Ads

চেহারা

 

পাঁচ তারকা হোটেল তাজমহলের নবীন ফ্রন্ট অফিস এক্সিকিউটিভ আন্দালিব রহমান অনু। আজকে ইভনিং ডিউটি অনুর। জয়েন করার পর থেকেই ইভনিং ডিউটি টা খুব ইন্টারেস্টিং লাগে অনুর কাছে। আসলে হোটেলের চাকরী টাই ওর কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। বিভিন্ন দেশের কত বিচিত্র ধরনের মানুষ আসে এসব হোটেলে। জীবনে চলার পথে ওয়েটিং রুমের মতো মনে হয় হোটেল গুলোকে। দিনের বেলায় থাকে একরকম ব্যস্ততা আর সন্ধ্যা হলেই সেখানে যুক্ত আরেক ধরনের প্রাণোচ্ছলতা। আর এর মধ্যেও কারও কারও চেহারায় ফুটে উঠে বিষন্নতা। দেখে মনে হয় সব থেকে ও যেন তার কিছু নেই। হোটেলের চাকুরীতে যোগ দেওয়ার আগে বন্ধু বান্ধবের কাছে অনেক রসালো গল্প শুনেছে অনু। কিন্তু কাজ করতে এসে বুঝেছে দুর থেকে যতটা রসালো মনে হয় বিষয় গুলো আসলে ততটা রসালো নয় বরং অনেক জটিল এবং কঠিন। মানুষের বহুমাত্রিক চরিত্রের বিশ্লেষণ করাটা সহজ হয় হোটেলে।
আজকের সন্ধ্যা টা বেশ জমজমাট। হল রুমে একটা ফ্যাশন শো আছে। বহু নাম করা মডেল আর তারকার উপস্থিতিতে চারিদিক ঝলমল করছে। এতো সুন্দর সুন্দর চেহারার মাঝে একজনের দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে অনুর। ভদ্রমহিলা সাধারণ পোশাকেও অসাধারণ লাগছে দেখে। এর আগেও উনাকে দেখেছে কয়েকবার এবং প্রতিবারই ওর মনে হয়েছে ভদ্রমহিলা অনন্য। এক ধরনের ব্যক্তিত্ব রয়েছে ভদ্রমহিলার চেহারায়।
” কি দেখছেন, এতো? এভাবে দেখবেন না।” সহকর্মী রাতুল আস্তে করে কথাটা অনুকে বলল। অনু সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। “হাতের কাজ গুলো সেরে নিন, আজকের ডিনারটা একসাথে করবো।” রাতুল আস্তে কথাগুলো বললো।
—— ঠিক আছে, স্যার।
ঘন্টা খানেক পরে ডিনারের সময় শুরু হলে, অনু আর রাতুল ডাইনিং হলে এসে বসে। খাবার প্লেটে নিতে নিতে রাতুল বলেন, ” অনু এভাবে কখনো গেস্ট দের দিকে তাকাবেন না। আপনি নতুন জয়েন করেছেন, তাই আজকে আপনাকে বিষয় গুলো বুঝিয়ে বলার জন্য একসাথে ডিনার করতে বসা।”
—— জ্বি স্যার, আমি দুঃখিত।
—– ইটস্ ওকে। তা ভদ্রমহিলার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিলেন কেন? খুুব পছন্দ হয়েছে?
—— না, আসলে উনাকে একদমই অন্য রকম লাগে।
—— অন্যরকম মানে!
এই কথা বলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাতুল অনুর দিকে তাকালেন।
—– না মানে, উনাকে দেখে খুব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মনে হয়। মনে হয় কোন বড় করপোরেটে উচ্চ পদে আছেন আবার কখনো মনে হয় বিজনেস উওম্যান।
—— হুম, ভালোই বলেছেন তবে উনাকে নিয়ে আর বেশি আগ্রহ দেখায়েন না। উনি দিনে একটি নামি স্কুলের শিক্ষক আর রাতে. ……।
—— কি!!!!
—— এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? মনে রাখবেন এটা একটা হোটেল। এখানে যা দেখবেন, শুনবেন তা নিয়ে বেশি ভাববেন না। ঠিক আছে!
এই কথা বলে, রাতুল ডিনার শেষ করে উঠে চলে গেলেন। কিন্তু অনুর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। যদিও সে এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ দেখেছে কিন্তু আজকের বিষয় টা সে কোন ভাবেই মানতে পারছে না। যে ভদ্রমহিলাকে সে এতোদিন মনে মনে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে এসেছে তিনি কিনা! না, এসব আর ভাবতে ভালো লাগছে না অনুর। ডিনার শেষ করে অনুও নিজের কাজে ফিরে যায়। রিসিপশনের টেলিফোন বেজে উঠলে, অনু গিয়ে কলটা ধরে, ” গুড ইভনিং, অনু ফ্রম রিসিপশন। হাও মে আই হেল্প ইউ, স্যার?” ওপাশের কথা শেষ হওয়ার পর, অনু ফোনটা রেখে লবির দিকে তাকিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞেস করে, “মিস্ সারা!”। অনুকে অবাক করে দিয়ে সেই ভদ্রমহিলা উঠে আসেন। ” জ্বি বলুন?”
—– আপনি মিস্ সারা?
—– জ্বি বলুন!
—– রুম নাম্বার ১১০৭। লিফ্ট এদিকে।
—— ধন্যবাদ, আমি চিনি।
বলেই সারা লিফ্টের দিকে চলে গেলেন। অনু একদৃষ্টিতে সারার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। সারা উপরে উঠে যাওয়ার পর একধরনের খারাপ লাগা অনুকে গ্রাস করে। ও কোন ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। ওর চিন্তা, এতো টা ভুল ও করলো কিভাবে। ও মানতেই পারছে না, মিস সারা একজন এসকোর্ট।
পনের বিশ মিনিট পর, রিসিপশনের ফোনটা বেজে উঠলো। অনু ফোনটা ধরে, যথারীতি তোতাপাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া বুলি দিয়ে সম্ভাষণ করলো। ওপাশ থেকে এক্সচেঞ্জের স্টাফ পুনম কথা বলে উঠলো, “স্যার, এক্সচেঞ্জে কাউকে একটু পাঠাতে হবে। আমি ডিনারে যাবো।”
—– ঠিক আছে, আমিই আসছি। আপনি যান।
অনু ফোনটা রেখে রিসিপশন ডেস্কের ঠিক পেছনেই এক্সচেঞ্জ রুমে গিয়ে বসলো। বাইরে থেকে কল প্রথমে এক্সচেঞ্জে আসে তারপর কল গুলি নির্দিস্ট ফোনে কানেক্ট করে দেওয়া হয়। অনু এসে বসতেই বেশ কিছু কল আসলো। সবগুলি কলকে কানেক্ট করে দেওয়া পর শেষ কলটি ধরলো, ” হ্যালো, দিস ইজ তাজমহল। হাউ মে আই হেল্প ইউ?” অপর প্রান্ত থেকে রুম নাম্বার টা শুনতেই অনুর কেমন যেন হতে লাগলো। প্রচন্ড কৌতুহল বশতঃ অনু কল কানেক্ট করে দিয়ে বের না হয়ে কথোপকথন শুনতে লাগলো। কিন্তু কথোপকথন শুনে অনু এতোটাই স্তম্ভিত হয়ে যায় যে, মিস্ পুনম কখন যে ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ও বুঝতেই পারেনি। ” ধন্যবাদ স্যার, আমি চলে এসেছি। ”
—— ও, আপনি চলে এসেছেন! ঠিক আছে আপনি বসুন, আমি আসি।
এই কথা বলে অনু এক্সচেঞ্জ রুম থেকে বের হয়ে আসে। এক্সচেঞ্জ রুমের পাশে ফ্রন্ট অফিস স্টাফদের বসার জায়গা আছে। ওখানে গিয়ে বসে। একজন নারী কি ভাবে তার কষ্ট আর অপমানের জীবনের উপরে মেকআপের প্রলেপ দিয়ে এক ভিন্ন চরিত্রের মানুষ হয়ে বেঁচে আছে তা সারাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। যে নারী দিনের বেলায় সম্মানজনক পেশায়, সে নারী রাতের অন্ধকারে এক পঙ্কিলময় রাস্তার ফেরিওয়ালা। স্বামী নামের নরপিশাচের নোংরা জীবনের বলি সারা। স্বামী নাসের ছিল একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একজন চৌকস কর্মকর্তা। মেধাবী ছিল কিন্তু একই সাথে ছিল লোভী। কাজের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি করার জন্য নিজের স্ত্রী কে পর্যন্ত বাজারে নামাতে দ্বিধা করেনি। আর এদিকে সারার স্বামীর কথা শোনা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। বাবা নেই। মা আর ছোট বোন। বাবার বাড়ীর অনেক খরচ স্বামী নাসের বহন করতো। প্রথম যেদিন নাসের সারাকে ওর বসের সাথে বেড়াতে যেতে বলে সেদিন সারা প্রতিবাদ করেছিল। ফলাফল নাসের সারার ছোট বোন জারার সাথে তোলা কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি সারাকে দেখায় আর বলে, তুমি না গেলে জারা তো অবশ্যই যাবে। এই কথা শুনে সারা সঙ্গে সঙ্গে বলে আমি যাবো তবে তুমি জারার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এরপর সারা ওর মা কে বলে, ” তুমি একমাসের মধ্যে জারার বিয়ে দিবে, আর আমার সাথে তোমরা কোন যোগাযোগ রাখবে না। তোমাদের মাসিক খরচ আমি সময়মতো পাঠিয়ে দিবো।” এরপর সারা ধীরে ধীরে এই জগতের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে নাসেরর অতিলোভের কারনে ওর চাকরী চলে যায়। পরে আর অন্য কোথাও তেমন সুবিধা করতে পারে না। ঋণের বোঝা টাও অনেক বড় হয়ে যায় নাসেরর আর তা পরিশোধ করতে হয় সারাকে। নাসের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, সারার আজকের পারিশ্রমিক টা নেওয়ার জন্য। সারা আর নাসেরের কথোপকথন শুনে অনু হতভম্ব হয়ে যায়। ও ভাবে, রাতুল স্যার একটা কথা বলেন নি আর সেটা হলো, “যা দেখবে তা বিশ্বাস করবে না, আর যা শুনবে তা মিলাতে চাইবে না।”

অনু প্রচন্ড মনখারাপ নিয়ে রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আছে। লিফ্ট টা উপর থেকে নিচে নেমে এলো। মিস সারা লিফ্ট থেকে বের হবার আগে ভিতরে গ্লাসে চেহারাটা একবার দেখে নিলেন। তারপর ধীর পায়ে হোটেল থেকে বের হয়ে গেলেন।

লেখকঃ শোয়াইব আহমদ, কবি,বাচিক শিল্পী ও সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন