Ads

নজরুলের ভক্তিমূলক গানে ঈশ্বরপ্রেমের স্বরূপসন্ধান

ইশরাত জাহান

বুক রিভিউ : নজরুলের ভক্তিমূলক গানে ঈশ্বরপ্রমের স্বন্ধান

লেখিকা:নিশাত সারমিন জেসমিন

নজরুলের ভক্তিমূলক গানে ঈশ্বর প্রেমের স্বরূপসন্ধান এই বইখানার মধ্যে আমরা নজরুলের ভক্তিমূলক গান, ভক্তিমূলক গান রচনার প্রেরণা ও পটভূমি, শ্যামাসংগীত, আগমনী গান, ঈশ্বর বন্দনামূলক গান বা ব্রম্মসংগীত, কীর্তন, বাউল গান, ইসলামী গানের প্রতি নজরুলের প্রেম। এবং বিভিন্ন সময়ের পেক্ষাপটে নজরুল কিভাবে ভক্তিমূলক গান রচনা করেছেন তার বিষয়াদি লেখিকা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তার লেখায় বর্ণনা করেছেন।
এবং এই লেখিকা অন্য কেউ নন, আমাদের পাঠশালা গ্রুপের খুব পরিচিত প্রিয়মুখ নিশাত সারমিন জেসমিন। পাঠশালা গ্রুপে আমি প্রথম তাঁর লেখার সাথে পরিচিত হই, এবং তাঁর এই গবেষণা মূলক বইখানা পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ জন্ম নেয় । বইখানা পড়ার পর মনে হচ্ছে আমি স্বার্থক, অনেক অজানা বিষয় আমি এক নিমেষেই জানতে পারলাম।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কিন্তু তিনি যতোটা পরিচিত, ততোটা পঠিত নন। কাজী নজরুল ইসলাম কেবল দ্রোহের কবি নন, তিনি প্রেমের কবি, মানবাধিকারের কবি, সাম্যের কবি। লেখিকা নিশাত সারমিন জেসমিন নজরুলের ভক্তিমূলক গানে ঈশ্বরপ্রেমের সরূপসন্ধান রচনা করে, নজরুলের আরেকটি পরিচয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন-নজরুল ঈশ্বরভক্তির কবি।

এই বইখানা পড়ার পর আমি জানতে পারি, কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে সত্যই ধর্ম। যার ফলে দেখতে পাই মানুষের কল্যাণের সাথে সম্পর্কহীন লোকাচার ও ধর্মের নামে ভণ্ডামি তাঁর মতো মানব দরদীর স্বচ্ছ ধর্মবোধে কখনই স্হান পায়নি। মানবপ্রেমই ছিলো তাঁর ভক্তিমূলক গানের মূল সুর। ধর্মকে ও ধর্মের সত্যকে তিনি উদার মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাই তিনি একজন আদর্শ মুসলমান, তেমনি আবার আদর্শ শাক্ত অথবা তিনি একজন প্রকৃত বৈষ্ণব বা বাউল। যার কাছে মানুষ ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম।

বাংলা সাহিত্যে এবং সংগীতে বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাওয়া কাজী নজরুল ইসলাম সংগ্রামে যেমন বজ্রের মতো কঠিন, প্রেমে তেমনি কুসুম কোমল।বাংলা কাব্য ও সংগীতে নজরুল একটি বিশেষ অধ্যায়ের যোজনা করেছেন। কবির জীবন সত্তার দুটি দিক ‘বিদ্রোহী ‘কবিতায় অপূর্ব সুরে ধবনিত হয়েছে:

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তুর্য:( বিদ্রোহী , অগ্নিবীণা)

নজরুল তাঁর ভক্তিমূলক গানে যেমন, কীর্তন,বাউল,শ্যামা, ভজন এবং অগনিত ইসলামী গান রচনা করেছেন। যদিও তিনি এসব গান বিক্ষিপ্তভাবে ১৯২৯-১৯৩০ সালের দিক থেকেই শুরু করেন। তবে এই কর্মে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। নজরুল ভক্তিমূলক গানে সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছেন শ্যামাসংগীত ও ইসলামী সংগীতে।

মানবিকতার যথাযথ চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে কবি ধর্মসংগীত/ ভক্তিমূলক গানেও গোঁড়ামির আশ্রয় নেননি। ইসলামী গানে কবি একজন ধর্মনিষ্ঠ খাঁটি মুসলমানের মতো ইসলামের শান্তিময় আশ্রয় ও ভ্রাতৃত্ববোধের কথা তুলে ধরেছেন। মহান আল্লাহ্তালার অপার মহিমা কীর্তনের পাশাপাশি প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মহিমা ও আদর্শের বাণী গেয়েছেন। সমস্ত ধর্মসংগীতে কবির নিজস্ব উপলব্ধিজাত সুন্দরের প্রতিফলন ঘটেছে।কবি গেয়েছেন:

গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।

কবির সুন্দর অনুভূতি মানুষের প্রতি এবং মানুষের মঙ্গল চিন্তাই তার কাম্য ছিলো। নজরুলের ভক্তিমূলক গানে মূলত মানব প্রেমেরই মূল সুর।
কাজী নজরুল ইসলাম যে শাক্ত সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন তার প্রমাণ মেলে এই শ্যামা সংগীতে।

মাতৃনামের হোমের শিখা
আমার বুকে কে জ্বালালো ?
( রাঙ্গাজবা,১৯৬৬)

নজরুল শুধু শ্যামাকে ‘মা’ রূপে পেতে চাননি, তিনি তাঁকে নিজের মেয়ের মতো করেও পেতে চেয়েছেন। আদর করে মেয়েকে ভিন্ন নামে ডাকেন।আমি সাধ করে মোর গৌরী মেয়ের নাম রেখেছি কালী। তিনি বলেন ‘কালী’ আসলে কালো নয়, সে গৌরী, আমার ভালোবাসার নাম কালী যেখানে গৌরীর স্বার্থকতা। কারণ কালো আছে বলেই জগৎ আলোময়। মানব দরদী নজরুলের আগমনী গানে মানবিক আবেদন অপূর্ব বাণী লাভ করেছে।

বর্ষা গেল, আশ্বিন এল, উমা এল কই।
শূন্য ঘরে কেমন করে পরাণ ধরে রই।
ও গিরিরাজ।সবার মেয়ে মায়ের কোলে এল ধেয়ে।
(রাঙাজবা, ১৯৬৬)

কবি জানেন তাঁর চির সুন্দর পরম আরাধ্য ঈশ্বর হচ্ছেন সর্বশক্তিমান। তাঁর কাছে করুণা ভিক্ষা চলে না, তিনি চান শক্তি ও সাহস। তাই তিনি নির্ভীক চিত্তে বলতে পেরেছিলেন।

দাও শূন্য দাও ধৈর্য্য হে উদারনাথ।
দাও দাও প্রাণ।
দাও অমৃত মৃত জনে শক্তি পরিমাণ
দাও ভিত চিত জনে হে সর্বশক্তিমান।

তাঁর ভাবের একান্ত অনুভূতি নিবেদন করেছেন তাঁর কীর্তনে। কবির সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে রয়েছে শ্যাম, তারই প্রকাশ রয়েছে কীর্তনে।
কবি স্রষ্টাকে খুঁজে ফেরেন আপন অন্তরে। তাই তো বাউলের এক তারাতেও বাজে সাম্য ও প্রেমের বাণী। বাউলের পরমাত্মা হলেন ‘মনের মানুষ’ ‘অটল মানুষ’ ‘অধর মানুষ’ ‘অচিন পাখি’ ‘অলখ সাঁই’ তাদের হৃদয়ে বিরাজ করে। কবি ছিলেন বিদ্রোহী, তিনি ছিলেন মানব প্রেমিক তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন এমন কথা:

আমি বাউল হলেম ধুলির পথে
লয়ে তোমার নাম
আমার একতারাতেও বাজে শুধু তোমারি গান শ্যাম।
( নজরুল গীতি, অখন্ড, ১৯৭৮)

মহান আল্লাহর দয়ার শেষ নেই। কবি সর্বদা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন। সহায় সম্বলহীন কবির একমাত্র ভরসা হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন। তাই তিনি সবাইকে আল্লাহর উপর ভরসা করার আহ্বান জানিয়েছেন লিখেছেন:

কারো উপর ভরসা করিস না তুই
ও মন এক আল্লাহর উপর ভরসা কর।
আল্লাহ্ যদি সহায় থাকেন,
ভাবনা কীসের,কীসের ডর।

আল্লাহর প্রেমে কবি সদাই বিভোর হয়ে থাকতেন। তাই দিবানিশি মশগুল হয়ে গাইতেন:

খোদার প্রেমে শারাব পিয়ে
বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে।
ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ
এল যে এই পথ ধরে।

রমজান মাসে রোজার পর খুশির বার্তা আনে ঈদ। সেই ঈদের আনন্দ যথার্থ প্রকাশের জন্য কবি লিখেছেন অসাধারণ ঈদের গান:

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এল খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানি তাকিদ।

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়েও তিনি অনেক গান লিখেছেন। আমাদের নবীজীর আবির্ভাব নিয়ে। নবীজীর আগমনে যে দুনিয়ার বুকে অনাবিল আনন্দের বন্যা বইছে সেটা নিয়ে লিখেছেন:

তোরা দেখে যা ,আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।
যেন উষার কোলে রাঙা রবি দোলে।

এছাড়া তিনি নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় মুর্শিদ ও অভিভাবক রূপে দেখেছেন। তাওহীদ বাণী প্রচারের জন্য আল্লাহর নবী এলেন দুনিয়ায় মুর্শিদ রূপে। সেটা নিয়ে কবির হৃদয় নিঃসৃত বানী প্রকাশিত হলো এই ভাবে:

তৌহিদের ঐ মুর্শিদ আমার মোহাম্মদ নাম
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।

প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের স্বরূপ নিদির্ষ্ট করে দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব না। নজরুল বলেন

” সকলের মাঝে তাহার প্রকাশ, সকলের মাঝে তিনি”।

আল্লাহ্/ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। কবির ধর্মচর্চার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ, তাই মানুষকে ভালোবেসে তিনি ঈশ্বরকে পেয়েছেন একান্ত আপন করে। লেখিকা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে কাজী নজরুলের মতবাদ ও বিশ্বাস নিয়ে বাঙালি মনে যে নানা প্রশ্ন আছে এবং তাঁকে নিয়ে যে আলোচনা সমালোচনা রয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রের মাধ্যমে গবেষণা করে বিশদ ভাবে লিখেছেন।
এই বই খানা লেখিকার গবেষণার অন্যতম প্রকাশ আমি মনে করি।

এতো সুন্দর সহজ পরিশীলিত ভাষায় একখানা গবেষণার বই সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইখানা উপভোগ করলাম। এবং বর্তমান সময়ের জন্য বইখানা খুব সময়োপযোগী। আমার কাছে খুবই সুখপাঠ্য মনে হয়েছে।পড়তে পারেন আপনারাও।
এই বইখানা এবারের বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে।

আপনারা চাইলেই বইমেলার স্বদেশ শৈলী ৩৭৫ নং স্টলে বইখানা পেয়ে যাবেন।

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন