Ads

রোজা

 

দবির মোল্লা গ্রামের বাজারে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ছোট একটি টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে বিকেলে বসে। সন্ধ্যে হলে হারিকেন জ্বালিয়ে ভাঙা টেবিলটাতে রাখে। পাশের দোকান থেকে মাসিক দুইশ’ টাকায় বিদ্যুতের লাইন নিয়ে একটি বাল্ব জ্বালানো যায়। কিন্তু দবির মোল্লা তা করে না। হারিকেন জ্বালালে মাত্র বিশ টাকাতেই মাস চলে যায়। তা ছাড়া রাতে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় হারিকেনের আলোতে বাড়ি ফেরাও নিরাপদ।

দবির মোল্লার ডাক্তারিতে কোন ডিগ্রী নেই। অনেক আগে থানা শহরের এক ডিগ্রীধারী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের কম্পাউন্ডারের কাজ করেছিল। সেখান থেকেই চিকিৎসা বিদ্যার কিছু আন্দাজ অনুমান শিখেছিলো। ছোট বেলায় মক্তবে আরবি, উর্দু ও সামান্য বাংলা শেখা, তারপর আর লেখাপড়া এগোয় নি। মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়িয়ে দবির মোল্লার বেশ ভালই চলছিলো। মাঝে মাঝে দু’চারটি মিলাদ মাহফিল ও বিয়েশাদী পড়ানো মিলতো। কোত্থেকে এক ফাজিল পাশ মাওলানা এসে দবির মোল্লার মসজিদের চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছে। আর বিয়ে পড়ানোর জন্য সরকার প্রত্যেক ইউনিয়নে নিয়োগ দিয়েছে শিক্ষিত কাজী। দবির মোল্লার আয় রোজগার বলতে এখন শুধু এই ডাক্তারখানা।

রোগী দু’চার জন হয় বৈকি। কিন্তু তা দিয়ে দবির মোল্লার স্বামী-স্ত্রীর সংসার চলে বড় টেনেটুনে। পূর্ণ বয়সে ছেলেপুলে হলো না, এখন আর সে বয়স নেই। দবির মোল্লার তাল-বে-এলেম কফিল, সেও বেকার। প্রতিদিন বিকেলে ডাক্তারখানা খুললে কফিলও চলে আসে বাজারে। দু’জনা রাত অবধি কুটকুট করে গল্প করে। আগে যখন দবির মোল্লা নিয়মিত বিয়ে পড়ানো ও মিলাদ মাহফিলের দাওয়াত পেতো, তখন তাল-বে-এলেম হিসেবে কফিলকে সাথে নিয়ে যেতো। পেটপুরে খানা খেয়ে যে পঞ্চাশ একশ’ টাকা পেতো, সেখান থেকে কফিলকে বিশ ত্রিশ টাকা দিলে ও খুব খুশি হতো। পুরনো মুরিদদের মধ্যে এখনও কেউ কেউ নতুন হুজুরকে বাদ দিয়ে দবির মোল্লকেই দাওয়াত করে। তখন দুজন এক সাথে দাওয়াত খেতে যায়।

আজ দবির মোল্লার বাড়িতে কোন রান্না হয় নি। কোন পান্তা ভাত বা ছাতু, মুড়িও ছিলো না। এমনটি প্রায়ই হয়। এতে তেমন কোন সমস্যা হয় না দবির মোল্লা ও তার স্ত্রীর। শুকনো শরীরে বা চেহারায় তেমন কোন পরিবর্তন আসে না। শুধু বিকেলের দিকে একটু দুর্বল মনে হয়। দোকানের টেবিলে পান বানিয়ে কফিলের সাথে খায় আর কথা কয়। বাজারের পাশেই কলুপাড়া। ওখানে কয়ঘর মুরিদ আছে দবির মোল্লার। সেখান থেকে এক মুরিদ এসেছে দবির মোল্লাকে দাওয়াত করতে। গদাই কলুর মা গত বছর এই দিন মারা গেছিলো। মারা যাওয়ার পাঁচ দিন পর খয়রাত এবং চল্লিশ দিন পরে চল্লিশা অনুষ্ঠানের দাওয়াতে দবির মোল্লাই মিলাদ পড়িয়েছিলো। গদাই কলু আজ হন্তদন্ত হয়ে এসে বলছে, আজ যে তার মায়ের মৃত্যুর এক বছর এ কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। এখনই যেতে হবে মিলাদ পড়াতে। দবির মোল্লা ও কফিল যারপর নাই খুব খুশি। দোকানের ঝাঁপ ফেলে গদাই কলুর বাড়িতে গিয়ে হাজির। মাগরিবের নামাজের এখনও পৌনে এক ঘন্টা বাঁকি। কয়েকজন মুসল্লী বসে দোয়া দরূদ পড়ছে। দবির মোল্লা ময়লা জুব্বার পকেট থেকে তছবি বের করে বসলো বিছানায়। সামনে ফুল তোলা বালিশ। ধুপকাঠি ধুঁয়া ছড়াচ্ছে। একপাশে তাল-বে-এলেমটা বসে চোখ বুঁজে ঢুলছে। এমন সময় দবির মোল্লার হাঁক, কই গো মা বোনে রা- আমরা দু’জন নফল রোজা আছি, একটু ইফতারি দিও। কফিল চোখ বড় করে দবির মোল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। দবির মোল্লা কফিলের হাতে চাপ দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।

দবির মোল্লা সারাদিনে কয়েকটি পান আর কয়েক গ্লাস পানি খেয়েছে। গত রাতে শোয়ার আগে কচুশাক দিয়ে ভাত খেয়েছিলো। গদাই কলুর বাড়ির মহিলারা হুজুরের ইফতারি তৈয়ার করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। রোজাদারকে ইফতারি করালে রোজা রাখার ছোয়াব পাওয়া যায়, তা তো এই দবির মোল্লার নিকট থেকেই গদাই কলুর পরিবারের লোকজন শিখেছে। তাই আজ খুশির সাথেই হুজুরকে তারা ইফতারি করাবে। তছবিহ্ তাহলিল পড়তে পড়তে ইফতারির সময় হলো। ইফতারিতে দুধ, কলা, চিড়া, মুড়ি, পিয়ারা, ডিমসিদ্ধ ও শরবত খেয়ে দবির মোল্লা এবং তার সাগরেদ খুব খুশি। মাগরিবের পর মিলাদ মাহফিল। তারপর মাছ-গোশত দিয়ে ভরপুর খাবার। অনেক দিন পর পেট ভরে খেয়েছে দবির মোল্লা ও কফিল। চলে যাওয়ার সময় গদাই কলু দবির মোল্লার হাতের মধ্যে একশ’ টাকার একটি নোট দেয়। দবির মোল্লার দক্ষ হাত বুঝে যায় এটা একশ’ টাকার নোটই হবে। না দেখেই পকেটে রেখে দেয়।

চলে যাওয়ার পথে পকেট থেকে টাকা বের করে কফিলকে বলে, একশ’ টাকার নোট দিয়েছে রে। চল্ দোকান থেকে ভাঙতি করে তোকে ত্রিশ টাকা দেই। কফিল খুব খুশি। একটু কাছে গিয়ে কফিল নীচু স্বরে বলে, হুজুর আপনি কি সত্যি রোজা ছিলেন? দবির মোল্লা দৃঢ় কণ্ঠ বলে, হ রোজা ছিলাম। সেহরীর সময়ও কিছু খাই নাই, সারাদিন খালি পানি আর পান খাইছি। গদাই কলুর বউ আর মেয়েগুলোর রান্না করা দেখে সহ্য করতে পারি নাই। ভাবলাম মিলাদের শেষে অনেক রাতে খাবার দিবে। তাই সাথে সাথে ইফতারি করার বুদ্ধি আঁটলাম।

লেখক–রফিকুল্লাহ্-কালবী, কবি ও সাহিত্যিক।

কফিল বলে, ঠিকই বলিছেন হুজুর। আপনার মতন আমিও রোজাই ছিলাম।

আরও পড়ুন