-আয়েশা সিদ্দিকা
বইঃ বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ
(বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড -এর ভাষান্তর)
লেখকঃ নেভিলে অ্যান্থনী মাসকারেণহাস
অনুবাদকঃ মোহাম্মদ শাহজাহান
লেখক সম্পর্কেঃ
অ্যান্থনি মাসকারেণহাস পাকিস্তানে বসবাসকারী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিক। তার সঙ্গে এ,কে,ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
১৯৭১ সালে অ্যান্থনি প্রথম সাংবাদিক হিসেবে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশ ভূখন্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যার কাহিনী বিশ্ব জনমতের সামনে তুলে ধরে।
লেখক বঙ্গবন্ধুর কাছের বন্ধু ছিল। লেখক শেখ মুজিবকে একবার বলেছিল ” আমি তোমাকে তোমার স্ত্রীর চেয়েও বেশি জানি”
মূল আলোচনাঃ
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ৭ মার্চের সেই বিখ্যাত ভাষণে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনগণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। শহীদ হয় তিরিশ লক্ষ মানুষ।
দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের ৯৩,০০০ সৈন্য আত্নসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর জীবনে চরম অনিশ্চয়তাপূর্ণ নয়টি মাসের অবসান ঘটিয়ে কারামুক্তি লাভ করেন।
১০ জানুয়ারী দেশে ফিরে আসেন।
“মুজিব শব্দটি একটি যাদু। মুজিব একটি অলৌকিক নাম ” যে যাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেশের জনগণ তাকে মানবদেবতায় পরিণত করেছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার পর তার সেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা লোপ পেতে শুরু করে। দেশে এসে তিনি প্রশাসন তৈরিতে ব্যস্ত হন। আর সেই প্রশাসনে বিভিন্ন ক্ষমতালোভী চাটুকাররা জায়গা করে নেয়। মুজিবনগর সরকারে শেখ মুজিবের জন্য প্রেসিডেন্ট পদ খালি রাখা হলেও তিনি তাজউদ্দিনকে সড়িয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হন যেহেতু শাসনকার্য পরিচালনার ভার প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আর প্রেসিডেন্ট পদে বসান অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে।
স্বাধীনতার পর দেশে অর্থনীতিতে ধস নামে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম বুভুক্ষ মানুষের নাগালের বাইরে গেল। দেশে দুর্ভিক্ষ, দূনীতি, লুটতরাজ, বেকারত্ব,গুম বাড়তেই থাকল।
দেশের স্বাধীনতার পর একটি লোককেও না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না বলে আসা শেখ মুজিব আশা দিয়েছিলেন। অথচ না খেতে পেয়ে প্রচুর লোক মারা যায়।
আবার তার ছিল সেনাবাহিনীর প্রতি একপ্রকার অনীহা। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তিনি কখনই গড়তে চান নি।
পরে তিনি আমেরিকান কায়দায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের প্রবর্তন করেন।
১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী করা হয়। ( চতুর্থ সংশোধনী পড়ে নেবেন) এবং তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হন।
৭ জুন ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেন। আর এর মাধ্যমে দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করে।
গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে দেশে যেন একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। ফলে জনগণের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ ঘৃণিত ব্যাক্তিতে পরিণত হয়।
এরই প্রেক্ষিতে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশকে বাঁচানোর প্রয়োজন বলে মনে করে। আর লিপ্ত হয় ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই সেই ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ চালায়। বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে সবাইকে হত্যা করে।
তারপর ক্ষমতায় বসায খন্দকার মোশতাককে। কিন্তু তিনিও শেখ মুজিবের নীতিই অনুসরণ করতে থাকে। ফলে মেজররা মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় তাঁকেও উৎখাত করে। ১৯৭৫ সালের ৬ ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। এই অভ্যূত্থানের নায়ক খালেদ মোশাররফ সিপাহী বিপ্লবে মারা যায়। তারপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে সড়িয়ে ক্ষমতায় বসেন মেজর জিয়াউর রহমান।
মেজর জিয়া ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি রাতের বেলাও কালো সানগ্লাস পড়ত যাতে তার চোখ স্টাডি করে কেউ মনে গতি অনুধাবন করতে না পারে। আবার এক হাতে হত্যা এবং অন্য হাতে আহার করতে পারতেন।
কিন্তু তার মন্ত্রীসভাতে পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন দালালের গোষ্ঠীরা সংযুক্ত ছিল। ফলে জিয়াকেও উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ। কিন্তু এই অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারীকে প্রবাসে পাঠিয়ে ১১৪৩ জন সৈনিককে ফাঁসি দেন মেজর জিয়া। তাঁর সময়ে পাঁচ বছরে তিনি ২০ বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
তারপর জেনারেল মঞ্জুর জিয়াহত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে। এবং লেঃ কর্ণেল মতি, মোসলেহউদ্দিন ও মেজর মোজাফফর সহ জিয়াউর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এই বইয়ের লেখক এভাবেই মুজিব হত্যা, জিয়াহত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে জেলে হত্যা করার ঘটনা তুলে ধরেছেন।