Ads

হীনমন্যতা যেভাবে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি করছে ।। ২য় পর্ব

।। মূলঃ হাফসা আদহাম ।

।। অনুবাদঃ সাবিহা সাবা ।।

মুসলিম পেশাজীবীদের মধ্যে হীনমন্যতা 

আপনি কি কখনো বিদ্রুপের আশংকা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে গিয়েছেন? আপনার স্বতন্ত্র পরিচয়, ভিন্ন নাম, ভিন্ন বর্ণ সবকিছু নিয়ে একটা ইতস্তত ভাব; এমনকি আপনার সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধ, যা অন্যদের সাথে মিলছে না, এ বিষয়গুলো আসলে একজন ব্যক্তির ভেতরে ঠিক কোন অনুভূতির জন্ম দেয়?

আমার ক্লায়েন্ট আয়েশা, তার কাছে মনে হতো যে সে তার কর্মক্ষেত্রের অন্তর্গত কেউ নয়। তিনি শ্বেতাঙ্গ পরিবেষ্টিত একটি এলাকায় কর্মরত একজন শিক্ষক ছিলেন। বুদ্ধিমান, সক্ষম ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করার পরিবর্তে অবচেতনমনে তার কাছে নিজেকে ভিনজগতের বলে মনে হতো। এই হীনমন্যতাবোধ তার কথায় ও আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল; তিনি কোন ইস্যুতে ভিন্ন মত পোষণ করলেও সবার সাথে ‘জ্বি হুজুর’ ধরনের আচরণ করতেন। এবং যেকোনো ভাবে, যেকোনো উপায়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণের প্রচেষ্টায় রত থাকতেন।

“কখনোই ভাববেন না যে আপনি যথেষ্ট ভাল নন। একজন মানুষের কখনই এমন ভাবা উচিত নয়, লোকে তোমাকে খুব আপন করে নেবে।”-অ্যান্টনি ট্রলপঅ

এই উদ্ধৃতিটি অনুযায়ী, আমরাই লোকেদের শেখাই কিভাবে আমাদের সাথে আচরণ করতে হবে। আমরা যদি নিজেদেরকে অযোগ্য মনে করি, তাহলে এটিই অবশ্যম্ভাবী যে অন্যেরাও আমাদের সেভাবেই দেখবে।

অধিকন্তু, মুমিনের অবস্থা হল যে তার জন্য প্রতিটি পরিস্থিতিতেই খায়র (ভাল) রয়েছে, যা নিম্নোক্ত হাদিসে পাওয়া যায়:

” মুমিনের ব্যাপার বড়োই আশ্চর্যজনক, তার সব বিষয়ই ভালো এবং এটা মুমিন ছাড়া আর কারো জন্য নয়। যদি তার কাছে ভালো/সুখের কিছু আসে তবে সে কৃতজ্ঞ হয় এবং সেটা তার জন্য ভালো। যদি তার কোন ক্ষতি হয় তবে সে ধৈর্য ধারণ করে এবং এটাই তার জন্য কল্যাণকর” (মুসলিম)

এই বিষয় মাথায় রাখা গেলে আমাদের সমস্ত পরিস্থিতিতে উত্তম উদ্দেশ্য খুঁজে নেয়ার দ্বারা আমরা চিন্তাভাবনাকে উন্নত করতে পারি, নেতিবাচক বিষয়গুলিকে বিবেচনা করার বিপরীতে এর নেপথ্যে নিহিত কল্যাণ এবং সুযোগগুলো নিয়ে ভাবা উচিত।

এই কথা মাথায় রেখে, আয়েশা এবং আমি একটি বিকল্প দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনা করেছি; সম্ভবত আল্লাহ তাকে একটি রোল মডেল হওয়ার এবং মুসলিম স্টেরিওটাইপকে ঘিরে থাকা মিথ্যে কাহিনীগুলি দূর করার সুযোগ দিয়েছিলেন, যে তিনি শুধুমাত্র নিজের উপস্থিতি দ্বারাই একটি বিপ্লবী পরিবর্তন সাধিত করেন। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রতিদিন কাজ করতে যান এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত আচার-ব্যবহার এবং পোশাকের কোড মেনে কর্মক্ষেত্রে যান। অবিলম্বে, এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে তার আসল পরিচয়ে আরও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে এবং আল্লাহর সাথে তার সংযোগকে শক্তিশালী করেছে। এখন আর সে পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানানসই করে নেবার তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করে না।

মানানসই না হওয়ার এই অনুভূতিটি মূলত পশ্চিমা পরিবেশে কাজ করা মুসলিম পেশাজীবিদের জন্য খুব পরিচিত। “সাংস্কৃতিক হীনমন্যতা” শব্দটিকে একটি অভ্যন্তরীণ হীনমন্যতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যেখানে মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতিকে অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির থেকে নিকৃষ্ট বলে অনুভূত হয়। অসাবধানতাবশত, আমরা আমাদের ধর্মীয় অভিযোজনের সাথেও “সাংস্কৃতিক হীনমন্যতা” ফ্যাক্টর অনুভব করতে পারি। সামাজিক গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে না চাওয়ায় বা সম্ভাব্য কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবার আশংকায় একজন ব্যক্তি তার কিছু ধর্মীয় অনুশাসন বাদ দিয়ে দিতে পারে এবং তাদের সহকর্মীদের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এবং আশেপাশের নানা ট্রেন্ড অনুসরণের জন্য চেষ্টা করে।

নিয়মিত নামাজ না পড়া, জুমু’আর জন্য সময় বের না করা, হিজাব পড়া বা দাড়ি বাড়াতে অস্বস্তি বোধ করা, হারাম বাদ না দেয়া, নিজের অনুপযুক্ত পরিবেশে জোরপূর্বক মানিয়ে নেয়ার  চেষ্টা করা এই ধরনের অনুভূতির কিছু বাস্তবচিত্র হতে পারে। বাস্তবিকভাবে, নিজের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অন্যদের মতো হওয়ার ইচ্ছার মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মূলত উদ্বেগ, চাপ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি করে। অন্যদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়; এ ধরণের সামাজিক উদ্বেগ হীনমন্যতার জন্য সবচেয়ে বড় ট্রিগার হতে পারে।

এই অনুভূতি শুধু ভেতরে সীমাবদ্ধ না থেকে আরো বাড়তে থাকে। মনে হয় যে আপনি যত চেষ্টাই করুন না কেন, আপনি কখনোই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না বা অন্যেরা আপনাকে যোগ্য মনে করবে না। এমনকি সফল ব্যক্তিরাও নিজেদের ব্যর্থ এবং অসফল মনে করতে পারে।

হীনম্মন্যতার অনুভূতি কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় নয়, এটি একটি মানসিক অনুভূতি যা ব্যক্তিগতভাবে বহন করা হয় এবং এটি শুধু যন্ত্রণাই বয়ে আনে। এ অনুভূতি হতাশা এবং অসহায়ত্ব থেকে রাগ, বিরক্তি, হিংসা পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে মানুষের জীবনে। একজন ব্যক্তি তার চাকরিতে সম্পূর্ণ অযোগ্য বোধ করতে পারে যদিও তারা প্রকৃতপক্ষে এটিতে অধিকতর যোগ্য – এমন ধারণা মূলত বোকার ভাবনা, কোনও যুক্তিযুক্ত চিন্তা নয়।

মুসলিম সংগঠনে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স

মুসলমানরা পশ্চিমাদের দিকে তাকায় এবং সফল কোম্পানিগুলি দেখে: গুগল, অ্যাপল এবং টেসলা প্রায়শই এই সংস্থাগুলি এমন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে যা আমাদের জন্য নতুন এবং কখনও কখনও এইগুলি ইসলামের বিরুদ্ধেও – তবুও পূর্বে উল্লেখ করা হীনমন্যতার সাধারণ অনুভূতি আমাদের মাঝে এই ধারণার জন্ম দেয় যে আমরা অযোগ্য এবং আমাদের কাজ করার পদ্ধতি যথেষ্ট ভাল নয় । ফলস্বরূপ আমরা অন্ধভাবে এই কোম্পানিগুলির পদাঙ্ক অনুসরণ করি এবং সাফল্যের পিছে ছুটতে ছুটতে আমরা আমাদের এমনকি হালাল হারামের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে থাকি।

উদাহরণ স্বরূপ, আমরা মুসলিম উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি।  এখানে এখন মুসলিম কোম্পানিগুলো উপর্যুপরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং মুসলিমদের খরচ এখন ট্রিলিয়ন ডলারের সমান এবং বিশ্ব ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্মে এটি একটি স্বীকৃত খাত। যদিও এই বৃদ্ধি রয়েছে, তারপরেও আমরা এই প্রবণতার পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান হীনমন্যতা কমপ্লেক্সের লক্ষণগুলিও দেখতে পাচ্ছি।

আজকের বিশ্বে, আমরা মুসলিম সংস্থা এবং কোম্পানিগুলির মাঝে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি: 

১) খুবই তাড়াহুড়োর সাথে কাজ করে যাওয়া, কর্মচারীদের হাড়ভাঙা খাটুনি।

২) নিরলসভাবে মূলধারার সংস্থাগুলির পদচ্ছাপ  অনুসরণ করা এবং একই উচ্চ স্তরের সাফল্য অর্জনের আশায় সিলিকন ভ্যালি এবং কর্পোরেট আমেরিকাকে কপি করা।

৩) পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিজেকে অযোগ্য মনে  করা এবং ফলস্বরূপ নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন করা – এই বিশ্বাসে যে তারা এতটাই সক্ষম!

আরও পড়ুন-হীনমন্যতা যেভাবে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি করছে ।। ১ম পর্ব

কি হবে যদি এর পরিবর্তে, মুসলিম কোম্পানিগুলো ইয়াকীন (নিশ্চিত) সহ সুন্নাহ অনুশীলন গ্রহণ করে যে আর-রাজ্জাক (প্রদানকারী) বারাকাহ-পূর্ণ ফলাফল প্রদান করবে? এই ধরনের অনুশীলনের কয়েকটি উদাহরণ হল:

* কঠিন লড়াইয়ে না নেমে প্রতিযোগীদের সাথে মোকাবিলা করার সময় পারস্পরিক সুবিধা এবং সহযোগিতার একটি মানসিকতা গ্রহণ করা।

* কাজের সাথে এমন মানসিকতা অবলম্বন করা যেখানে আপনি ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করবেন। কঠোর পরিশ্রম করবেন তবে ফলাফল নিয়ে কোন আশা রাখবেন না, ঠিক যেমন একজন মালী করে থাকেন ।

* শ্রমিকদের ঘাম শুকানোর আগে বেতন দেওয়ার সুন্নত পূর্ণ করা।

* কর্মীদের ধর্মীয় দিকেও মনোনিবেশ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ,  ঠিক যেমন আমরা তাদের পেশাদার হবার জন্য প্রশিক্ষণ দিই।

* নামাজের সময়কে কেন্দ্র করে মিটিং, কাজের শিডিউল ঠিক করুন।

* হিজরি ক্যালেন্ডার ঘিরে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এমনকি কর্মীদের বেতন দেওয়া এবং ছুটির অফার করা ইত্যাদিও হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে করা।

*নারী কর্মচারীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করতে এবং অনলাইনে বা সরাসরি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ভাবে কাজ করবার সুযোগ করে দেয়া।

*নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অভ্যাসের মতো কর্মচারীদের কাইলুলাহ (ছোট মধ্য দিনের ঘুম) নেওয়ার জন্য সময় তৈরি করা।

*ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আর্থিক লাভ ও মুনাফার জন্য নয় বরং সম্প্রদায় ও উম্মাহর সেবার উদ্দেশ্যে করা।

উপরের ধারণাগুলি আমাদের আধুনিক কর্পোরেট জগতে ‘পাগলামি’ এবং “অপেশাদার” কিছু মনে হতে পারে – কিন্তু যদি উপরের চিন্তাগুলিকে ‘পাগলামি’ বা ‘অপেশাদার’ কিছু মনে করা আসলে আপনার হীনম্মন্যতা হয়? হ্যাঁ, হয়ত উপরের সমস্ত ধারণাগুলি প্রতিদিন প্রয়োগ করা নাও যেতে পারে– কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে বারাকাহ-এর সাথে আমাদের ব্যবসা বাড়ানোর উপায়গুলি অন্বেষণ এবং পরীক্ষা করার জন্য নিজেদের উৎসাহিত করা উচিত নয়!

আমার বক্তব্য হল:

কর্পোরেট আমেরিকার সাফল্যের সূত্রগুলি এবং এর মতো সফল কোম্পানিগুলি তৈরি করার উপায়ই একমাত্র বৈধ উপায় বলে মনে করা মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসুন । এর পরিবর্তে, মুসলিম সংস্থাগুলি যদি তাদের কোম্পানির কাঠামো এবং কর্মদিবসকে ঈমানের আলোকে সাজানোর ক্ষেত্রে আরও নির্ভরতা স্থাপন করে তবে কী হবে?  বারাকাহর দরজা খোলার সাথে সাথে, এটি আরও বড় ফলাফলও এনে দিতে পারে, সে বিষয়ে কল্পনা করেই দেখুন না!

চলবে…

সূত্রঃ প্রোডাক্টিভ মুসলিম (www.productivemuslim.com)

লেখকঃ হাফসাহ আদহাম “দ্য কনফিডেন্ট মুসলিমাহ” এর প্রতিষ্ঠাতা ।  এটি একটি আধ্যাত্মিকতা উন্নয়ন কেন্দ্রিক কোচিং সেন্টার । এই প্রতিষ্ঠান কোরআন এবং সুন্নাহর আলোকে মুসলিমদের  আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং হীনমন্যতা দূর করতে ভূমিকা রাখে । স্বামী এবং তিন সন্তানসহ যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী এই লেখক আত্মবিশ্বাসী প্রশিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি একজন পাবলিক স্পিকার এবং কমিউনিটি কর্মী ।

অনুবাদকঃ সাবিহা সাবা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সহ-সম্পাদক, মহীয়সী

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প, কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক!  আপনি আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ;  মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই ।  আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন