Ads

বাংসামোরো-মিন্দানাওঃ ফিলিপাইনের মুসলিম জনপদ

।। আসাদ পারভেজ ।।

ফিলিপাইনের ইতিহাসঃ ফিলিপাইনের আদি অধিবাসী নেগ্রিতো জাতির মানুষজন প্রায় ৩০ হাজার বছর আগে বোর্নিও এবং সুমাত্রা দ্বীপ থেকে এখানে আসে। একটা সময় দক্ষিণের মালয় জাতির লোকেরা আসে যারা বারাংগে নামে সুপরিচিত। ৯ম শতকে চীনা অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এসে বসতি স্থাপন করে। তারও বহু আগে আরব বণিকদের জাহাজ এখানে আসত তাদেরই একটা অংশ ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চল মিন্দানাওতে ইসলামের প্রচলন শরু করেন। পৃথিবীতে যতগুলো স্বায়ত্তশাসিত উপদ্বীপ রয়েছে, তার মধ্যে মিন্দানাও অন্যতম। এর ২ কোটি জনসংখ্যার ৯৮ ভাগ মুসলমান।

ফিলিপাইন দীর্ঘ সময় মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। ‘মিরীকাই’, ‘সুলু’, ‘মাগিনদানিউ’ নামক তিনটি মুসলিম সালতানাতে স্বাধীন ছিল বর্তমানের ফিলিপাইন দেশটি। স্বাধীন মিরীকাই সালতানাতের সর্বশেষ মুসলিম শাসক ছিলেন; ধার্মিক গোলায়মান। ১৫২১ সালে স্পেনীয় নাবিক ম্যাগিলান ভারত মহাসাগর হয়ে মিরীকাই পাড়ি জমান। তাকে অনুসরণ করে বহু ইউরোপীয়রা সুখী ও সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে আসতে থাকে। বছরের শেষদিকে পর্তুগিজ অভিযাত্রী ফের্দিনান্দ ম্যাগিলান স্পেনের পক্ষে মিরীকাই নামক দ্বীপের সালতানাত দাবী করে। অবৈধ এই দাবির অযুহাতে ১৫৬৫ সালে স্পেনীয়দের সঙ্গে লিপ্তযুদ্ধে সুলতান গোলায়মান পরাজিত হন। তৎকালীণ সাম্রাজ্যবাদী স্পেনের রাজা ফিলিপ‘মিরীকাই’ দখল করে নেয়। দ্রুত সময়ে স্পেন পাশ্ববর্তী স্বাধীন সালতানাত সুলু এবং মাগিনদানিউ কুক্ষীগত করে। স্পেনীয় বণিকরা মিরীকাইকে কেন্দ্র ধরে তিনিটি সালতানাতকে একত্রিত করে। স্পেনীয় বণিকরা রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের নামে দেশটির নামকরণ করে ফিলিপাইন এবং মিরীকাই’য়ের নাম পরির্বতন করে ম্যানিলা রাখে যা বর্তমানে ফিলিপাইনের রাজধানী।

১৮৯৮ সালে স্পেন-মার্কিন যুদ্ধে মার্কিনীরা ম্যানিলা উপসাগরে স্পেনীয় নৌবহরকে পরাজিত করে। এমন সময়ে চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো নেতা এমিলিও আগিনালদো ১৮৯৮ সালের ১২ জুন ফিলিপাইনকে স্পেন থেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। সাত হাজার একশত দ্বীপের সমন্বিত দ্বীপদেশ ফিলিপাইন ১৮৯৯ সালে স্পেনের অধিকার থেকে কথিত প্যারিস শান্তি চুক্তির ক্ষমতা বলে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে চলে যায়। ঐ বছরেই মার্কিন শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিপিনোরা বিদ্রোহ শুরু করে। ১৮৯৯-১৯০২ পর্যন্ত তিন বছরে মার্কিন-ফিলিপিনো যুদ্ধে হাজার হাজার ফিলিপিনো ও অসংখ্য মার্কিন সৈন্য নিহত হয়। ১৯০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ফিলিপাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত দেশটি আমেরিকার অধীনেই ছিল।

স্পেনীয়-আমেরিকা ও ফিলিপিনোদের গত কয়েকশ বছরের শাসনামলে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে মুসলিম আদিবাসীদের (Indigenous People of Muslim) সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত করা হয়েছে। যে মুসলিম জাতি কয়েকশ বছর আগেও শাসক ছিল, সাম্রাজ্যবাদী ইহুদি-খ্রিস্টানদের চক্রান্তে তারা হয়ে যায় সংখ্যালঘু।

ইউরোপে মুসলমানদের ব্যঙ্গ করে ‘মুর’বলা হতো। সেই ইউরোপীয়রা ফিলিপাইনে এসে একইভাবে মুসলমানদের মুর বলা শুরু করে। সেই মুর থেকে মোরো নামের উৎপত্তি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপি ফিলিপাইনের মুসলমানরা ‘মোরো’ নামে সুপরিচিত। মোরো জাতির বসবাসের জায়গাটির নাম বাংসামোরো। দক্ষিণ ফিলিপাইনের মুসলিম মিন্দানাওকে নিয়ে বাংসামোরো একটি স্বশাসিত অঞ্চল।
বর্তমানে ফিলিপাইন ক্যাথলিক খ্রিস্টান অধ্যুষিত স্বাধীন দেশ। দেশটির আদিবাসী মোরো মুসলিমরা ১৯৭০-এর দশকে মুক্তির সংগ্রাম শুরু করে। সরকার ক্ষমতা জিইয়ে রাখতে মুসলিম প্রধান মিন্দানাও, জুলু ও পাহলোয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১৪টি প্রদেশে ইহুদি-ইজরাইলের মতো খ্রিস্টান বসতি গড়ে তোলে। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কিছু স্বাধীনতাকামী মুসলিম আদিবাসী গোষ্ঠী গত কয়েক দশক ধরে স্বাধীনতার প্রশ্নে লড়াই চালিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (MILF) ও মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (MILF) এবং আবু সায়াফ অন্যতম।

জেবিদাহ গণহত্যাঃ  জেবিদাহগণহত্যার পর ১৯৬০’র দশকে মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের জন্ম হয়। কিন্তু নীতির প্রশ্নে দ্বন্দ্বে গিয়ে ১৯৭৭ সালে মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। এতে করে নুর মিসউরির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট। এটিপ্রতিষ্ঠার পর ফিলিপাইন সরকারের কাছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিদ্রোহি এই সংগঠন সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণহয়ে উঠে। ম্যানিলা সরকার বিদ্রোহ দমনে বেশ কয়েকবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সেনাবাহিনী পাঠিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। মিন্দানাওয়েতারা প্রত্যেকবার এমআইএলএফ যোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। গওখঋ-এর মতে, ম্যানিলা সরকার দেশের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে।

১৯৭৬ সালে লিবিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কর্ণেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির মধ্যস্থতায় ফিলিপাইনের সরকার ও গঘখঋ-এর মধ্যে প্রস্তাবিত আধাস্বায়ত্ত শাসনের প্রস্তাবÑ যাকে ভিত্তি করে ত্রিপোলিতে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অবশ্য উভয় দল শর্ত ভঙ্গ করায় চুক্তিটি বেশি দিন টিকেনি।

সাম্প্রতিক সময়ে এমআইএলএফ গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে আসছে ফিলিপাইনের সরকার। এই স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী দলটির সঙ্গে বেশ কিছু ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের বেঁধে দেয়া বিভিন্ন শর্ত সরকার পক্ষ পালনে ব্যর্থ হবার কারণে সমঝোতা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাছাড়া বেশ কিছু গোষ্ঠী আত্মসমর্পণ না করে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
এই বিদ্রোহে ২০১৬ সাল নাগাদ প্রায় ২ লক্ষ নিরীহ ফিলিপাইনবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ঘর ছাড়া হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ নিরীহ মানুষ এবং চরম দারিদ্রের কবলে পড়ে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল। ১৯৯৭ সালে ম্যানিলা সরকার ও এমআইএলএফের মধ্যে সর্বপ্রথম স্বাক্ষরিত হয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি। কিন্তু ২০০০ সালে ম্যানিলার প্রেসিডেন্ট জোসেফ এসত্রাদা চুক্তি বাতিল করে সেনাবাহিনীকে দমনপীড়ন চালানোর নির্দেশ দেন। ফলে, মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধ ঘোষণা করে।

মিন্দানাওয়ের মুসলমানদের ব্যাপারে মালয়েশিয়া সবচাইতে বেশি স্বোচ্চার। সত্তরের দশকে আসিয়ানের সভায় অঞ্চলটির মুসলমানদের অধিকার নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী তুন রাজাক হুসেন। অশান্ত পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে সেই মালয়েশিয়া দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করে। সেই থেকে ম্যানিলার যাবতীয় শান্তি প্রক্রিয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষ মালয়েশিয়াকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে।

২০১২ সালের অক্টোবরে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ফিলিপাইন সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী গওখঋ-এর মধ্যে অকল্পনীয় এক শান্তি প্রক্রিয়ার আলোচনা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি কুয়ালালামপুরে ফিলিপাইন সরকার ও এমআইএলএফের মধ্যে সমঝোতা পত্র সই হয়। এই সমঝোতাপত্র সই ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনোঅ্যাকুইনের বড় অর্জন।

সমঝোতা চুক্তিতে সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের আশ্বাস দেয় যে, সরকার মিন্দানাও’সহ দক্ষিণের বেশ কয়েকটি এলাকায় স্বায়ত্ত শাসন দেবে। বিনিময়ে এমআইএলএফ’র ১১ হাজার যোদ্ধার একটি বড় অংশ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দিবে এবং অন্যরা পর্যায়ক্রমে সরকারের নিকট অস্ত্র সমর্পণ করবে। এই সমপর্ণের কাজ পর্যবেক্ষণ করবে তৃতীয় কোন পক্ষ। তাছাড়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন খনি থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ৭৫ শতাংশ মিন্দানাওতে থাকবে। জীবশ্ম জ্বালানী থেকে পাওয়া করের অর্ধেক সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। স্বায়ত্বশাসিত এলাকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব গওখঋএর হাতে থাকবে। তাই অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করার কি পরিমাণ ক্ষমতা তাদের আছে, তার ওপর শান্তি চুক্তির সাফল্য নির্ভর করবে।

১৯৯৬ সালে আরেকটি বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠী মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে ফিলিপাইন সরকারের শান্তি চুক্তি হয়। কিন্তু ঐ চুক্তিতে বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বলে শেষ পর্যন্ত শান্তি আসেনি। মুখ দেখাদেখি বন্ধ না করে আন্তরিকতা নিয়ে আলোচনা করলে শান্তির জন্য সমাধানের পথ বের হবেই। তার প্রমাণ সরকার ও এমআইএলএফ’র মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সইকৃত চুক্তি। ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গওখঋ-এর সাথে সংঘর্ষে প্রায় দেড় লক্ষের বেশি লোক নিহত হয়েছে।

এসময় সম্পদ ভাগাভাগি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে। শান্তি আলোচনার প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিরিয়াম করোনেল ফেয়ার চুক্তি শেষে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, উভয় পক্ষই শান্তি সমঝোতায় পৌছতে প্রস্তুত। শেষ দুইটি চুক্তির মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, মিন্দানাওয়ের দক্ষিণাঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তেমন কোন বাধাই নেই আর। স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি থেকে সরে এসে দীর্ঘ দিন ধরে এমআইএলএফ স্বায়ত্তশাসনের জন্যেই সংগ্রামে লড়াইরত। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার তাদের সাথে শান্তি প্রক্রিয়ায় আসে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নাম হবে ‘বাংসামোরো ল্যান্ড’ যা সময়ের দাবি মাত্র। বিশ্লেষকদের ধারণা, এতে সবচাইতে মুসলমানদের লাভ হয়েছে বেশি। অবশ্যই এই শান্তি প্রক্রিয়া দু’পক্ষের জন্য লাভজনক।

অবশেষে মালয়েশিয়া সরকারের উদ্যোগের চূড়ান্ত সাফল্যে ১৭ বছর ধরে চলা আলোচনায় ফলাফল আসে। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার সরকারী হাউসে প্রধানমন্ত্রী নাজিক রাজাকের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে শান্তি চুক্তিতে সই করেন প্রেসিডেন্ট বেনিগননা আকুইনো এবং বিদ্রোহীদের পক্ষে এমআইএলএফ- এর চেয়ারম্যান মুরাদ ইব্রাহিম। এই সময় সরকারি উচ্চ পদস্থ জনবলসহ এমআইএলএফ’র পাঁচ শতাধিক সদস্যউপস্থিতি ছিলেন ।

 

চুক্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত বাংসামোরোকে সরকারের পক্ষ থেকে স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বাংসামোরোকে বাজেট ও পুলিশ গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী, এমআইএলএফের ১০-১৫ হাজার সদস্য অস্ত্র সমর্পণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। ২০১৬ সালের স্থানীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাংসামোরোর শাসন ক্ষমতার ভার ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। এই শান্তি চুক্তির সঙ্গে MNLF ও বাংসামোরো ইসলামিক ফ্রিডম ফাইটারস্ যুক্ত হয়নি। চুক্তি সম্পর্কে সইকারীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এমআইএলএফে’র জ্যৈষ্ট সদস্য আবহৌদ সাইদ এম লিঙ্গা বলেন, চুক্তিতে ছোট ছোট কিছু গোষ্ঠী খুশী না হলেও বাংসামোরোর আপামর জনগণ খুশি।

এমআইএলএফে’র সিনিয়র ফিল্ড কমান্ডার ও গোষ্ঠীর মুখপাত্র ভন আল-হক, যিনি ১৯৭২ সাল থেকে সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রশ্নে লড়ছেন। তিনি বিখ্যাত চ্যানেল ‘আল জাজিরা’কে বলেন, যুদ্ধের ময়দানে থাকা তরুণ যোদ্ধারা পুরো জীবনই যুদ্ধ দেখেছেন। তারা এখন নিজ পরিবারের কোলে ফিরে যেতে চান। স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চান। আধুনিক বিশ্বও তাই আশা করে। এসকল প্রত্যাশাকে বাস্তবায়ন করতে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ফিলিপাইন সরকার ও মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট গণভোট আয়োজনের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ফিলিপাইনের কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত। এই চুক্তি ‘বাংসামোরো অরগানিক ল’ নামে পরিচিত। মুসলিম মিন্দানাওয়ের সীমানা বৃদ্ধি এবং স্বায়ত্তশাসনের যাবতীয় বিষয়াধি এই গণভোটের আওতাধীন।

১৯৭০ দশকের দিকে মিন্দানাও অঞ্চলকে একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বানানোর দাবি নিয়ে যে আন্দোলন, তা ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারিরদ্বি-পর্যায়ের নির্বাচনে চূড়ান্ত আলোর মুখ দেখে। অবশ্য তার আগের বছর ফিলিপাইনের কংগ্রেস গণভোটের বিষয়ে অনুমোদন দেয়। প্রথম দফায় ভোটাররা বাংসামোরো অঞ্চল গঠনের পক্ষে রায় দেয়। মূলত এই ভোটের রায়ে মুসলিম বাংসামোরো অঞ্চল আইনি ভিত্তি এবং সাংবিধানিক অধিকার লাভ করে।দ্বিতীয় ধাপের গণভোটে আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের বাংসামোরো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে একিভূত হওয়ার বিষয়টি সুরাহা করা হয়।

এ সময় ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের মিন্দানাও, লানাও দেল সুর, বাসিলান দ্বীপপুঞ্জ, কোটাবাটো ও ইসাবেলার শহর তাওটি-তাওটি এবং সুলুতে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পাঁচটি অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম মিন্দানাও প্রদেশে অবস্থিত। শেষের শহর দু’টি মিন্দানাওয়ের বাইরে অবস্থিত। শেষ গণভোটে ১০ লাখ ৭০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৭ জন অংশ নেয়। ফিলিপাইনের নির্বাচন কমিশন গণভোটের ফলাফল ঘোষণায় বলেন, কোতাবাতোর ৬৩টি গ্রাম ও একটি শহর মুসলিম বাংসামোরোর অংশ হতে যাচ্ছে। কমিশনের ফলাফলকে ফিলিপাইনের সরকার ও জনগণ স্বাগত জানায়। গণভোটের মধ্য দিয়ে ফিলিপাইনের ৫টি প্রদেশ, ৩টি মহানগর, ১১৬টি পৌরসভা ও ২৫৯০টি গ্রাম বাংসামোরোর অংশে পরিণত হয়। আয়তনের আলোকে ফিলিপাইনের কংগ্রেসে ৮জন মুসলিম প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবে।

গণভোটে বাংসামোরো একটি নতুন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এতে এমআইএলএফ এই অঞ্চলের বৈধ রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়।ভোট পরবর্তী ২২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ফিলিপাইনে সদ্য গঠিত বাংসামোরোর মুসলিম নেতা এমআইএলএফ চেয়ারম্যান মুরাদ ইব্রাহিমকে প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। এছাড়াও কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডারসহ বাংসামোরোর ৮০জন প্রশাসককে শপথ পাঠ করানো হয়। প্রধানমন্ত্রী মুরাদের এই অন্তর্বর্তী সরকার একটি মন্ত্রীসভা গঠন করবেÑ যেখানে ৮০জন প্রশাসকের সাথে সরকারের ৪০জন প্রতিনিধি সম্বলিতভাবে কাজ করবে। অন্তর্বর্তী সরকার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করবে। এই সরকার ২০২২ সালের আঞ্চলিক পার্লামেন্টের গৃহীত ভোটের আগ পর্যন্ত যাবতীয় আইন পাশ করবে। তবে স্বায়ত্তশাসন চালুকালীন সময় থেকেই অঞ্চলটির নাম হবে বাংসামোরো। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিলিপাইনের মুসলিম অধ্যুষিত বাংসামোরো অঞ্চলের শাসনভার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতাকামী নেতাদের হাতে তুলে দেয়া হল। চলতি (২০২২) বছরে বাংসামোরো’তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবেÑ যাতে করে ৫০ লাখ মানুষের দেশটি নিজস্ব পার্লামেন্ট ও মুখ্যমন্ত্রী পাবে। নতুন মুসলিম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠনের মধ্য দিয়ে এশিয়ার দীর্ঘতম বিদ্রোহ অবসানে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

আবু সায়াফঃ ফিলিপাইন সরকারের ধারণা, আবু সায়াফ বিদ্রোহী দলটি বেশ ছোট কিন্তু বিপজ্জনক। ১৯৯১ সালে গোড়াপত্তনের পর থেকেই এই সংগঠনটি ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে একটি স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছোট এই দলটি সরকারের উপর আক্রমণ বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল ফিলিপাইনের অস্থিতিশীল দক্ষিণাঞ্চলের সুলু অঙ্গরাজ্যের পাতিকুল শহরের একটি গ্রামে দলের এক কর্মীর বিয়েতে ২৫০-৩০০ জন আবু সায়াফ সদস্য অংশ নেয়। সেসময় সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ও আর্টিলারি নিয়ে অভিযান চালালে সংঘর্ষে ২ সেনা ও ৬ জন আবু সায়াফ সদস্য নিহত হয়। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিদ্রোহী দল আবু সায়াফ ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় দাভাও শহরের বাজারে হামলা করে আবারো সরকারকে তাদের শক্তির বিষয়ে সতর্ক করে। এই হামলায় ১৪ জন নিহত হয়েছে মর্মে দাভাও শহরের মেয়র নিশ্চিত করেন। এএফপির খবরে জানানো হয়, হামলার সময় প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে নিজ শহর দাভাও এলাকায় সফররত ছিলেন। এ শহরে আসলে তিনি বিশেষ করে মার্কো পোলো ঘোটেল এলাকায় বেশি থাকেন।

হোটেলের বাহিরেই বিদ্রোহী গ্রুপ বোমা বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটান। হামলায় ৬৭ জনের মত লোক আহত হয়। তাছাড়া মে মাসে প্রেসিডেন্ট দুতার্তে নির্বাচিত হবার পর বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে ১২ সেনা নিহত হয়। দাভাও ফিলিপাইনের অন্যতম বড় শহর। রাজধানী ম্যানিলা থেকে দাভাওয়ের দুরত্ব ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এই শহরে ২০ লক্ষ মানুষের বসবাস। তাছাড়া ২০১৬ সালে আবু সায়াফ ২ জন কানাডীয় জিম্মির শিরচ্ছেদ করে। অন্যদিকে ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর দাবি তারা ৭০ জন আবু সায়াফ সদস্যকে হত্যা ও ৩২ জনকে বন্দি করেছে। সেনা মুখপাত্র কর্নেল এদগার্দ স্পষ্ট করে বলেন, একই দিনে দক্ষিণাঞ্চলের সুলু এবং বাসিলান প্রদেশে ৩৪ আবু সায়াফ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন যেন আবু সায়াফকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়।

আবু সাফাফ বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি অনেক সময় অর্থের প্রয়োজনে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে মানুষ অপহরণ করে। অবশ্য পরিশেষে মালয়েশিয়া সফরে প্রেসিডেন্ট দুতার্তে আবু সায়াফের সাথে আলোচনা পুনঃরায় শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করেন। বিশ্ববাসীর বিশ্বাস সরকার কর্তৃপক্ষ আবু সায়াফের সাথেও শান্তির বিষয়ে আলোচনায় বসবে এবং ফিলিপাইনে চূড়ান্ত শান্তি ফিরিয়ে আনবে।

লেখকঃ  আসাদ পারভেজ, গবেষক ও কলামিস্ট (রাষ্ট্রচিন্তক)

লেখকের প্রকাশিত লেখা- কলম্বিয়া সরকার ও ফার্ক গেরিলাগোষ্ঠী

আরও পড়ুন – ফিলিপাইনের বাংসামোরো-মিন্দানাও

আরও পড়ুন