লতিয়ে ওঠা চুলের বেণী দু”টো সামনে টেনে বই খাতার সাথে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হন হন করে চলতে থাকে ইরা। পেছনে মেয়েদের টিপ্পনী শোনে,
“শুধু ভালো ছাত্রী হলেই হয় না,ভদ্রতা জানতে হয়।”…
ওরা সবাই ইরার সহপাঠী, এস.এস.সি শেষ করে সবে কলেজের গন্ডীতে পা রেখেছে। একেকজন একেক স্কুলের। এদের মধ্যে ইরার নিজের স্কুলের ছাত্রী একজনও নেই।মাত্র ক’দিন হয় ক্লাশ শুরু হয়েছে।তাই কারো সাথে ওর তেমন পরিচয় হয়ে ওঠেনি।কথাটা বোধহয় ভুল হলো,বরং কারো পরিচিত হতে ইরার কোনো ইচ্ছাই হয় নি। কলেজের প্রথমদিন কমনরুমে ঢুকতেই মেয়েগুলোকে উচ্চস্বরে হাসতে আর জটলা পাকাতে দেখে রূমের এক কোনে চুপ করে বসে পড়েছিল ও।চুপচাপ থাকতে পছন্দ করা ইরা সেদিন কারো সাথেই কথা বলেনি। ক্লাশে ওদের কৌতুহলী দৃষ্টি তাকে ঘিরে ধরলেও লম্বা,ফর্সা ও একহারা মেয়টাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি কেউ। কিন্তু তা দিতে হলো যখন বায়োলজি ক্লাশে সে জানালো
‘রেনিন’ নামের জারক রসের কারণে শিশুদের পেটে দুধ হজম হয়।একইভাবে ইংরেজি ক্লাশে দুর্বোধ্য কিছু Active voice =কে নির্দ্ধিধায় passive করে সহপাঠীদের আর শিক্ষককে তাজ্জব করে দেওয়ায় দেবী নামের মেয়েটি সেই প্রথম কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে জানতে চাইল ওর নাম, রেজাল্ট আর স্কুল।
এরপর থেকে সবাই সমীহের চোখে দেখলেও কারো সাথে ওর আন্তরিকতা জমে না বরং অন্যদের থেকে নিজেকে একটু আড়াল করেই রাখে ইরা। ওর এহেন আচরণ সহপাঠীদের কাছে অভদ্রতা মনে হয়।
সবাইকে এড়িয়ে চললেও মাসুদা নামের মেয়েটির সাথে নিজের অজান্তেই ভাব হয়ে যায় ওর। ক্লাশে পাশাপাশি বসা,দু’চারটে কথাবার্তা আর অনুভুতি ভাগাভাগি করে নেওয়া। ব্যস!ওই পর্যন্তই।
ইরার মত মাসুদাও বেশি কথা পছন্দ করে না। কিন্তু কলেজে গিয়ে কমনরুমে একজন আরেকজনকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত যেন স্বস্তি পায়না কেউই। তারপর কুশল বিনিময় আর চুপচাপ একসাথে থাকা।
কিন্তু রাতদিন নিজের সাথে কথা বলা চলে ইরার। কলেজে যাওয়ার পথে নরম সবুজ ঘাসের ডগাগুলো মাড়াতে ওর ভিষণ খারাপ লাগে।
মনে হয় ওরা কতই না ব্যথা পাচ্ছে। ‘একটু কষ্ট কর। আমি এক্ষুনি পার হয়ে যাব।’ =ওদের উদ্দেশ্যে করে দু’বেলা আশ্বাস দেওয়া চলে। সৃষ্টির সেরা যদি মানুষই হবে তাহলে কেন ওদের কাউকে কাউকে দেখলে বিরক্ত লাগে?
এ প্রশ্নের সমাধান বের করে নিজেই_এর কারণ মানুষ অনর্থক বকবক করে। অনেক বাজে অভ্যাসের মধ্যে এটি একটি। পায়ের তলার ঘাসগুলোকে বড় নিস্পাপ আর ভালোলাগে ইরার।বোধহয় ওরা কথা বলেনা তাই। কষ্টগুলো মনের ভেতর চেপে রাখে। নির্বিকার বলেই ওরা অন্তরের মমতা কাড়ে। মনে মনে ইরা অনর্থক কথা না বলার সাধনা করে চলে। চেতনে অবচেতনে এমনই সব অসংখ্য
ভাবনায় ইরার দিন রাত্রি থাকে মুখর।বাড়ির পুকুর ধারে ছোপ ছোপ সবুজ রঙা ঝোপের পাড়ে বসে দেখে ঘাসফড়িং আর প্রজাপতিদের নেচে বেড়ানো। কখনো সারি বেঁধে চলা পিঁপড়ের মিছিলের গন্তব্য খুঁজতে উবু হয়ে ঘন ঘাসের নিচে উঁকি মারে ও। চপল হাওয়ায় কলাগাছের পাখার মত পাতাগুলোর এদিক ওদিক মাথা নাড়ানাড়ি, মনে হয় ইরাকে কোন কিছু থেকে নিবৃত করার অভিব্যক্তি। লালকালোয় মেশানো ঘোড়া পোকাগুলো ঘাসের মধ্যে চলতে চলতে হঠাৎ মাথা তুলে থামে, শুঁড় উঁচু করে কি যেন বলতে চায়। নাকে এসে লাগে অচেনা ফুলের সুবাস। লেখাপড়ায় অত্যন্ত মনোযোগী ইরার দিন রাত্রি কাটে এমনই নিদারুণ এক ব্যস্ততায়। নাওয়া খাওয়া,কলেজ,পড়াশোনা আর ভাবনার আবর্তে ঘুরতে থাকে তার সব। এরই মাঝে ঘটে আরেক বিপত্তি।
একদিন সে আবিস্কার করে তার শীর্ণ গ্রীবা, কণ্ঠদেশ আর মুখমন্ডলের ঈষৎ পরিবর্তন।
পেলব আস্তরণে কখন যেন ওরা হয়েছে আগের চেয়ে বেশি মসৃণ। অবাক ইরা আয়নায় দেখে অন্য ইরাকে।চোখের তারায় অভূতপুর্ব দ্যুতি, লালিত্যময় পদচারনা _মনেহয় পুরো পৃথিবী ওর দিকে চেয়ে আছে,অবাক বিস্ময়ে।
নিজেকে সম্রাজ্ঞী মনে হয়। খামোখাই গুনগুনিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। সদ্যোজাত বিটপেরা মৃত্তিকার বুক ফুঁড়ে সূর্যের দেখা পেতে না পেতেই ইরাকে দেখে যেন থেমে যায়। দিশেহারা ইরা সন্তর্পণে এসব উৎপাত সামলাতে থাকে।
নানী এসেছেন বাড়িতে। চিড়া,নাড়ু আর কত রকমের পিঠার সাথে গল্পের ঝুলি নিয়ে। কত রকমের গল্পে দিন কাটায় ইরা। একাকী ভাবনার যাতনা থেকে খানিকটা রেহাই পায়। কিন্তু নানী আগের মত ওকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি করে হাসলেও ওর বেয়াড়া চুলগুলো সযতনে বেঁধে দিতে উদ্যোগী হন না। আসলে ওঁর শরীরটা বেশ খারাপ। ইরাদের এখানে এসেছেন ডাক্তার দেখাবেন বলে। তা হলেই বা কি। ইরার শ’ খানেক প্রশ্নের নিদেনপক্ষে পঞ্চাশটা উত্তর নানিকে দিতেই হয়। তার মধ্যে আম্মুর বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। ‘তোর মায়ের চুলগুলো তোর চুলের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ছিল। গায়ের রং-তো দুধে আলতায়।এখন তো আমি ওকে চিনতেই পারিনা,ও আমার সেই সুন্দর মেয়েটা_নানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন। বলে কি? আম্মু কি ওর চেয়ে সুন্দর ছিল? নানী বুঝি বাড়িয়ে বলছেন। নানীর মুখের দিকে চেয়ে ইরা ভাবতে চেষ্টা করে _
এই নানীও তো এক সময় ওর মতো, ওর আম্মুর মতো বয়সের ছিলেন। চলনে-বলনে এখনকার স্থবিরতা নিশ্চয়ই সব সময় ছিল না।ইরার মতো তখন নানীও কি প্রজাপতির ছন্দে উড়ে উড়ে বেড়াত?
ঈষৎ রেখাময় হয়ে ওঠা নানীর হাত দুটো ইরার মনে আরেক ভাবনার জন্ম দেয়।ক্রমশ তা থেকে শাখা প্রশাখা ছড়াতে থাকে।তাহলে এই মধুমাখা স্বর্ণালি দিনগুলি, যা সে উপভোগ করছে তা চিরকাল থাকবে না?সুন্দর প্রহর, সুন্দর অবয়ব সবই ক্ষণস্থায়ী? তাহলে কেন এ জীবন?নাহ! ইরার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না।একটু বিমর্ষ দেখায় ওকে। সেটি লক্ষ্য করে নানী অনেক মজার মজার কথা বলেন,চুলে বিলি কেটে সেকেলে সুরে গান শোনান।নানীর হাঁটুতে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বোজার ভান করলেও ইরার অন্তরে বয়ে চলে সর্বগ্রাসী কালবৈশাখী ঝড়।যে ঝড়ে ওর ছেলেবেলার চিত্রপটে আঁকা ছবিগুলো ওলোটপালট হয়ে যেতে থাকে। তার যা কিছু অর্জন, ভালো রেজাল্ট,অন্যের সাথে ভালো ব্যবহার , নামাজ,এগুলোর কি কোনোই মুল্য থাকবে না? ভাবনের ঢেউ যখন প্রবল আকার ধারণ করে,তার টানে ইরা সমাধানের সৈকতে পৌঁছে যায়।
বাসায় আমপাড়া পড়াতে আসা মওলানা সাহেব একদিন কোরআন মাজীদের একটা আয়াতের অর্থ জানতে চেয়েছিলেন ইরার কাছে।ইরা তার জবাব দিতে পারেনি। সেই মুহূর্তে ওর নিজেকে একটা নির্বোধ মনে হয়েছিলো।যে মেয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে করা স্যারদের যেকোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারে সে কিনা নিরুত্তর বোকাদের মত চেহারা করে বসে রইলো একজন মওলানা মানুষের সামনে!মনের চোখে ইরা নিজেকে দেখে সেই মেয়েগুলোর চেহারায় যারা ক্লাশে স্যারদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে অধঃবদনে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের কাছে নিজেকে খুবই ছোট মনে হয়।সেই মহাগ্রন্থ যাকে বলা হয় মানব জীবনের পথ চলার নির্দেশিকা। সেটির এক বর্ণ অর্থও সে জানেনা। জানে কেবল হাতে গোনা ক্ষুদ্র কয়েকটি সুরা। যেগুলি সাজিয়ে সে নামাজ নামক এক আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।ছিঃ!ছিঃ!ইরা সংকল্প করে আল কোরানের অর্থ বুঝে পড়তে শুরু করার।আব্বুর একটা তরজমা কোরান মজিদ আছে।মওলানা স্যারের জিজ্ঞেস করা আয়াতটা খুঁজে বের করে সে।’নিশ্চয়ই আমি মানুষ এবং জ্বিনকে আমার এবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করি নাই।’
তবে কি মানুষ ও জ্বিনদের দিন রাত নামাজ, রোজা,তাসবীহ পাঠ করে সময় পার করতে হবে?
তাহলে ক্ষুধানিবৃত্তি,তার জন্য অর্থ উপার্জন, মানুষের আপদ_বিপদে অংশগ্রহণ করা কখনও কখনও বিনোদনের জন্য কিছুই করা যাবে না?
মওলানা সাহেবকে ইরার এ প্রশ্নের জবাব দিতে একটুও চিন্তিত মনে হয়না বরং তিনি তাঁর ছাত্রীর জানার আগ্রহ দেখে যারপরনাই আনন্দিত হন।
‘আবদ’ শব্দটা থেকে এসেছে ‘ইবাদত’।যার অর্থ ‘ দাসত্ব’।আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথের অনুগত হয়ে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করলেও তার সবই ইবাদত বলে গণ্য হয়।সে সব নির্দেশনা জানতে ও বুঝতে আল কুরআন ও হাদীসের অর্থ জানতে হবে। ‘
ক্লাশে মাসুদাকে ইরা বোঝায়, ‘যা পড়বি খুব ভালো করে আর যা কিছু করবি ভেবে চিনতে বুঝে বুঝে করবি।কারণ যে সময়টা চলে যাচ্ছে তা আর কোনদিনই ফিরবে না।তাই কিছু ভালো অর্জন ও সঞ্চয় করা দরকার। জীবনটা শস্যক্ষেত্র। যতটা পারা যায় পরিশ্রম করে এতে ভালো ফসল বোনা উচিত। ‘ মাসুদা মাথা নাড়ে _ ‘ঠিক বলেছিস, এই যেমন আমাদের স্কুলের লাইফটা তো আর চাইলেও ফিরে পাব না।’মাসুদার বাবা স্কুল শিক্ষক। ইরার ভাবনাগুলো ওর চেতনায় বাবাকে নিয়ে আসে।বাবাও ওকে এমন সব কথাই বলেন। কিন্ত এই এক রত্তি মেয়েটা কি করে এক স্কুল শিক্ষকের জীবনবোধ অর্জন করেছে। মাসুদা অবাক হয়ে ইরাকে দেখে।
দু’দিন ধরে হঠাৎই লাপাত্তা ইরা।ওর বাসাটা চিনে নেওয়াও হয়নি মাসুদার।দুজন দুজনের মোবাইল নম্বর নিয়েছিল।কিন্ত মাসুদা যে কোন খাতার মধ্যে টুকে নিয়েছিল মনে করতে পারে না।সেইভ করা হয়নি।সহপাঠী অন্য মেয়েদের কাছে ইরার অনুপস্থিতি খুব একটা মাথাব্যথার কারণ হয়েছে বলে মনে হয় না। নিরবে তাই মাসুদা ইরার অপেক্ষায় থাকে। তিন দিনের দিন ওর প্রত্যাশায় সাড়া দিয়ে ইরার কল আসে।ও ঠিকই মাসুদার নম্বরটা সেভ করে রেখেছে। ইরার বক্তব্যের সারমর্ম হলো,সেদিন ক্লাশশেষে বাড়ি গিয়েই নানীর মৃত্যুসংবাদ পায় ওরা। সপরিবারে তাই নানাবাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল ওদের। আরো তিন দিন পরে বাড়ি ফিরবে ইরারা।
মোবাইলে ইরা মাসুদাকে ওর নানীর জন্য দোওয়া করতে বলে। তার সাথে ইরা এ কথা বলতেও ভোলে না যে,সে এর আগে অনেক মৃত্যু দেখেছে কিন্তু কস্মিনকালেও ভাবেনি যে, তার আপনার কেউ মারা যেতে পারে।
এখন বুঝেছে, যে কোন মুহূর্তে যে কারো মৃত্যু হতে পারে। কেউই তা থেকে রেহাই পাবে না। ওর চেতনায় সহমর্মি মাসুদা মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ অনুভব করতে থাকে। যেন সেটি ওর মাথার ওপর দুহাত প্রসারিত করে রেখেছে। যে কোন সময়েই সে দুটো ঝপাৎ করে নেমে ওর কন্ঠরোধ করে ধরবে।’Man is mortal’_পুস্তকে পড়া চিরন্তন সত্যটা আজ ওকে ভীত করে তোলে।
ইরা ফিরেছে। কিন্তু এ কোন ইরা? সুদৃশ্য একখণ্ড কাপড়ে মাথা,ঘাড় আর থুতনির নিচের বেশ খানিকটা জড়িয়ে থাকা ইরার মুখটা একটু অচেনা লাগে মাসুদার।চোখে চোখ পড়ে।যা বোঝার বুঝে নেয় সে।ওকে ইরার কিছু বলতে হয় না।মানুষের জীবন চলার নির্দেশিকা যে গ্রন্থটি, _তা ওকে এমনি নির্দেশ দিয়েছে। (শেষ)
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ ৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ ৷
লেখকঃ নাসরিন আক্তার আব্বাসি,সহকারী অধ্যাপক, কবি ও সাহিত্যিক