Ads

‘ভালোর ভয়’ ও আগামী দিনের বাংলাদেশ

আবু এন এম ওয়াহিদ

আমার আজকের লেখার শিরোনাম দেখে আপনারা যদি চমকে ওঠেন তাহলে আমি একটুও বিস্মিত হব না। এমন শিরোনাম দেখে যে কেউ অবাক হতেই পারেন! অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘ভালোর ভয়’, এ আবার কেমন কথা? ভালো তো ভালোই। যা কিছু ভালো, তার সবইতো সুন্দর, সবইতো মঙ্গলময়, সবইতো আনন্দময়! আমরা সবাই সব সময় ভালোটাই চাই। আর যা চাই, তা আবার ভয়ের হতে যাবে কেন? উত্তরে আমি বলব, হতে পারে বৈকি! নিয়মকানুন, ন্যায়বিচার, শান্তি শৃঙ্খলা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, ইত্যাদিও যে মানুষের মনে ব্যথা-বেদনা এবং হতাশার জন্ম দিতে পারে, একটি উদাহরণ দিয়ে সে-কথাটাই এখানে বোঝাবার চেষ্টা করব।

উনিশ শ’ চুরানব্বই সালে হলিউড থেকে একটি পূর্ণদৈর্ঘ সিনেমা আলো ঝলমল রূপালী পর্দায় ফুটে ওঠে। পরে সেটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। সিনেমাটির নাম, ‘দ্যা শোশাঙ্ক রিডেম্শন’। যাঁরা ছবিটি দেখেননি, তাঁদের বোঝার সুবিধার জন্যে এর একটি সারাংশ সংক্ষেপে বয়ান করছি। আমেরিকার একেবারে উত্তরপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত, ‘মেইন’ অঙ্গরাজ্যের একটি কারাগারের নাম ‘শোশাঙ্ক স্টেট প্রিজন’। উনিশ শ’ চল্লিশ দশকের শেষের দিক থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়টায় ওই কারাগারে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাবলী এই সিনেমার বিষয়বস্তু। কারাগারের নিরাপত্তাকর্মচারি, প্রধান কারাকর্মকর্তা, তাঁদের নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতি এবং কারাগারের অসংখ্য কয়েদিদের সুখ-দুঃখের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ে এই ছবির গল্প এগোতে থাকে।

কাহিনীটি লিখেছেন স্টিভেন কিং এবং এর পরিচালক – ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট। এঁরা দু’জনই নিজ নিজ জগতে অতি সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত নাম।

সিনেমার যে চরিত্রটি আমার এই আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক, তাঁর নাম ব্রুক্স হ্যাটেলন। ছবির গল্প অনুযায়ী দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কারাভোগ করার পর উনিশ শ’ ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে হ্যাটেলন জেল থেকে ছাড়া পান। অর্থাৎ তিনি ১৯১৫-১৬ সালের দিকে ‘শোশাঙ্ক স্টেট প্রিজনে’ কারাজীবন শুরু করেন। জেলখানায় কয়েদিদের জন্য ছিল একটি ছোট্ট লাইব্রেরি। হ্যাটেলন ছিলেন তার লাইব্রেরিয়ান। কারামুক্তির পর হ্যাটেলন বেঁচেছিলেন মাত্র অল্প কিছু দিন। ওই সময়ে তাঁর আত্মীয় স্বজন এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউ অবশিষ্ট ছিলেন কিনা তা সিনেমার কাহিনী থেকে বোঝা যায় না। তবে যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন, একেবারে একাই ছিলেন। মুক্ত হওয়ার পর তিনি যেদিকে যেতেন, শুধু অবাক হয়ে দেখতেন, পঞ্চাশ বছরে সবকিছু কীভাবে বদলে গেছে! সমাজ, দেশ, দেশের মানুষ, মানুষের চিন্তাভাবনা, জীবন-জীবিকা, এমন কি রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সবকিছুতেই তিনি আমূল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি যেন তাঁর আশপাশের কোনো কিছুই আর চিনতে পারছিলেন না, কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।

জেলজীবনের সঙ্গে তুলনা করে, মুক্তজীবনে তাঁর কাছে কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। কারাগারে যাওয়ার আগের কথা বলতে গিয়ে তিনি এক সময় বলছেন, ‘ছোটবেলা আমি একটি গাড়ি দেখেছিলাম। আর এখন সব জায়গায় খালি গাড়ি আর গাড়ি! যেখানে যাই সেখানেই গাড়ি। গাড়ির জন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে সাহস পাই না’। ‘ছোটবেলা আমি একটি গাড়ি দেখেছিলাম’ তার মানে, তখন মাত্র গাড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে। গাড়ির দাম ছিল বেশি। মানুষের আয় ছিল কম, আর তাই গাড়ি ছিল নিতান্তই একটি দুর্লভ বস্তু। সে যা হোক, মুক্তজীবনে হ্যাটলেন একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। কী ঘরে, কী বাইরে, সবসময় তিনি ভয় ও আতঙ্কের মধ্যেই থাকতেন!

এ-রকম এক মানসিক অবস্থায় হ্যাটলেন নিজেকে নিজে বলছেন, ‘আই ওয়ান্ট টু কমিট এনাদার ক্রাইম, সো দ্যাট দে উইল সেন্ড মি হোম’। অর্থাৎ তিনি আরেকটা অপরাধ করতে চান, তাহলে আইন-আদালত তাঁকে ‘বাড়ি’ পাঠিয়ে দিবে। মজার ব্যাপার, এখানে হ্যাটলেনের মনস্তত্ব লক্ষ্য করার মতন! পঞ্চাশ বছর কারাগারে থাকতে থাকতে, হ্যাটলেন কারাগারকেই মনে করছেন তাঁর আপন ‘বাড়ি’ আর মুক্ত জীবনের বাসগৃহকে মনে করছেন যন্ত্রণাদায়ক ‘কারাগার’। এটা যে হ্যাটলেন মুক্তজীবনে এসে প্রথম অনুভব করেছিলেন তাও নয়। জেলজীবনের শেষদিকে তিনি বিষয়টি আগাম বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয়। আর তাই কারাজীবনের মেয়াদ শেষে, ছাড়া পাওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি এক কয়েদির গলায় ছুরি ঢুকিয়ে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যাতে কারাকর্তৃপক্ষ তাঁর মুক্তির আদেশ বাতিল করে আবারো যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়ে দেয়। সহকয়েদিদের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের কারণে হ্যাটলেনের সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। তিনি সময়মত মুক্তি পেয়ে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ মুক্তজীবনে ফিরে আসেন।

কিন্তু দিনে দিনে এ-জীবন হ্যাটলেনের কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। জেলে (তাঁর ভাষায় নিরাপদ ও শান্তিময় আপন ঘর) ফিরে যাওয়ার মতো কোনো অপরাধ করতে না পেরে অবশেষে হ্যাটলেন আত্মহত্যা করেন। হ্যাটলেন সিনেমার মূল চরিত্র ছিলেন না। ফলে তাঁর মৃত্যুতে ছবির গল্পটি শেষ হয়ে যায়নি। মূল চরিত্রের ঘটনাবলি নিয়ে তাঁরপরও কাহিনী আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ‘দ্যা শোশাঙ্ক রিডেম্শন’ নায়িকাবিহীন পরিচ্ছন্ন এক বিরল ছায়াছবি। ইচ্ছে থাকলে আপনারা দেখতে পারেন।

এবার আসি আসল কথায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। চড়াই উতরাই পার হয়ে দেশ অনেক দূর এগিয়েও এসেছে। স্বাধীনতার বছর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সরকার বাজেট দিয়েছিলেন মাত্র সাত শ’ পঁচাশি কোটি টাকার। এখন সেই বাজেট হয় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার ওপরে। আগে বাংলাদেশিদের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের নিচে আর এখন সেটা কোথায় ওঠে এসেছে তা কারো অজানা নয়। সাক্ষরতা, শিশুমৃত্যু, নারীর কর্মতৎপরতা, জীবনপ্রত্যাশা, এমডিজি, ইত্যাদি অনেক আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ, ভারত পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে।

তারপরও সোনার দেশের রয়ে গেছে অনেক ব্যর্থতা, অনেক হতাশা ও অনেক বঞ্চনা। কী সেই ব্যর্থতা, কী সেই অপ্রাপ্তি, তা আপনারা আমার চেয়ে অনেক ভালো জানেন। এ-সব সাত কাহন গেয়ে আমি আরো তিন-চার পৃষ্ঠা সাদা কাগজ আমার আঁকিবুঁকি দিয়ে ভরাতে চাই না। এমতাবস্থায় আগামীতে – অর্থাৎ আরো বিশ-ত্রিশ বছর পর কোনো লৌকিক কিংবা অলৌকিক কারণে দেশের জনগণ যদি সুখের মুখ দেখে – অর্থাৎ যদি সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। দুর্নীতির পরিবর্তে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যি সত্যি সবক্ষেত্রে আইনের শাসন কায়েম হয়ে যায়। মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা ফিরে আসে। রাজনীতিতে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে যদি শান্তি-শৃঙ্খলার সুবাতাস বইতে থাকে। তা হলে কী হবে?

সেই অবস্থা আমরা জীবনে দেখে যেতে পারব কিনা জানি না, তবে এমন দিনে আমার ভয় হয়, বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ব ‘দ্যা শোশাঙ্ক রিডেম্শন’এর হ্যাটলেনের মনের মতন হয়ে যায় কিনা! অর্থাৎ দীর্ঘদিন অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর ও খারাপ পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষের কাছে ‘খারাপকে’ ভালো এবং ‘ভালো’কে খারাপ মনে হতে পারে। আমার ভয় মিথ্যা হোক! আমার শঙ্কা অমূলক হোক! জনগণ ‘হ্যাটলেন সিনড্রোম’ থেকে মুক্ত থাকুক, নিরাপদ থাকুক, এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেই আজকের নিবন্ধের ইতি টানছি। আমার প্রচেষ্টায় সফল হলাম কিনা সে বিচারের ভার আপনাদের ওপরই রইল ।

লেখকঃ

লেখকঃ আবু এন. এম. ওয়াহিদ;

অধ্যাপক -টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; ইউএসএ

এডিটর -জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ;

আরও পড়ুন