Ads

ছাওয়াল পাওয়াল

#ছাওয়ালপাওয়াল (ছোট গল্প)

সকালে হাঁটতে যাওয়া অহনার খুব প্রিয় কাজগুলোর মাঝে একটা। সকালটা তার একদম নিজের। এখানে কারো অনুপ্রবেশ নেই যদি সে না চায়! এই এক ঘন্টা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে চায় না। বাসা থেকে বের হয়ে প্রথম স্টেপ থেকে শুরু লাস্ট পর্যন্ত তার শুধুই নিজের।

রাস্তাটা খুব সুন্দর । চারপাশে বড় বড় গাছ । রাস্তার পাশের জমিতে নানারকম সবজি ক্ষেত।যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।সকালের মিষ্টি পরিবেশ। ঘুঘুর ডাক মাটির কেমন জানি নেশা লাগানো গন্ধ! রাস্তার পাশের কোন মাটিতে আবার কেঁচোর কারুকার্য করা বাসা! কোন কোন অলস বিড়ালের বালির স্তুপে ঘুম ঘুম ভংগী করে শুয়ে থাকা…যেনো মনে হয় একটু আদর করে দিই। নাম না জানা বনফুলের সুবাস চার পাশ টাকে এতো মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। অহনাকে খুব টানে.. কঠিন ভাবে টানে। মনে পড়ে এসব ফুল দিয়েই ছেলেবেলা কতো রান্না রান্না খেলা খেলেছে।

অনেক দিন পর আজ হাঁটতে বেরিয়েছ অহনা। খুব দ্রুত হাঁটছে ঘাম ঝরাতে হবে অনেক। সাথে মনের সাথে ও গল্পটা চালিয়ে নিতে হবে। নিজের মতো করে আর কেউ নিজেকে বোঝাতে পারে না৷ এটা সারাদিনের জন্য তার রিচার্জ করা। কতো গল্প চলে নিজের সাথে।কখন ও নিজে নিজে হাসে কোন মজার কথা মনে পড়ে গেলে বা বিশেষ কারো কথা মনে করে তার সাথেও কিছুটা গল্প চালিয়ে নেয় নিজের মতো করে। প্রতিদিনের হিসাব নিকাশ চলে সারাদিন কি করবে তার একটা প্রস্তুতি চলে আর কতো কিছুই বলে যায় নিজে নিজেই। অহনা জানে আগে নিজেকে ভালবাসতে হবে নতুবা কাওকে ভালবাসা যায় না। আর ভালো থাকতে হলে কম্প্রোমাইজের বিকল্প কিছু নেই। একটা স্বপ্ন হারিয়ে গেলে নিজের মতো করে আর একটা স্বপ্ন বানিয়ে নিতে হবে৷ জীবনটা খুব ছোট তাই কোন কিছুই হেলায় শেষ করা যাবে না। কষ্টের পাশাপাশি একটা সুখের ঘর ও থাকতে হবে মনের গহীনে।সুখের ঘর ছোট হলে ও সমস্যা নাই। ছোট্ট একটা সুখ হাজারটা কষ্টকে তুড়ি মেরে উড়ে দিতে পারে চোখের পলকেই।।

আর একটু হাঁটতে মন চাইছিলো অহনার। কিন্তু ঘড়ি বলছে ফিরতে হবে বাসায়। বাচ্চাদের ঘুম ভাংগাতে হবে নিজে ফ্রেশ হতে হবে.. টিফিন তৈরী করা নিজে রেডী হওয়া বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া এসবই করতে হবে আধা ঘন্টার মধ্যে।

কেনো জানি মনে হচ্ছে কেউ একজন তালে তাল মিলিয়ে হাঁটছে! অহনা যখন জোরে হাঁটছে আগন্তুক ও তাই করছে আবার সে যখন ধীর লয়ে হাঁটছে লোকটা তাই করছে! রাত হলে হয়তোবা ভয়ে অহনা মরেই যেতো।কিন্তু দিনের আলোতে সব কিছু নিজের মতো করে নিতে জানে অহনা। মনে মনে ভাবলো বেশ তো আমার সাথে কেউ তাল মিলিয়ে চলছে! স্কুল কলেজে যেমন কেউ পিছু নিলে খুব ভয় লাগে আবার কোথা থেকে ভালো লাগাও কাজ করে! এমনি ধরে নিয়ে তাকানোর প্রয়োজন ই মনে করলো না সে৷ তাকালেই তো স্বপ্ন ভংগ!

ম্যাইয়া ছাওয়ালপাওয়ালের সাথে হাঁটতে পারিস না! তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে স্বপ্ন ভংগ! পেছনে তাকিয়ে দেখে খোঁচাখোচা কাঁচা পাকা দাড়িওয়ালা এক লোক। তার সংগী দুজনকে বলছে কথাগুলো। মোরের মাথায় যুক্ত হয়েছে আর দুজন! দেখ দেখ!! দেখে শিখ কিভাবে হাঁটতে হয়! স্প্রিরিট বাড়া! ম্যাইয়া ছাওয়ালপাওয়ালের কাছ থেকে শিখে নে! সেই তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠ!!
ছাওয়ালপাওয়াল কতো আদরের ডাক। গ্রামে গেলে খুব শুনতো। খুব আদর করে বলতো ছাওয়াল তো অনেক বড় হয়ে গেছে। কখন ওশুনতে হতো এতো শুকায়ে গেছে কেনো ছাওয়াল! শহরে থাকে ভালো মন্দ কি খায়? বাজারের কেনা জিনিস কি আর ভালো হয়! ইত্যাদি ইত্যাদি হাজার ভালোবাস ভরা কথা জড়িয়ে আছে ঐ ছাওয়ালপাওয়াল শব্দের মাঝে।আর তার এই বাজে প্রকাশ! মনে মনে ঠিক করে নিলো শিক্ষা একটা দিতেই হবে নিজের মতো করে। ভালবাসার শব্দকে তাচ্ছিল্য করা! তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো আর মনে মনে ভাবলো আর আধা ঘন্টা না? তার হাতে আর দশ মিনিট সময় আছে যেভাবে হোক পৌছাতে হবেই বাড়িতে। বাচ্চাদের স্কুল লেট করা যাবে না। অহনা তার সুপার স্পিরিট দিলো হাঁটাতে। অহনা ঠিক বুঝতে পারছে লোকগুলো তাল হারিয়ে ফেলছে!

একজন মেয়েকে হারানো খুব কঠিন। আর যদি মেয়েটি হয় একজন মা একজন হাউজ ওয়াইফ তাহলে আরো বেশী কঠিন হয়ে যায়। একজন হাউজ ওয়াইফ ২৪ ঘন্টা সার্ভিস দেয় তার নিজের পরিবারে। কোন রকম প্রমোশন ‘ বেতন বোনাস কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে ভালবেসে যায় পরিবারের সবাইকে। সবার অভাব অভিযোগ হাসি মুুখে মিটিয়ে যায়। নিজে ভালো থাকে সবাইকে ভালো রাখে। বাহিরের জগৎ হয়তোবা অতোটা বোঝে না কিন্তু ঠিক বোঝে বর্ষার দিনে ভুনা খিচুড়ি আর কষা মাংশটা ঠিকঠাক হতে হবে। সাথে পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ দিতে ভুলে গেলে চলবে না । রুই মাছের মুড়িঘণ্টটা ঠিকঠাক নামাতে হবে চুলা থেকে যেনো বেশী সিদ্ধ না হয়ে যায়। হাতে হয়তো মসলার গন্ধে ভরা থাকবে তবুও সে হাত অনেক বেশী দামী পরিবারের কাছে।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে অহনা বাসার কাছে এসে পৌছে গিয়েছে খেয়াল ও করেনি। কেয়ারটেকারের সালামের উত্তর দিয়ে মুচকি হেসে ভেতরে চলে যায়।

অকারনেই একটা সময় সে ভেবেছিলো সবাই কিছু একটা করছে সে কেনো বসে সময় নষ্ট করছে? কি হলো এতো পড়াশুনা করে ? যদি নিজের একটা পরিচয় না থাকলো? আজ তার স্বপ্নের পরিবর্তন এসেছে ।ভালো থাকতে নিজের একটা পরিচয় দরকার। সেটা হাউজওয়াইফ হয়ে ও পাওয়া যায়। আবার চাকুরীজীবি মা হয়েও পাওয়া যায়। হাউজ ওয়াইফদের একটা বাড়তি পাওনা তারা সন্তানদের মধ্যে নিজের শৈশবকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে পারে। একটু সময়ও কেউ নিতে পারে না।অহনা নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে সে তার শৈশবের সবটুকু আবার ফিরে পায় শুধু হাউজওয়াইফ হওয়ার জন্য শুধু একজন ম্যাইয়া ছাওয়ালপাওয়াল হওয়ার জন্য।

লেখক-সোহানা চৌধুরী, কবি ও সাহিত্যিক।

 

আরও পড়ুন