Ads

এক গেরাস ভাত । মধ্যবিত্ত পরিবারের সংগ্রামের গল্প

পিনাকী রঞ্জন বিশ্বাস

বছর জুড়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের মা সেই কাক ভোরে উঠে মুখ ধুয়ে লেগে পড়েন সারা বাড়ী ঝাঁট দিতে । তারপর গত রাতের এঁটো বাসন মাজা । এসব করতে করতেই রাস্তার ধারে মিউনিসিপালিটির কলে জল এসে যায়, তাড়াতাড়ি জল তুলে এনে স্নান সেরে লেগে পড়েন রান্নায়। কোন দিন শুধুই সামান্য ডাল অথবা ঘরে থাকা আনাজ দিয়ে একটা তরকারী, নিদেনপক্ষে সেদ্ধ ভাত, যেদিন যা জোটে খাওয়া দাওয়া করে, ছোট সন্তানদের খাবার দুটি থালায় বেড়ে, অনেক দূরে এক প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতে বেরিয়ে যাওয়া। মাইনে মাস গেলে তিরিশ টাকা । যার মধ্যে যাতায়াত খরচই বেড়িয়ে যায় দশ টাকা।মা তার কর্মস্থলে গেলেও মন পড়ে থাকে সন্তানদের দিকে ।

একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, একেবারে পিঠোপিঠি ভাই বোন । মেয়েটি পড়াশোনায় অতন্ত্য মেধাবী তাই ছেলেটির থেকে এক বছরের বড় হয়েও দু’ ক্লাস উঁচুতে পড়ে । ছেলেটির এখন ক্লাস থ্রী আর মেয়েটির ক্লাস ফাইভ। তারা নিজেরাই স্নান খাওয়া দাওয়া করে ঘরে তালা মেরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে চলে যায় । মেয়েটির স্কুল কিছুটা কাছে হলেও ছেলেটির স্কুল বাড়ী থেকে দু’মাইল দূরে । সেই শিশু বয়েস থেকেই প্রতিদিন চার মাইল হাঁটা । মাঝে মাঝেই ছেলেটি দেখে, তার কয়েকজন সহপাঠী টিফিন খায় । নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা শিখে গেছে ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে ওদিকে তাকাতে নেই ।কোন মতে টিউবওয়েল পাম্প করে জল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের এক মিথ্যা চেষ্টা করে ক্লাসে এসে বসা ।সন্ধ্যায় মাও ঘরে ফিরে এসে এক গ্লাস জল খেয়ে ক্ষিদে নিবারণের চেষ্টা করে একটু বিশ্রাম নেন তারপর আবার রান্না।সন্তানদের খাইয়ে নিজে খেয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে মেঝেতে পাতা বিছানায় এলিয়ে দেন। এ রুটিনের কোন পরিবর্তন নেই।

বাবা ভিন রাজ্যে একটা ছোট খাটো কাজ করেন । মাসের প্রথমে বাড়ী আসেন সঙ্গে সামান্য কিছু মাস কাবারি জিনিষ নিয়ে আসেন ।দুটো দিন বাড়িতে থেকে আবার চলে যান । সন্তানরা বাবা বাড়িতে আসার অপেক্ষায় থাকে, বাবা বাড়ি ফেরার আনন্দ তো তাদের থাকেই তার সাথে লুকিয়ে থাকে আরো দুটো আনন্দ।বাবা সাথে করে নিয়ে আসেন এক ঠোঙা মুড়ি। সেটাই দুই ভাই বোনের কাছে চরম আনন্দের । তারা জানে মাসের প্রথম এক সপ্তাহ স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে এক গাল মুড়ি খেতে পাবে । আর দ্বিতীয় আনন্দ খবরের কাগজের ঐ মুড়ির ঠোঙাটি ।দু ভাই বোন খুব যত্ন করে জলে ভিজিয়ে সেটিকে খোলে ।কত কিছু লেখা থাকে এই কাগজে, এটাই তাদের সংগ্রহের নেশা । সেবার পুজোর মাসের প্রথমে বাবা বাড়ী এসেছেন, যথারীতি সঙ্গে মুড়ির ঠোঙা। দুই ভাইবোন খালি ঠোঙাটি খুলে দেখে বাটা কোম্পানীর কি সুন্দর জুতোর বিজ্ঞাপন । তারা ছবি দেখেই খুশি হয়,

কারণ তারা জানে কাগজে ছবি দেওয়া তাদের পছন্দ মতো জুতো কিনে দেওয়ার মত সামর্থ্য তাদের মা বাবার নেই । সেফটি পিন দিয়ে লাগানো ছেঁড়া ফিতের হাওয়াই চটিই তাদের একমাত্র ভরসা । পুজো আসে, চলেও যায়, বেশ কিছুদিন দুই ভাইবোন এই কাগজ দেখেই আনন্দ পায় ।

মা প্রতিদিন সকালে যখন রান্না ঘরে ভাত খেতে বসেন তখন মাঝে মধ্যেই ছোট্ট ছেলেটি রান্না ঘরে ঢুকে মাকে বলে, “এক গেরাস ভাত দেবে মা ”? অনিচ্ছা স্বত্বেও মা মুখে তুলে দেন এক গেরাস ভাত । ছোট্ট মেয়েটি প্রচন্ড বুদ্ধি ধরে, সে জানে মা সকালে যা খেয়ে যান তাতে মায়ের ঠিক মত পেট ভরে না, তাই সে চেষ্টা করে মায়ের খাওয়ার সময়টিতে ভাইকে রান্না ঘর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ।সেদিনও মা খেতে বসেছেন, মেয়েটি ভুল বশতঃ রান্না ঘরে ঢুকে দেখে মা খাচ্ছেন । সে চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে । ভাইটি দেখে ফেলে সেটি। সে মনে করে দিদি বুঝি আজ মায়ের থেকে এক গেরাস ভাত খেয়ে এসেছে। সেও রান্না ঘরে ঢুকে মাকে বলে, “এক গেরাস ভাত দেবে মা”? আজ মা তাকে পাশে বসিয়ে নিজে না খেয়ে পুরো ভাত তার মুখে তুলে দেয় । ছেলেটি দেখে মা খাচ্ছেন না । শিশু মন মাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি খাবে না মা”? মা বলেন না ।পুরো ভাত শিশুটিকে খাইয়ে প্রতিদিনের মতো তাদের ভাত বেড়ে রেখে স্কুলে বেরিয়ে যান । শিশু দুটি যথা সময়ে তাদের জন্য বেড়ে যাওয়া ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যায় । সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে জানতে চান দুজনই ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়েছিলো কিনা? মা আজ একটু তাড়াতাড়ি রাতের রান্না সেরে শিশুদের খাইয়ে এবং নিজে খেয়ে শুয়ে পড়েন ।

ছোট্ট ছেলেটি লক্ষ্য করে মায়ের মনটা আজ কেমন যেন ভালো নেই ! পাশে শুইয়ে মাকে বলে, মা তুমি বড় হয়ে একটা একশো টাকার চাকরি জোগাড় করবে, তাহলে আমাদের আর কোনদিন অভাব থাকবে না ।মায়ের সে রাতে কি মনে হয়েছিলো ছোট্ট শিশু তার খবর রাখে নি ।তাদের নিয়ে যাবেন । দু’ ভাইবোন আনন্দে লাফিয়ে ওঠে । একদিন চোখের জলে মা তাদের বাবার সাথে মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দেন । দু’ বছর শিশু দুটি সেখানেই পড়াশোনা করে বড় হতে থাকে । একদিন তারা জানতে পারে তাদের মা নুতন করে পড়াশোনা করে একটি হাই স্কুলে বড়দির চাকরি পেয়েছেন । তাদের আনন্দ তাদের মনেই থেকে যায় । যথা সময়ে মা তাদের কাছে নিয়ে আসেন।

ছেলে মেয়ে দুটি মানুষ হয়েছে । আজ তারা অনেক বড় চাকরি করে । তাদের গাড়ী বাড়ী সব হয়েছে । কালের নিয়মে মায়ের বিদায় লগ্ন এগিয়ে আসে । একদিন ছেলেটি অফিস থেকে ফিরে দেখে মা শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন । মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চায় কান্নার কারণ । অনেকক্ষণ চুপ থেকে মা বলে ওঠেন, “ একদিন তোদের মুখে এক গেরাস ভাত তুলে দিতে পারি নি”।আমি কি নিষ্ঠুর ছিলাম, তোদের পেটে কি পরিমাণ ক্ষিদে থাকতো তা আমি উপলব্ধি করতে পারিনি, যখন পেরেছি তখন আমার হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেছে । মনে পরে তোর সেই সেদিনের কথা, যেদিন আমি রাগ করে তোর মুখে সব ভাত তুলে দিয়ে না খেয়ে স্কুলে চলে গিয়েছিলাম? তারপরেও তোরা তোদের ভাত খেয়ে স্কুলে গিয়েছিলি । তোদের পেটে কি প্রচন্ড ক্ষিদে থাকতো! ছেলেটি হেসে বলে ছাড়ো না মা ওসব কথা, সে তো আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও আগেকার কথা । এমনি করে সময় এগিয়ে আসে মা মৃত্যু শয্যায় শুয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, “এক গেরাস ভাত…….” কথা বের হয় না মুখ দিয়ে, ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দেন, “ তোদের মুখে দিতে পারি নি”। চোখ থেকে গড়িয়ে পরে অশ্রুবিন্দু । ঠোঁট দুটি সামান্য কেঁপে ওঠে, বালিশের এক পাশে ঢলে পড়ে মায়ের মাথাখানি ।

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক, কলকাতা, ভারত

লেখকের প্রকাশিত লেখা-

ধর্মের রং সাদা

 

আরও পড়ুন