Ads

রাদিয়ার চুপকথা

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত ছোটগল্প:

“রাদিয়ার চুপকথা”
সুস্মিতা মিলি

বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন রায়হান সাহেবের স্ত্রী ইশিতা ।তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে দুই ছেলে রাফি আর রাহান।তাদের চোখে অঝোর ধারায় ঝরছে অশ্রু। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা চার বছর আগে ঘটে যাওয়া ছোট বোনের মৃত্যুটা দূর্ঘটনা ছিলোনা। এটা একটা খুন ছিলো।খুন।

দুইটা ছেলের পর যখন মেয়ে রাদিয়া হলো ইশিতার সংসারে নেমে এলো খুশির প্লাবন। ফুটফুটে সুন্দর টুনটুনির মতো মেয়েটা যে এত সুখ নিয়ে আসবে ইশিতা ভাবতে পারেনি। সেই সুখ যেন সইলনা কপালে।মাত্র আঠারো মাস বয়সে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে রাদিয়া চলেগেলো পরপারে।ছেলে মেয়ে নিয়ে সাজানো সংসারটা এলোমেলো হয়েগেলো নিমিষেই।

রাদিয়া ছিলো ফুটফুটে শান্তু একটা বাবু। ইশিতার দুইছেলে স্কুলে পড়ে তাই তাকে সারাদিন ব্যাস্ত থাকতে হয়। স্কুলের পর আবার ছেলেদের প্রাইভেট পড়ানো ইশিতার দিনটা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
ছোট্ট রাদিয়া যেন সব বুঝে।সে কখনো কাঁদতো না।মাকে কখনো বিরক্ত করতো না।ছেলেদের পড়া, স্কুল, প্রাইভেট সবকিছু সামাল দিতে গিয়ে রাদিয়ার যত্ন নিতে ইশিতার কষ্ট হয়ে যেতো। তাইতো রাদিয়ার যেন যত্নের ত্রুটি না হয় শ্বশুরবাড়ির এলাকা থেকে পনেরো ষোল বছরের মেয়ে নাজমাকে এনেছিলো রাদিয়াকে যত্ন নিতে। নাজমাও রাদিয়াকে খুব ভালোবাসতো তাইতো নাজমার উপর মেয়ের প্রায় সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হন ইশিতা।

যেদিন রাদিয়া মারা যায় সেদিনই রমজান মাসের মাগফেরাতের দিন শুরু হলো।ইশিতা তার ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেকে নিয়ে কোচিংএ ছিলো।বাসায় নাজমা আর ক্লাস থ্রীর ছাত্র ছোট ছেলে রাহান ছিলো। বিকাল চারটেয় বাসায় আসলেই রাদিয়া প্রতিদিন তার মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পরতো।সেদিন তিনি এসে দেখেন রাদিয়া বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে। মাকে দেখেই দু’হাত বাড়িয়ে দিলো।ইশিতা মেয়েকে কোলে নিলেন।মায়ের কোলে রাদিয়া মাথা এলিয়ে দিলো কাধে। অন্য সময় রাদিয়া কোলে উঠেই আধো আধো বুলে মাকে অনেক কথাই বলে।এর মাঝে বেশির ভাগ কথাই থাকে রাহান নিয়ে নালিশ করে করে। রাহান খেলনা নিয়ে গেছে।রাহান বই দেয়না ইত্যাদি।

সেদিন রাহান ঘরে থাকলেও সারাক্ষণ তার প্রিয় কার্টুন ছবিই দেখেছে। ইশিতা নাজমাকে বললেন রাদিয়ার জন্য খাবার রেডি করে দিতে।তিনি রাদিয়াকে খাওয়াবেন।নাজমাকে বললেন ইফতার রেডি করতে। কিন্তু রাদিয়া কিছুই খেলো না, যেন তার মুখে কোন শক্তি নেই।তিনি দেখেন তার আদরের ময়নাটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে মাকে দেখছে।যেন কিছু বলবে কিন্তু পারছেনা। রোজার মাসে ইফতার সাজাতে হবে টেবিলে তাই তিনি রাদিয়াকে বিছানায় বসিয়ে কাজ করতে লাগলেন।হঠাৎ তিনি তাকালেন রাদিয়ার দিকে। তিনি তাজ্জব হয়ে দেখেন ঠোঁটের কোনে একফোঁটা রক্ত।তিনি ভাবলেন হয়তো রাদিয়া ধারালো কিছু মুখে দিয়ে ফেলেছে,তিনি দৌড়ে রাদিয়াকে বেসিনের কাছে নিয়ে গেলেন।মুখে হাত দিয়ে দেখেন কিছুতো নেই!তাহলে রক্ত আসলো কোথা থেকে?
ঠিক তখনি রাদিয়া বমি করতে লাগলো তিনি দেখেন বমি নয় টাটকা রক্তে ভেসে যাচ্ছে বেসিনটা।

বাসাথেকে হাসপাতালটা খুব দূরে নয়।ইশিতা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে একটা রিক্সা নিয়ে পাঁচ ছয় মিনিটেই হাসপাতালে পৌছে গেলেন। তিনি দেখলেন মেয়ের ফর্সা মুখটা আরও ফর্সা হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের হাত পায়ের তালু আরও সাদা হয়ে যাচ্ছে।ইমার্জেন্সিতে সাথে সাথেই চিকিৎসা শুরু হলো। ডাক্তার রাদিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করে পরীক্ষা করতে লাগলেন। নাহ্! রাদিয়া ডাক্তারদের বেশি সময় দেয়নি। মাগরিবের আযান শুরু হতেই রাদিয়া মায়ের বুকে ঘুমিয়ে গেলো চিরতরে।ছোট্ট ফুটফুটে রাদিয়া মাকে কিছুই বলতে পারেনি।শুধু মায়ের মুখটা দেখছিলো প্রাণভরে।তার বড় বড় চোখ যেন বলছিলো”মাগো আমি তোমার মুখটা আরেকটু দেখি!আরেকটু দেখিগো মা” । মৃত্যর পর ডাক্তার রাদিয়ার সকল রিপোর্ট দেখে বললেন।ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়ে রাদিয়া মারা গেছে।হয়তো রাদিয়া বড় ধরনের কোন ব্যাথা পেয়েছিলো বুকে।হয়তো বিছানা থেকে পড়ে গেছে কিংবা খেলতে গিয়ে পড় অনেক বড় আঘাত পেয়েছিলো।

ইশিতা তার মেয়ের মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।প্রথমেই তার সন্দেহ হয় ছোট ছেলে রাহানের প্রতি।তিনি ধারণা করতে লাগলেন ছোট ছেলেটা হয়তো রাদিয়াকে খেলার ছলে আঘাত করেছে।কিন্তু রাহানের এককথা রাদিয়া নাজমার সাথেই ছিলো।ইশিতা ছেলের কথা বিশ্বাস করেনি।তিনি ছোট ছেলেটাকে এরপর থেকে কথায় কথায় মারতেন।আর বলতেন তুই একটা খুনি,তুই আমার মেয়েকে খুন করেছিস।ইশিতা আস্তে আস্তে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে গেলো।পাগলামি করতে থাকে।সারারাত জেগে থাকে। মধ্যরাতে দরজা খুলে রাদিয়ার কবরে চলে যায়।কবরস্থানটা খুব দূরে নয় তাই চুপি চুপি সেখেনে গিয়ে কবরটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। আর মেয়ের সাথে কথা বলে।

এভাবে কয়েকমাস চলে গেলো। ডাক্তারের পরামর্শে ইশিতাকে শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়া নিয়ে মানসিক চিকিৎসা করা হলো।কিন্তু সময় সবচেয়ে বড় ঔষধ।সকল ক্ষতস্হান একমাত্র সময়ের মলমেই সেরে উঠে।ইশিতা আস্তে আস্তে আবার ঠিক হলো।বাসাটা বদল করা হলো ডাক্তার এর পরামর্শে। রাদিয়ার স্মৃতি সবার মনে একটা অনিরাময়যোগ্য ক্ষত হয়ে রইল। নাজমা চলে গেলো কাজ ছেড়ে। রাদিয়াকে ছাড়া এই বাসা তার ভালো লাগেনা। ইশিতার ননদের বাসায় নাজমার কাজ হয়েছে। সেখানেও সে একটা বাচ্চার দেখাশোনা করে।ননদের ছেলে।যার জন্ম রাদিয়ার জন্মের একবছর পরে হয়েছিলো।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে পাপ কখনো চাপা থাকেনা।
নাজমা কাজ করে ইশিতার ননদের বাসায়। পাশের বাসার একটা কাজের মেয়ের সাথে তার খুব বন্ধুত্ব। আর বন্ধু হলো গোপন কথা জমা রাখার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কথাব্যাংক।নাজমাও তার সকল সুখদুঃখ তার বন্ধুর কথা ব্যাংকে রাখে।কিন্তু এত বছরেও সে রাদিয়ার কথা বন্ধুকে বলেনি।তার মনের গোপন জায়গায় একটা বিরাট পাপকে চাপা দিয়ে নাজমা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকে।
একদিন তার বন্ধুর কাছে আরেকটা ভাল বাসায় কাজের প্রস্তাব এলো।বেতন এই বাসার চেয়ে অনেক বেশি।কিন্তু মেয়েটা এতবছরের পুরোনো বাসায় লজ্জায় বলতে পারছিলো না।আবার ভালো বেতনের লোভটাও ছাড়তে পারছিলো না। যথাসময়ে সে তার বন্ধু নাজমার কাছে বললো কথাটা।সে যে নতুন বাসায় যেতে চায় কিন্তু চক্ষু লজ্জায় যে বলতে পারছেনা এটাও বললো।নাজমা তখন তার পাপের ঝাঁপি খুলে দিলো।বলে দিলো কি করলে এই বাসা থেকে সে নিস্তার পাবে।

সে বললো, ছোট বাচ্চাটাকে গোপনে এমন আঘাত করতে হবে যেন বাচ্চাটা তার মাকে বলেদেয়। পরে এই অজুহাতে ঝগড়া করে সে কাজটা ছেড়ে নতুন কাজ নিতে পারবে। নাজমার বন্ধুটা এতো হৃদয়হীন নয়।বললো বাচ্চাটাকে সে আঘাত করবে না,আর আঘাত করলে যদি বাচ্চাটার কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে? নাজমা তখন শিখিয়ে দিলো বাচ্চাকে কিভাবে আঘাত করতে হয়।কোথায় আঘাত করলে কোন চিহ্ন থাকবে না। তারপর সে বললো,ছোট্ট রাদিয়াকে মারার হৃদয়বিদীর্ণ করা কথা।

সে যখন রাদিয়াদের বাসায় কাজ করতো।তখন রাদিয়ার ফুফু প্রায় সময়ই আসতো ভাইয়ের বাসায়।তারও একটা বচ্চা হয়েছে।একদিন তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন, যদি নাজমার মতো এমন ভালো কাজেরমেয়ে পাওয়া যায় তার নবজাতকের দেখাশোনার জন্য,তাহলে আরও একহাজার টাকা বেশি বেতন দিয়ে তাকে কাজে রাখবে।
নাজমার মনে লোভ তখনই এলো,সে কিভাবে যাবে?এই বাসায় তাকে অনেক আদর করে। কিন্তু একহাজার টাকা অনেক মূল্যবান তার কাছে।এই টাকা পেলে তার মাকে পাঠাবে গ্রামে বাবা মা আরেকটু ভালো থাকবে।
সে ঠিক করলো এই বাসার কাজ ছেড়ে রাদিয়ার ফুফুর বাসার কাজটা সে নিয়ে নিবে। এই পরিকল্পনা করার পর সে রাদিয়াকে তার মায়ের অগোচরে বিভিন্ন ভাবে মারে।যেহেতু দিনের বেশিরভাগ সময় সে নাজমার কাছে থাকে তাই সে ভয়ে ভয়ে থাকে। আর বয়স কম হওয়ায় রাদিয়া তার মাকেও বলতে পারেনি তার উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা। যেহেতু রাদিয়া বলেনি তাই নাজমা ধীরে ধূরে নির্যাতনের পরিমান বাড়িয়ে দেয়।ওর ধারণা রাদিয়া তার মাকে একদিন বলে দিবে কিংবা ইশিতা টের পেয়ে যাবে আর তখন এই অজুহাতে ঝগড়া করে সে কাজ ছেড়ে চলে যাবে।

যেদিন রাদিয়া মরে যায় সেদিন দুপুরে রাদিয়াকে প্রথমে গোছলের সময় একটা লাথি মারে।শান্ত রাদিয়া ব্যাথা পেয়ে কাঁদতে থাকে, তখন নাজমা ভেবেছিলো মেয়ের কান্না দেখে মা হয়তো নাজমাকে বকা দিবে। কিন্তু ইশিতা তড়িঘড়ি করে ছেলেকে নিয়ে কোচিংএ চলে যায়। নাজমার তখন খুব রাগ উঠে যায় তখন বিছানায় শুয়ে থাকা রাদিয়ার ছোট্ট বুকটার উপর নাজমা পা দিয়ে একটা চাপ দেয়। তারপর রাদিয়ার ছোট্ট শরীরটাকে জোরে ঝাকাতে থাকে।এভাবে সে কয়েকবার এমন করে। তারপর রান্না ঘরে কাজে চলে যায়।সে ভাবতেও পারেনি পায়ের চাপে টুনটুনির মতো রাদিয়ার লিভারটা ফেটে ততক্ষণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে।

নাজমা রাদিয়াকে কিভাবে মেরেছে সেটা তার প্রাণের বন্ধুকে বলেছিলো।সে এটাও বলেছিলো এতোবছরেও কেউ টের পায়নি সে কথা।সে ভাবতে পারেনি সকল মানুষই পশু হয়না। নাজমার সেই বন্ধু তার মনিবের কাছে সে রাতেই কথাটা বলে দেয়। সেই মহিলা সকাল হতেই পাশের বাসা থেকে রাদিয়াদের ঠিকানা সংগ্রহ করে গিয়ে রাদিয়ার বাবা মাকে সব বলে দেয়।

নাজমার বিরুদ্ধে কেস করেছিলো রাদিয়ার বাবা।কিন্তু কোন লাভ হয়নি।এতদিন পর কোন প্রমান পাওয়া যায়নি।তাছাড়া পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নাজমা সকল দোষ রাদিয়ার ফুফুর উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো।সে বলেছিলো একই এলাকায় বসবাসকারী রাদিয়ার ফুফু তাকে টাকার লোভ দেখিয়েছে,ফুসলিয়েছে অনবরত তাই সে না বুঝে এমন করেছে। রাদিয়ার বাবা মেয়ে হারিয়েছেন।আর বিচার যেহেতু পাবেননা তাই সকল কিছু ভুলে সংসারেই আবার মনোযোগী হলেন তিনি।
রাদিয়ার মা ভুলতে পারেননা, মেয়ের শেষ আকুতিভরা সেই দৃষ্টি।কি বলতে চেয়েছিলো রাদিয়া? তার কষ্টের কথা?নাকি কাজের মেয়ের কাছে রেখে চলে যাওয়ায় অভিমানের কথা?কী ছিলো সে চোখে! কী ছিলো?

লেখক-সুস্মিতা মিলি, কথাসাহিত্যিক ও কবি 

আরও পড়ুন