Ads

জাতীয় অধ্যাপক ও কবি সৈয়দ আলী আহসান একটি স্বর্ণালি অধ্যায়।

এভাবেই আমার দিন রাত্রির অধীরতা
অনেক বনের মধ্য দিয়ে
অনেক নদী সমুদ্রের স্বচ্ছতায়
একদিন হয়তো পাহাড়ের দুর্গমতায়
পাথরের নিশ্চেতন সংকট পার হয়ে
ইউলিসিস ইথাকায় ফিরবে’।
(প্রার্থনা, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)

সৈয়দ আলী আহসান একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। আজ এই নক্ষত্রের মৃত্যু দিবস।কিছু মৃত্যু সমাজকে নিঃস্ব করে। এই জাতীয় অধ্যাপকের মৃত্যুতে সাহিত্যাঙ্গন রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে যায়।

সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক কবি সাহিত্য সমালোচক অনুবাদক প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ। ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক উপাধিতে ভূষিত করেন। তার প্রজ্ঞা ও ক্ষুরধার মেধার কারণে পন্ডিত হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন । তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ইংরেজি অনুবাদক।

বর্তমান মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হয় ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে শুরু হয়। সেখান হতে তৎকালীন এন্ট্রান্স পাস করে বর্তমান ঢাকা কলেজ হতে পারে এফ এ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ১৯৪৩ সালে স্নাতক এবং ১৯৪৪ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর কলকাতা যান সেখানেই ১৯৪৬ সালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং ঘর সংসার শুরু করেন।অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে এবং রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র হতে কর্মসূচি নিয়ামক রুপে চাকরি করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন।এরপর বাংলা একাডেমীর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্ব শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। দেশ স্বাধীনের পর পর্যায়ক্রমে জাহাঙ্গীরনগর,চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কিত দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ছিলেন। নোবেল কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৮৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্য কর্ম এবং সাহিত্যে অবদানের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তিনি সমকালীন ধারার থেকে ভিন্ন ধারায় চলতে চেয়েছেন যেখানে বিমূর্ততার প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও তাঁর রচনায় ঐতিহ্য চেতনা, সৌন্দর্যবোধ ও স্বদেশপ্রীতি অন্যান্য কবিদের মতোই বর্তমান।তার রচিত অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে “একক সন্ধ্যায় বসন্ত” কাব্যগ্রন্থ কে সেরা সংকলন হিসেবে বিবেচনা করা হয।় এই কাব্যগ্রন্থের গদ্য কবিতা স্থান পেয়েছে। গদ্য কবিতা রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিশের কবিদের থেকে ভিন্ন কেননা তার কবিতায় উপমা ও শব্দ ব্যবহারে রয়েছে নান্দনিক নতুনত্ব,আধুনিকতার পরশ।উপমা ও রুপক ব্যবহারে জীবনান্দ দাশের থেকে তার কিছুটা পার্থক্য আছে।তার লেখায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভাবের চাইতে বিমূর্ত ভাবের প্রকাশ বেশি।যা কবি আল মাহমুদের লেখায় পরিলক্ষিত হয়।তার উপমা প্রয়োগের কলাকৌশল,কারুকাজ ও শব্দের সুনিপুন স্থাপনা শৈলী মুগ্ধ পাঠক আকৃষ্ট করে। তৈরি হয় কবিতা পাঠের প্রতি আগ্রহ ও মুগ্ধ আবেগ। “একক সন্ধ্যায় বসন্ত” কাব্য সংকলনের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রার্থনা ও আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাদ্বয়। অসাধারণ উপমার মাধ্যমে স্রষ্টার কাছে আরতি পৌঁছানোর পথ তিনি বলে দিয়েছেন। যা আমার এই প্রবন্ধের শুরুতে সংযুক্ত আছে।

দেশমাতৃকার প্রতি তার ভালোবাসা আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতার প্রত্যেকটি লাইনে উৎসারিত তিনি লিখেছেন
আমার পূর্ব বাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সরোবরের অতলের মতো
কালো কেশের মেঘের সঞ্চয়ের মতো বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি।
দেশের মাটির গন্ধের এক গভীর সম্পর্ক আবিষ্কার করেন কবি।
আমার পূর্ব-বাংলা বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা

কবরী এলো করে আকাশ দেখার
মুহূর্ত
অশেষ অনুভব নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা
এক সময় সূর্যকে ঢেকে অনেক মেঘের পালক
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
কেমন নিশ্চেতনকরা গন্ধ
কত দশা বিরহিনীর- এক দুই তিন
দশটি
প্রেমিক-প্রেমিকার অভিসারের- গোপন-চুপিসারে সাক্ষাতের আনন্দের সাথে, শিহরণের সাথে কবি যেন মিল খুঁজে পেয়েছেন তার দেখা প্রকৃতির সান্নিধ্যের অনুভবের। গাছের শাখা যেমন মমতায় ছুঁয়ে যায় মাটির পরশ, তেমনি যেন রঙে মাখা নিবিড় অনুভূতিময় প্রকৃতির রূপ আমাদের মনকে স্পর্শ করে যায়- এমনটি ভেবেছেন সৈয়দ আহসান।
এখানে ত্রস্ত আকুলতায় চিরকাল
অভিসার
ঘর আর বিদেশ আঙিনা
আকুলতায় একাকার
তিনটি ফুল আর অনেক পাতা নিয়ে
কদম্ব তরুর একটি শাখা মাটি
ছুঁয়েছে
আরও অনেক গাছ পাতা লতা
নীল হলুদ বেগুনি অথবা সাদা
অজস্র ফুলের বন্যা অফুরন্ত
ঘুমের অলসতায় চোখ বুঁজে আসার মতো
শান্তি।

নেগালের সাবেক প্রেসিডেন্ট, ফরাসি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লিউপোল্ড সেডর সেংঘর ছিলেন কবি সৈয়দ আলী আহসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।[৫] সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা তার কবিতায় তিনি বলেছিলেন :

‘তুমি এলে।
তোমার চোখ আমার চোখের
সামনে দিয়ে চলে গেল,
তোমার চোখ ঈষদুষ্ণ বাড়ির স্পর্শে
চুম্বকের স্বাদ পেল।’

সেংঘরের এই কথা যে যথার্থ, তার প্রমাণ আমরা পাব অন্নদাশংকর রায়ের লেখায় : “তিনি একজন সত্যিকার কবি। যেমন হৃদয়বান, তেমনি রূপদর্শী। যে ভাষায় তিনি লেখেন, তা খাঁটি বাংলা। তাঁর কবি পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ পরিচয়।”[৫]

আধুনিক উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি কলিম সাসারামী সৈয়দ আলী আহসানের ষাটতম জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এই বলে : ‘যখন বিধাতা সাহিত্যের জন্য একটি উজ্জ্বল কেন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবলেন, সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্যের দিগন্তে আবির্ভূত হলেন কিরণসঞ্চারি সূর্যের মতো। এবং তখন কাব্যলোক আনন্দের সারত্সার এবং উচ্ছলতা-উত্ফুল্লে নৃত্যরত হলো। স্বর্গ থেকে ধরিত্রী পর্যন্ত উপাদান সঙ্গীতে সমৃদ্ধ হলো।’[৫]

পুরস্কার ও সম্মাননাসম্পাদনাবাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮),দাউদ পুরস্কার (১৯৬৯ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্কালে প্রত্যাখ্যান),শেরে বাংলা পুরস্কার [৬]সুফি মোতাহার হোসেন স্বর্ণপদক (১৯৭৬),বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ব একুশে পদক (১৯৮২),নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫),মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৫),স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৭) [৬][৭]জাতীয় অধ্যাপকরূপে নিযুক্তি (১৯৮৯)।কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর)-২০০৩
সৈয়দ আলী আহসানের প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা নিচে প্রদান করা হলো। এ ছাড়াও তিনি আরো কিছু গ্রন্থ রচনা করেন।।

কাব্যগ্রন্থসম্পাদনা

অনেক আকাশ (১৯৬০),একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬২),সহসা সচকিত (১৯৬৮),উচ্চারণ (১৯৬৮),আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৩)প্রেম যেখানে সর্বস্ব

প্রবন্ধ গ্রন্থসম্পাদনা

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সাথে (১৯৫৬)কবিতার কথা (১৯৫৭)কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৬৮)আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০)রবীন্দ্রনাথ : কাব্য বিচারের ভূমিকা (১৯৭৩), মধুসূদন : কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ (১৯৭৬)আধুনিক জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬)যখন কলকাতায় ছিলাম, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ২০০৪বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস মধ্যযুগশিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্যজীবনের শিলান্যাস

সম্পাদিত গ্রন্থসম্পাদনা

পদ্মাবতী (১৯৬৮),মধুমালতী (১৯৭১)

অনূদিত গ্রন্থসম্পাদনা

ইকবালের কবিতা (১৯৫২),প্রেমের কবিতা (১৯৬০),ইতিহাস (১৯৬৮)

ইসলামি গ্রন্থসম্পাদনা

মহানবীআল্লাহ আমার প্রভূ
অন্যান্য গ্রন্থ সম্পাদনা

যখন সময় এলোরক্তাক্ত বাংলাপাণ্ডুলিপিবাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থারজনীগন্ধাচর্যাগীতিকাআমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ১৯৭৫ সালবাংলাদেশের সংস্কৃতি
বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র বার্ধক্য জনিত কারনে ২০০২ সালের ২৫ জুলাই ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।জাতীয় অধ্যাপক সাহিত্যিক কবি সৈয়দ আলী আহসানকে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।কবির আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া

লেখক-ফারহানা শরমীন জেনী, কবি,সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ।

আরও পড়ুন