোতা টের পাই। ভালো লাগেনা হুটহাট এমন জেগে উঠা! চাইলেই কি এড়ানো যায়?

মনে পড়ে, দাদীমা বলতেন, এই জীবনের হকদার আমরা নই। আমরা ক্ষনিকের মেহমান মাত্র! এসেছি এক উদ্দেশ্য নিয়ে, যেতে হবে উদ্দেশ্য পূরণ করে। এর বাহিরে যা কিছু, সব মিথ্যা।
বিশ্বাস করেছি। দাদীমা তো ভুল বলেননা! কিন্তু অযাচিত মনে প্রশ্ন বার বার উকি দিয়ে যায়। যতি তাই হবে, তবে ক্ষনিকের এই অতিথীদের তিনি মিথ্যে সংসারে এত পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করার মত বুদ্ধি দিলেন কেন?

****
আমি নসিমন

পর্ব-০২.পোকা
——
মাথার অসুখটা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অসুখ নিয়ে সুখের নাগাল অসম্ভব। অসুখটার কি নাম দেয়া যায়? ঘুন পোকা অসুখ? অসুখটা ঘুন পোকাদের মত মগজ গর্ত করে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। মগজের ক্ষতি সাধন করছে রোজ একটু একটু করে। শর্করাযুক্ত অংশটুকু খাচ্ছে চেটেপুটে। বিনা নোটিশে হুটহাট মাঝ রাতে অসুখটা বেড়িয়ে আসে টিপ টিপ পায়ে! তখন ১ মিলিমিটার প্রশস্ত গর্ত করে দেয় আমার মগজে। অসহ্য ব্যাথায় তারপর সেই গর্তে শূন্যস্থান পূরণে কিলকিল করে অসংখ্য উদ্ভট চিন্তা! অসুখটা মগজে গর্ত খুঁড়ে বেড়িয়ে এলেই আমি ভিন্ন মানুষ! আলো থেকে দূরে, বাস্তবতা থেকে দুরে। তখন আমি অন্য কেউ। অসুখটা মগজের বিনাশ করছে। টের পাই। কিছু করার নেই।
অসুখটা বেড়িয়ে এলেই মনে হয়, এই যে ঈশ্বরের নামে এত উপাসনা, এত সমযোতা, এত ব্যাকুলতা, তাহলে সেই ঈশ্বরকে আমরা দেখিনা কেন? গীতার লাইনটি বার বার কানে বাজে। “অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।” তবে কি মায়া বা অহং আকাশের মেঘস্বরুপ? মেঘ সরে গেলেই যেমন সূর্য্যের দেখা পাই, মন থেকে অহংবুদ্ধি সরে গেলেই কি তবে ঈশ্বরদর্শন হবে?
এ তো সহজ নয়! আমিত্বকে কি করে সরানো যায়? আর মায়া? আমিত্ববোধের পাশেই তো মায়ার বাস! ঈশ্বর তবে আমার “আমি”কে জানার জ্ঞান দিলেন কেন? মায়া বাঁধা সংসার দিলেন কেন? এত প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে ঈশ্বরদর্শন সহজ কি?
বুঝিনা! বুঝিনা! ক্ষুদ্র জ্ঞানে বেশী দূর এগুতে পারিনা। জ্ঞান খেয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ঘুন পোকা অসুখ!
পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের মাঝে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর। অথচ মানুষকে এই “মানুষ” হতে সাধনা করতে হয়। সাধনাহীন মানুষ পশু! মানুষ আর পশু চেনার উপায় কি? আকার, আকৃতি, অবস্থান সব তো এক।
দাদীমা বলতেন, আত্ম বৈশিষ্ট্য নয়, বিচক্ষন অন্তদৃষ্টি ও মস্তিষ্ক দিয়ে মানুষকে বুঝার চেষ্টা করবি। তবেই মানুষ চিনবি। অন্তদৃষ্টি যদি নির্ভর করে মস্তিষ্কের বিচার ক্ষমতার উপর, তবে আদৌ আমার মানুষ চেনা হবেনা। আমার মস্তিষ্ক খেয়ে যাচ্ছে ঘুন পোকা অসুখ!
পৃথিবীর মানুষ গুলো বড় অদ্ভুত! তার থেকেও অদ্ভুত তার গতিবিধি। মানুষের মাঝেই যত রহস্য, যত জটিলতা-অস্বাভাবিকতা! প্রায়ই ভাবি! ভেবে ভেবে চশমাটায় ধুলী জমে। ভেবে ভেবে কুঁমড়ো মাঁচায় ফুল থেকে জীবন বাড়ে। ভেবে ভেবে আঙুল সমান কড়ুই গাছটার তলে সুর্য্য ঢলে পরে। ভেবে ভেবে গোছা গোছা রেশ্মী কালো চুলে শুভ্র মেঘদুত খেলা করে যায়। ভেবে ভেবে দুই পা থেকে চার পা-ছয় পা বাড়ে, তবুও মানুষের স্বরুপ চেনা হয়না! রহস্য উন্মোচন হয়না!
সারাটা জীবন মানুষের মাঝে বিভক্ত মানুষ খুঁজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছি। বিভক্ত মানুষের খুঁজে অমানুষ হয়েছি কতবার! তারপরই জানলাম, খালি চোখে যা দৃশ্যমান, তা সত্য নয়। সত্যের আড়ালে মানুষ ধারণ করে অগনিত মিথ্যা! কখনো সেটা নিজের প্রয়োজনে, কখনো স্বভাবগত কারণে। মানুষগুলো বোঝেনা, একদিন পৃথিবীর সকল অনাচার ধ্বংস হবে। মানুষ ধ্বংস হবে! কষ্ট বলে কোন নিরাকার বস্তু বা বায়বীয় স্পর্শ থাকবেনা পৃথিবীতে। যা থাকবে, তা কেবল কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন।
তারপরই মনে হয়, আমি কি নিজেকে খুব চিনি? আমার “আমিত্ববোধ”কেই এখনো চেনা হয়নি। আমি জানিনা আমি কে!
জগতের প্রতিটি সত্তার আমিত্ববোধ ক্রিয়াশীল। যদি জড় ও জীবের আমিত্ববোধের পার্থক্য নির্ণয় হয় পরিমানগত, রূপগত ও গুনগত বৈশিষ্টে, যদি আমিত্ববোধ ছাড়া স্বত্তার কোন অস্তিত্ব না থাকে, তবে আমার ও অস্তিত্ব নেই। কিংবা এমনও হতে পারে, আমিত্ববোধ বিলুপ্তির কারণে আমার অস্তিত্বের বিনাশ ঘটেছে! অসম্ভব নয়। একক সত্তা কখনো কখনো বহু সত্তায় বিভক্ত হয়ে বহু আমিত্ববোধের সৃষ্টি করে। আর সেই একক সত্তার বিভক্তির সাথে সত্তার আমিত্ববোধের বিলুপ্তি ঘটে। বিলুপ্তপ্রাপ্ত আমিত্ববোধ তবে কোথায় সন্চালিত হয়?
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে! মনে হচ্ছে অসুখটা মগজে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে! টের পাচ্ছি মৃদু আন্দোলনে পোকারা দল বেঁধে ঢুকে পড়ছে নিজ বাসস্থানে! এরপর ওরা ঘুমিয়ে পড়বে। ওরা ঘুমালেই নসিমন শান্ত হবে! দীর্ঘ রাতভর উলটপালট সকল ভাবনা উড়ে যাবে অসীম শূন্যতায়। কিছুই মনে থাকবে না! নসিমন ঘুম ভেঙ্গে আবারো ছুটবে জীবিকার তাগিদে শহরের পথে। গাল ভরে হেসে কথা বলবে, রান্না করবে, বাজার করবে। সন্ধ্যা হতেই জ্বানালার পাশে চায়ের কাপে ঠোট রেখে খাতা কলম টেনে নিবে। শূন্যতা বুকে বিশাল আকাশের গায়ে হিসাব মিলাবে! চাল-২ কেজি, ডাল-১কেজি,পটল-আধা কেজি, তেল-………..!
লেখিকা -এইচ বি রিতা
পেশায় শিক্ষক হলেও কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী হিসেবে সমাদৃত । প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নিয়মিত লেখিকা তিনি, সোস্যাল মিডিয়াতে লেখিকা তিনি ডার্ক এভিল নামে পরিচিত ।

আরও পড়ুন