Ads

রিমান্ডে বর্বরতা, ইকবাল হোসেনের মৃত্যু এবং সৌভাগ্যবান রোজিনা ইসলাম!

ডা: আলী জাহান

১. ‘কেন তিনি ৩ দিন কারাগারে থাকবেন?’। ২১শে মে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় প্রধান একটি পত্রিকার শিরোনাম। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। লেখার মধ্যে অনেক যুক্তি আছে, আবেগ আছে, সহকর্মী সাংবাদিকের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ আছে।আমি সেই অনুভূতি এবং যুক্তিকে সম্মান করি। কিন্তু উনার সেই লেখা রোজিনা ইসলামের মুক্তি নির্ধারিত তিন দিনের আগে নিশ্চিত করতে পারেনি । ঐতিহাসিক কারাগারের ‘সেই ৩ দিন শেষে’ আজ রোববার ২৩ মে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কীভাবে তিনি মুক্তি পেয়েছেন, কোন যুক্তিতে জামিন পেয়েছেন তা নিশ্চয়ই আইনজীবীরা দেখবেন। আমার প্রশ্ন সেখানে নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে অন্য জায়গায়।

২. আদালতে জামিনের পক্ষে এবং বিপক্ষে যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়েছিল তা দেখে মাননীয় আদালত ঐদিন (২০.০৫.২১) জামিনের রায় না দিয়ে কেন তিনদিন সময় নিলেন সেই প্রশ্ন কি আদালতকে কেউ করতে পেরেছিলেন? রোজিনা ইসলামের জামিনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করা হয়েছিল তা কি কয়েক হাজার পৃষ্ঠার? সেই হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়তে তিনদিন সময় প্রয়োজন ছিল? লেখাগুলো কি হিব্রু, ল্যাটিন বা গ্রিক ভাষায় ছিল? ভাষান্তর করার জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল? আমি যতদূর জানি লেখাগুলো বাংলায় ছিল। কয়েক পৃষ্ঠার যুক্তিতর্ক ছিল। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কেন এ রায় দিতে তিন দিনের প্রয়োজন হলো? এই প্রশ্ন কি কেউ করেছেন? নাকি প্রশ্ন করার সাহস পাননি?

৩. বাংলাদেশে পুলিশ বিভাগ এবং আদালতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার রহস্যের কূলকিনারা করা অসম্ভব। স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে একপর্যায়ে মারামারিতে লিপ্ত হন। মারামারির এক পর্যায়ে রাগের বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে স্বামী বটি দিয়ে আক্রমণ করলে স্ত্রী মারা যান। ঘটনার সাক্ষী ঘটনার সময় উপস্থিত সন্তানরা ছাড়াও পাড়া-প্রতিবেশীরা। সেই আসামি স্বামীকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন পুলিশ ‘ব্যাপক’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭-১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করে আদালতে আর্জি পেশ করেন। আদালত আসামির প্রতি দয়া পরবশ হয়ে ৭ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই সাত দিনের রিমান্ড? একটি সহজ সরল দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করতে পুলিশের কেন এক সপ্তাহ সময় লাগবে সেই প্রশ্ন কি কখনো করা হয়েছে? আদালত কেন ৭ সাত দিনের রিমান্ড দিলেন? রিমান্ডের আদেশ দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি পুলিশকে আসামি পক্ষকে নির্যাতন করার অনুমতি দিচ্ছেন তা নিশ্চয়ই মাননীয় আদালত জানেন। নাকি ওনারা তা অবহিত নন?

রিমান্ডের আগে যে আসামি পায়ে হেঁটে আদালতে আসলো, রিমান্ডের ৭ দিন পরে স্ট্রেচারে করে বা দুইজন ধরে ধরে সেই আসামিকে কেন আদালতে নিয়ে আসতে হবে? আসামির হাতে-পায়ে-শরীরে আঘাতের চিহ্ন কি আদালতের চোখে পড়ে না? বাংলাদেশের আইন কি আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক নির্যাতনের অনুমতি দেয়? নির্যাতন করে মেরে ফেলার অনুমতি দেয়? আইনের কিতাব নিশ্চয়ই সে অনুমতি দেয় না। কিন্তু এ ঘটনাগুলো ঘটছে। দেখেও আমরা না দেখার ভান করছি। কেন করছি? নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য?

৪. সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেফতার এবং জামিনের আবেদনের ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশে আরো কয়েকটি ক্রসফায়ারের মৃত্যু ঘটেছে। ক্রসফায়ার ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের একটি ঘটনার প্রধান আসামী কারাবন্দি হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেন মারা গেছেন। বলা হচ্ছে কারাগারে নিয়ে আসার পর তিনি বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেন অসুস্থ হয়ে পড়েন? একজন সুস্থ মানুষকে কারাগারে নিয়ে আসার সাথে সাথে বারবার কেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন? কী ঘটেছিল কারাগারে নিয়ে আসার আগে এবং পরে? এর কোনো তদন্ত হবে না? এর দায়-দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে না?নির্যাতনে নাকি চিকিৎসার অভাবে তিনি মারা গেলেন এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমরা পাবো না?

৫. মাওলানা ইকবাল হোসেনদের কপাল খারাপ। রিমান্ডের সময় অথবা কারাগারে তাঁরা মারা গেলে সে নিয়ে হৈচৈ করার লোকজনের বড্ড অভাব। এ দেশ এবং সমাজ অন্ধ হয়ে গেছে। এখানে মানুষের পরিবর্তে তাঁর তথাকথিত রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি নির্দিষ্ট বৃত্তের কেউ না হলে আপনাকে নিয়ে কথা বলার কেউ থাকবে না। সমাজ আমাদেরকে সেভাবে অন্ধ এবং বোবা বানিয়ে দিয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারকৃত লেখক মোশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর সাথে মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যুর পার্থক্য কোথায়? মোশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনার পর আমরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার ছিটেফোঁটা প্রতিক্রিয়াও ইকবাল হোসেনের মৃত্যুতে দেখাইনি। কারণ, আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ এবং পক্ষপাত দুষ্ট। আমরা রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে মেতে থাকি কিন্তু মানুষের পরিচয় ভুলে যাই।

৬. সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেফতারের আগে বাংলাদেশে অনেক নামকরা সম্পাদক/ সাংবাদিককে গ্রেফতার এবং নির্যাতন করা হয়েছে।নির্যাতিত হয়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আদালতে হাজির হওয়ার ঘটনাও আছে।জামিন আবেদন হয়েছে কিন্তু জামিন না দিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ রিমান্ডে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই সেসময় প্রতিবাদ করিনি। কারণ কী? কারণ আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে চিন্তা করিনা। মনুষ্যত্বের চাইতে তথাকথিত রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে যায়।

৭. রোজিনা ইসলামের কপাল ভালো। তাঁকে রিমান্ডে যেতে হয়নি। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার কারণে হয়তো আদালত তাকে রিমান্ডে দেননি। কিন্তু আমরা সবাই তো আর রোজিনা ইসলামের মত কপাল নিয়ে জন্ম নেইনি। ইকবাল হোসেনদের রিমান্ডে দিলে কেউ কিছু বলবে না। রিমান্ডে গিয়ে মারা গেলেও কেউ কিছু বলবে না। কারাগারে নির্যাতনে বা চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেও এই সমাজে কবরের নীরবতা বিরাজ করবে।

৮. কতই না ভালো হতো যদি সবগুলো পত্রিকার শিরোনাম হতো-‘ হামিদুর রহমানকে কেন দুই সপ্তাহের রিমান্ড দেয়া হল? আফসার হোসেনের জামিন কেন দেয়া হলো না? হামিদ আযাদকে কেন কারাগারে ৬ মাস বিনা বিচারে থাকতে হবে? ইকবালুর রহিমকে কেন বিনা চিকিৎসায় কারাগারে মরতে হবে?’ এভাবে শিরোনাম হলেই আমরা বুঝতে পারতাম আমাদের মনুষ্যত্ব ফিরে আসছে। আমরা মানুষ হয়ে উঠছি।

৯. যতদিন না এ ধরনের শিরোনাম পত্রিকায় আসছে, গুম-হত্যা-রিমান্ড চলতেই থাকবে। ক্ষমতার পাশাপাশি থাকলে আপনি হয়তো বেঁচে যাবেন। কিন্তু এই বলয়ের বাইরে থাকলে আপনি যে কোন সময় হয়ে যেতে পারেন নিস্তব্ধ এবং নিথর।

লেখকের অন্যান্য লেখাঃ

বস্ত্রহীন এ শহরে!

লেখক ডা: আলী জাহানের গ্রাফিতি

লেখকঃ কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য, সাবেক পুলিশ সার্জন ( Forensic Medical Officer), British Police.

আরও পড়ুন