সুমী শারমীন
আমি তখন দিনাজপুরের একটা প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মরত।আমার খুব কাছের এক বান্ধবী হঠাৎই এই দিনের নোটিশে ঢাকা থেকে আমার বাসায় এলো।সাথে ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর “ফিল্ম এন্ড ড্রামা” ডিপার্টমেন্টের সন্মানিত পরিচালক- সারা আরা মাহমুদ।আমি খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্পের ডালি মেলে বসলাম। তখনও জানি না উনি কে??
একটু পরে ওনার পরিচয় পেয়ে আমি তো হতভম্ব। তিনি আর কেউ নন, আমাদের ভাষা শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের সন্মানিত স্ত্রী। আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম,সেই দিনের স্মৃতি জাগানিয়া কথামালা কিংবা ইতিহাস।অঝোরে কাঁদলেন।আমার সারা জীবনের পরম সৌভাগ্য এই আত্মত্যাগী মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখার।এতোগুলা বছরেও পরম মমতায় স্বামীর স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে ফেরেন বাংলা গানকে। রাত ভর তার সাথে সময় কাটানো জীবনের পরম প্রাপ্তি মনে হয়।
১৯৫২ সালে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা “বাংলা ভাষা” র দাবিতে যে মিছিল বের হয়,তাতে পাকিস্তানের হায়নারা নির্বিচারে বাঙালিদের গুলি করে।শহীদ হন তাজা প্রাণ,আমাদের ভাই সালাম,রফিক,জব্বার,বরকতসহ আরও অনেকে।চেতনারহিত অনভিপ্রেত হত্যাকান্ডে সারা বাংলা স্তম্ভিত হয়ে যায়। আমরা বুঝলাম, “মুসলমান মুসলমান ভাই”একাত্ম হয়েও, ভাইয়ের বুকে গুলি চালাতে পারে,ওরা তবে ভাই হতেই পারেনা,কারণ তারা মানুষের পর্যায়েই পড়েনা।
১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আবদুল গাফ্ফার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।মেডিকেলের আউটডোরে মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখে তিনি কাতর হয়ে পড়েন।নিজের ভাইয়ের লাশ মনে করে উপলব্ধি থেকে সাথে সাথেই গানটির দুটি লাইন লিখে ফেলেন।পরে তিনি পুরো গানটি লিখে,ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে ” একুশের গান”শিরোনামে প্রকাশিত করেন।১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত “একুশে সংকলন ” গ্রন্থে গানটি স্থান লাভ করে।
একুশের গান একটি বাংলা গান যা” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো “হিসেবে সুপরিচিত (প্রথম চরণ দ্বারা)। এই গানের কথায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখে সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করেন।গানটির কথা তরংবহুল। প্রথমে আবদুল লতিফ গানটি সুরারোপ করেন। তবে পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।পাকিস্তানিদের চোখে তিনি অপরাধী ছিলেন।এই গানে সুর করার জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে।ভাষা শহীদ হিসেবে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন এই গান সুর করে।
বাণীতে একই সঙ্গেই ক্ষোভ এবং শোকের ভাবটিকে তিনি হামিং দিয়ে সমবেত কন্ঠের এক অসাধারণ আবহ সৃষ্টি করেছেন।দ্রোহের ইন্দ্রজালে,ক্ষিপ্ত আগুনের শিখা প্রজ্জ্বলিত রক্তের বন্দনায়।এ কারণেই এমন গান আর দ্বিতীয়টি নেই।
১৯৫৪ সালের প্রভাত ফেরীতে প্রথম গাওয়া হয় আলতাফ মাহমুদের সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি এবং এটিই এখন গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। – এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।বাংলাদেশ পায় ” আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস “এর স্বীকৃতি। ভাষা,সংগ্রামী চেতনা আমাদের রক্তে মিশে আছে।প্রজন্ম পরম্পরায় শাণিত এই ইতিহাস আমাদেরই দায়িত্ব নিয়ে প্রচার প্রসারিত করতে হবে।আমাদের ইতিহাস আমাদের গর্ব।আর ভাষা আন্দোলনের গান আমাদের সংস্কৃতির অস্তিত্বের ভিত্তি।
লেখকঃ লেখক ও সংগীত শিল্পী