আরজু নাসরিন পনিঃ
“কই গেলিরে বিসমিল্লাহর পাগলা সানাই!?”, ইবু এভাবেই আমাকে নক করতো। ওর এই অদ্ভুত সম্বোধনগুলো আমাকে দারুণ আলোড়িত করতো। স্ক্রিনের এপাশের আমি অনেক সময়ই ওকে বুঝতে দিতাম না ও আমার জন্য কতোটা বিশুদ্ধ বাতাস ছিল।
হ্যাঁ, ‘ছিল’ বলছি।
ওর সাথে প্রথম দেখা হওয়াটা খুব সিনেম্যাটিক ছিল। ১৯৯৯ সালের ২৫শে এপ্রিল। শহিদ মিনারে পোজ দিয়ে দাঁড়ানো ভাগ্নির ছবি তুলতে কখন যে সিড়ির কিনারে চলে এসেছিলাম জানতে পারিনি। ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে ও পতন ঠেকিয়ে মুখ ভেংচে বলেছিলো, “আরেকটু সাবধান!” আমি কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পাইনি ওর বিরক্তিকর এক্সপ্রেশনে!
পরের বার চানখার পুলে! লুচি, চাপ খেতে গেছি বান্ধবী রিক্তার সাথে। ওও দেখি সেখানে আসর জমিয়ে হাত নেড়ে আতলামী করছে বন্ধুদের আড্ডায় আর টেবিল ভরা কালাভুনা, লুচি, চাপ…ছেলেগুলো খেতেও পারে!
পাশের টেবিলটাই ফাঁকা ছিল বলে বসতে বাধ্য হলাম। ওর চাউনি দেখে পরিস্কার বুঝলাম মনে মনে গালি দিচ্ছে নিশ্চিত!
পড়বিতো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে! আমার সাথেই কেন এমন হচ্ছে! দু’জনে চার কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছিলাম। ছেলেটা চা টেবিলে রাখার আগেই আমি উচ্ছসিত হয়ে হাত বাড়ালাম। আর তখুনি ঘটলো কান্ডটা! উপরের চায়ের কাপটা ছলকে আমার কোলে পড়লো। “আআআ!” বলে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলাম।
ততক্ষণে ওও তড়াক করে আমার কাছে চলে এসেছে, “অদ্ভুত!, সমস্যা কী! রাস্তাঘাটে চলতে না পারলে বাসায় থাকলেই হয়!” বলতে টিস্যু এনে লবণ দিয়ে আঙ্গুলের ফোস্কা পড়া জায়গাটা চেপে ধরলো।
এমন মুখ করে অপমান কেউ করেনি কখনো আমায়। টিকতে না পেরে কেঁদে ফেললাম ঝরঝর করে। “হইছে!” বলে বেজায় একখান ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো!
সম্পর্কটা আনডিফাইন্ড ছিলো। ওর ডিপার্টমেন্টের যে কয়জন বন্ধুর সাথে পূর্ব পরিচয় আছে তারা কেউ আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। ও যেন সবারটুকু একাই উসুল করে নিবে।
কিছু অনুভূতি থাকে অসঙ্গায়িত! না প্রেম, না বন্ধুত্ব। কিন্তু সম্পর্কটা কেমন যেন, জীবনে কেউ থাকে যার কোল ঘেষে ম্যাও ম্যাও করে উম নেওয়া যায়। ও আমার জীবনে তেমন কেউ ছিল।
খুব যে দেখা হয়েছে তেমন না। হলে কখনো ফোন করে খোঁজ রাখতো। আর কটমট করে জিজ্ঞেস করতো , “নতুন কোন আকাম করিসনিতো!” আমিও লক্ষী বাচ্চার মতো আহ্লাদী গলায় মুচকি হেসে বলতাম হল আর ক্লাস এর বাইরে কোথাও যাইনি একয়দিনে। ও যেন স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতো।
কতো কথা, কতো শাসন…ইবু! তোর এই আদর ছাড়া বেঁচে থাকা মূল্যহীন।
পৃথিবীর এই মহাদূর্যোগে আক্রান্তের আমিও একজন। আজ সপ্তম দিন চলছে। আমার শ্বাস কষ্ট বেড়ে আমাকে অস্থির করে তুলছে। যে কোন সময়ে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি ইবুকে জানাতে পারিনি। ও জানে আমার সিজনাল ফ্লু হয়েছে। এই বয়সে এসেও ওর যত্নের কোন কমতি রাখেনি আমার জন্য। সমস্যা একটাই ও দূরদেশ থেকে আমার পাশে আছে, নি:শ্বাসে, অনুভূতিতে।
চোখের জলে ভাসছি আমি! আমি জানি আমার প্রস্থান ও নিতে পারবে না। যত শাসন করুক আমায় ওর নিরাপদ জলাশয়ে কেবল এই পাগলীর দাপাদাপি ছিল। ছিল আহ্লাদ!
জানি ক্ষমা করবি না আমায়। ওই পারে আবার দেখা হবে নিশ্চিত। তখন আমি ঠিক লক্ষী বালিকাটি হয়ে থাকবো, দেখিস!
লেখকঃ সাহিত্যিক।