Ads

‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’- একজন কবির জীবনের গল্প

এম আর রাসেল

আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।

এমন ছন্দময় কবিতার জনক কে হতে পারে? এমন করে আবেগের নদীতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে ছিপ নৌকা কে ভাসাতে পারে? আরও কিছু ছন্দের রূপ দেখা যাক-

“ফুল নেয়া ভাল নয় মেয়ে।
ফুল নিলে ফুল দিতে হয়, –
ফুলের মতন প্রাণ দিতে হয়।”

ফুলের মতো প্রাণ দেয়ার দরকার নেই। জগতের সকল প্রাণী ফুলের মতো নির্মল হোক এটাই চাই। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কোন কবির কথা বলতে এত এত ভূমিকার অবতারণা করছি। যারা এখনও ধরতে পারেননি তাদের আর একটি কবিতার লাইন শুনিয়ে দেই, –

“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।”

আসমানীর কথা শুনলেই আমাদের মধুমতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা ফরিদপুর শহরের কথা মনে পড়ে। এই শহরের তাম্বুল খানা গ্রামে জন্মেছিলেন জসীম উদদীন। তিনি আমাদের কাছে পল্লী কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত।

কবি হলেও তিনি নাটক, গল্প ও উপন্যাসও রচনাতেও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। অসাধারণ কিছু ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। ‘চলে মুসাফির’, ‘হলদে পরীর দেশ’, ‘যে দেশে মানুষ বড়’ প্রভৃতি রচনা পাঠ করে অত্যন্ত সরস ও সহজ ভাষায় ভিন দেশের অপরূপ কিছু চিত্রের সাথে পরিচিত হওয়া যায়৷ কবির আত্নকথামূলক রচনা ‘জীবনকথা’ অনবদ্য এক সৃষ্টিকর্ম। এই বই নিয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইতে বলেছেন, এরকম রচনা সচরাচর দেখা যায় না’।

এর বাইরে তাঁর উপন্যাস ‘বোবা কাহিনী’, ‘ বউ টুবানির ফুল’, স্মৃতিকথা ‘স্মরণের সরণী বাহি’ রচনাগুলো পাঠক মনকে তৃপ্ত করে। আজ এই খ্যাতিমান লেখকের লেখালেখি জীবনের শুরুর দিকের কিছু গল্প শোনাতে চাই। এর জন্য কবির লেখা একটি বইয়ের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। 

বইটির নাম ঠাকুর- বাড়ির আঙিনায়’। বইটিতে ‘রবীন্দ্র তীর্থে’, ‘অবন ঠাকুরের দরবারে’, ‘নজরুল’ এই তিন শিরোনামে কবি নিজের জীবনকথা শব্দের ফ্রেমে বন্দী করেছেন। এখানে কবির জীবনের ক্ষুদ্র একটি অধ্যায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বইটির ভিতরের কিছু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরছি।

‘রবীন্দ্রতীর্থে ‘ শিরোনামে মূলত জসীম উদদীন কবিগুরুর সাথে তাঁর কাটানো কিছু সময়ের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি পড়াশোনার সুবাদে যখন কলকাতায় ছিলেন তখন কিছুদিন ঠাকুর বাড়িতেই অস্থায়ী আবাস গড়েছিলেন। সেখানে তিনি কবিগুরুর সাথে সাক্ষাৎ করেন, নিজের লেখা কবিতার বই কবিকে পড়তে দেন। বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাহিত্য, রাজনীতি, গান , হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক প্রভৃতি নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। এক আলোচনায় বন্দে মাতরম গানটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,

‘বন্দে মাতরম গানটি যে ভাবে আছে, তোমরা মুসলমানেরা তার জন্য আপত্তি করতে পার। এ গানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুণ্ণ হওয়ার কারণ আছে।’

এই গান নিয়ে হিন্দু মুসলিম বিরোধ উসকে উঠেছিল। পরে রবীন্দ্রনাথ এ গানের আপত্তিজনক অংশটি গীত না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বইয়ের তথ্য মারফত এ বিষয়ে জানতে পারা যায়। ‘রাখালী’ ও ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন,

‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরণের। প্রকৃত হৃদয় এ লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’

‘সোজন বাদিয়ার ঘাট ‘ পড়ে কবিগুরু মন্তব্য করেছিলেন,

‘তোমার সোজন বাদিয়ার ঘাট অতীব প্রশংসার যোগ্য। এ বই বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।’

‘বালুচর’ কাব্য প্রকাশিত হলে অনেকেই জসীম উদদীনের ছন্দের সমালোচনা করে। এ ব্যাপারে জসীম উদদীন রবীন্দ্রনাথকে বললে জবাবে তিনি বলেন,

ওসব বাজে লোকের কথা শোন না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার কর। ইচ্ছা করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মত। তাতে প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।’

রবীন্দ্রনাথের দেয়া প্লট অবলম্বনেই তিনি ‘পল্লী বধূ’ নাটকটি লিখেছেন। কবিগুরুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে প্রভাকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। সেখানে হাসু নামের এক ছোট্ট খুকীর সাথে কবির সখ্যতা গড়ে উঠে।

পিচ্চি এই খুকীকে কবি মাঝে মাঝে পত্র দিতেন ও কবিতাও লিখতেন৷ এই খুকীকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো একত্র করে তিনি ‘হাসু’ নামে বই বের করেন।

সেখানে একটি মেয়ের গান শুনে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই মেয়েটিকে কল্পনা করেই কবি ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ এর নায়িকার রূপ বর্ণনা করেছেন।

‘অবন ঠাকুরের দরবারে’ শিরোনামে কবি অবনীন্দ্রনাথ এর সাথে কাঠানো মধুর কিছু স্মৃতির বর্ণনা করেছেন। অবন ঠাকুরের জীবন বর্ণনার পাশাপাশি ঠাকুর বাড়ির অন্য মানুষদেরও চিত্রিত করেছেন।

অবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন খ্যাতিমান শিল্পী ছিলেন। জসীম উদদীনের কাব্য চর্চায় অবনীন্দ্রনাথের ভূমিকাও ছিল বেশ অত্যুজ্জ্বল। অবন ঠাকুর জসীম উদদীনকে পল্লী গান সংগ্রহে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।

অবন বাবুর বাড়িতেই একটি আসরে গল্প বলে জসীম উদদীন প্রত্যাখাত হয়েছিলেন। পরে সুদীর্ঘ এক বছর সাধনা করিয়া গল্প বলা আয়ত্ত করেছিলেন। এর ফলেই হয়ত তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন ‘ বাঙালির হাসির গল্প’ নামের জনপ্রিয় বই।

‘নজরুল’ শিরোনামের লেখনীতে জসীম উদদীনের প্রথম জীবনে কলকাতা বাসের বিবরণ, নজরুলের সাথে কবির পরিচয় পর্বের বর্ণনা, ফরিদপুরে নজরুলের আগমন ও বিদ্রোহী কবির জীবনের ক্ষুদ্র কিছু চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন জসীম উদদীন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পত্রিকা বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করতেন। এর পাশাপাশি নিজের কবিতার খাতা নিয়ে পত্রিকা অফিসে ঘুরে বেড়াতেন। চারুচন্দ্র বন্ধ্যোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে ব্যথিত হয়েছিলেন।

এরপর তিনি ভোলার কবি মোজাম্মেল হকের পরামর্শে কাজী নজরুলের সাথে দেখা করেন। নজরুল তরুণ কবিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।

জসীম উদদীনের কবিতার খাতা পড়ে মধুর স্নেহে বলেছিলেন, ‘তোমার কবিতার মধ্যে যেগুলি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। এগুলো নকল করে তুমি আমাকে পাঠিয়ে দিও।’

এরপর কাজী নজরুল ফরিদপুরে আসলে জসীম উদদীনের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তরুণ কবি জসীম উদদীনকে উৎসাহ দেয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। কাজী নজরুল লিখেছিলেন,

ভাই শিশুকবি, তোমার কবিতা পেয়ে সুখী হলুম। আমি দখিন হাওয়া। ফুল ফুটিয়ে যাওয়া আমার কাজ। তোমাদের মত শিশু কুসুমগুলিকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চলে যাব আমার হিমগিরির গহন বিবরে।’

সর্বোপরি বইটি পড়ে এ কথা বলতেই হয়, কবিতার মতো গদ্যেও কবির শব্দচয়ন, বর্ণনাভঙ্গি অপরূপ সুষমায় দ্যুতি ছড়িয়েছে। পড়তে গিয়ে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করে না ৷ সরল বাক্য ও পরিশীলিত উপস্থাপনা বইটিকে সুখপাঠ্য রচনার তকমা পরিয়ে দিয়েছে।

আজ কবির মৃত্যুদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই…

লেখকঃ গবেষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন