রউফুল আলম
আমেরিকার অন্য নাম হলো—The land of opportunity. কথাটার সত্যতা খুঁজতে হলে বেশ গভীরে ভাবতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় “ম্যানহাটন প্রজেক্ট” নামে একটা প্রকল্প ছিলো। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যায়বহুল প্রকল্প ছিলো সেটা। “ম্যানহাটন প্রজেক্টের” লক্ষ্য ছিলো পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার এবং সফল অপারেশন।
নামটা ম্যানহাটন শহরের নামে হলেও, আসলে ম্যানহাটনে কিছুই ছিলো না। দুনিয়ার সকল গোপন প্রকল্পগুলো থাকে ধাঁধায় ভরা। যাই হোক, সেই ম্যানহাটন প্রজেক্টের অন্যতম এক নায়কের নাম এনরিকো ফার্মি। তিনি হলে নিউক্লিয়ার ফিশনের গ্রেট মাস্টার। এই এনরিকো ফার্মি নিউক্লিয়ার ফিশনের চেইন রিয়েকশন আবিষ্কার করেন। যেটা পারমাণবিক বোমার জন্য অপরিহার্য। এনরিকো ফার্মির জন্মস্থান কিন্তু আমেরিকা নয়। তিনি জন্মেছিলেন ইতালি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালি ছিলো আমেরিকার চরম শত্রু।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরো একটি ব্যায়বহুল প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছিলো। সেটা হলো পেনিসিলিন যোগান প্রকল্প। হাওয়ার্ড ফ্লোরি নামে অস্ট্রেলিয়ার একজন বিজ্ঞানীর নাম আমাদের তরুণরা হয়তো জানে না।
যদিও আমরা পেনিসিলেনের জন্য ফ্লেমিং-কে কৃতিত্ব দেই, কিন্তু ফ্লোরি না থাকলে পেনিসিলিন হয়তো শ্রেফ বিজ্ঞানের একটি পাবলিকেশন হয়েই থাকতো। কে, কখন, কোন কালে সেই পেনিসিলের কথা খুঁজে পেতো—কেউ জানে না।
ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটা যে একটা এন্টিবায়টিক হিসেবে কাজ করতে পারে, মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে—সেই উপলব্ধি করেছিলেন হাওয়ার্ড ফ্লোরি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, ফ্লোরি তখন ইংল্যাণ্ডে তার টিম নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়লো—লন্ডনে আঘাত হানতে পারে নাৎসি বাহিনি। হাওয়ার্ড ফ্লোরি পালালেন আমেরিকায়।
কথিত আছে, তার সুটকেসে করে তিনি পেনিসিলিনের স্যাম্পল নিয়ে চলে এসেছিলেন। নিউইর্য়ক এসে, দ্বারস্থ হলেন ফাইজার নামের বিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। হাওয়ার্ড ফ্লোরির জ্ঞান দিয়ে, ফাইজার পেনিসিলের বিপুল উৎপাদনের জন্য অনেক ব্যায়বহুল প্রকল্প নিলেন। ল্যাবরেটরিতে তৈরি মানব সভ্যতার প্রথম এন্টিবায়টিকের নাম পেনিসিলিন। বাঁচিয়েছে সহস্র লক্ষ প্রাণ।
এ তো মাত্র দুটি ঘটনা। দু’জন নায়কের কথা। বিজ্ঞানের এমন বহু নায়কেরা তাদের আইডিয়া, সৃষ্টিকর্ম, তাদের স্বপ্ন, তাদের নেশাকে কাজে লাগিয়েছেন আমেরিকায় এসে।
আলবার্ট আইনস্টাইন জার্মানী থেকে শরনার্থী হয়ে এসেছিলেন আমেরিকায়। রসায়নে প্রথম যে মুসলিম বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছিলেন তার নাম আহমেদ জুয়েইল। তিনি মিশর থেকে এসেছিলেন আমেরিকায়। পিএইচডি করেছিলেন ইউপ্যানে(UPenn)। আমি যখন ইউপ্যানে পোস্টডক করতাম, প্রতিদিন ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই আহমেদ জুয়েইলের বিশাল একটি ছবি চোখে পড়তো। (দুনিয়ার অনেক দেশে, নেতা-নেত্রী ছাড়া আর কারো ছবি দেখা যায় না ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কিংবা ডিপার্টমেন্টে)
আমেরিকা দেশটাতে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু এই দেশটা একটা বিষয়ে অনন্য। সেটা হলো মেধাবীদেরকে আলিঙ্গন করা। আমেরিকা তার শত্রু দেশের মেধাবীকেও সুযোগ দেয়।
আজকে আমি যদি প্রেসিডেন্ট নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা গালাগালি করি কিন্তু গবেষণা-উদ্ভাবনে অনন্য অবদান রাখি, তাহলে মিলিয়ন ডলার ফান্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এদেশের বহু প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন। আমাকে রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্রেটের রাজনীতিকদের গায়ে পড়ে মেধার বিকাশের চিন্তা করতে হবে না। এ কারণেই এই দেশটার নাম হয়েছে—দ্যা ল্যান্ড অব অপরচুনিটি।
আমেরিকার এই স্ট্রেটেজি দুনিয়ার বহু দেশ ধার করেছে। প্রাচ্যের চীন-জাপানের মতো সাংস্কৃতিক রক্ষণশীল দেশগুলোও আজ মেধাবীদের জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছে। চীন এখন সারা দুনিয়া থেকে ছেলে-মেয়েদের ডাকছে। সেদেশের ইউনিভার্সিটি ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নিয়োগ দিচ্ছে।
আমার দেশ তার নিজের সন্তানদেরই ডেকে নেয় না। দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নিজভূমের মেধাবীদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় না। শত শত কোটি টাকার ভংচং প্রকল্প চালু করা হয়। অথচ পঞ্চাশজন এক্সপার্টকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছে কোন সরকার?
বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিনিয়র পোস্টগুলোতে সরাসরি নিয়োগের ব্যবস্থা নেই কেন? একজন এক্সপার্টকে কেন সরাসরি প্রিন্সিপল সাইন্টিস্ট বা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পদে আমরা নিয়োগ দেই না? কেন তাদের জন্য বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিতে পারবো না।
একজন ভোট চোর, রাষ্ট্র লুট করা এমপি বা মন্ত্রী যদি সরকারী ফ্ল্যাট বা গাড়ি পেতে পারে, তাহলে একজন এক্সপার্ট সাইনটিস্টকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাকে সরকারী বাসভবন ও গাড়ি দিতে পারি না কেন? কারণ আমার দেশটা ল্যান্ড অব অপরচুনিটি না। —ইটস এ ল্যান্ড অব ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ড কিলার।
লেখকঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী গবেষক ও লেখক