Ads

কভিড ১৯ কে সাথে নিয়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে ও ভালো থাকতে জানতে হবে

-সালমা তালুকদার

কভিড ১৯ একটা ভয়ঙ্কর মহামারীর নাম। যে মহামারী শুধু শরীরকে ধ্বংস করছে না মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ভয়ঙ্করভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। যাদের কভিড হয়েছে তারাই কেবল বলতে পার, জার্নিটা কত ভয়ানক ছিল! অন্যদিকে যাদের কভিড হয়নি, অথচ এর প্রতিক্রিয়া স্বরুপ ঘরে আটকে আছে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়।
গতকাল এক বড় ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। খুব দুঃখ করে বললেন, সালমা চারপাশে মানুষ দেখি না। সব শুয়োর দেখি। আমি বললাম, কেন শুয়োরকে অপমান করছেন। ও তো একটা প্রানী। ওকে আল্লাহ যেমন বানিয়েছেন তেমন করেই চলছে। কারো ক্ষতিও করছে না। কিন্তু মানুষের তো কিছু জিনিস বেশি আছে। সবচেয়ে বড় সম্পদ তার একটা বিবেক আছে। সে নিজের বিবেকটাকে কতটা কাজে লাগাচ্ছে!
লক ডাউনের আগের কথা বলি। আমি আমার কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরছি। দাঁড়িয়ে আছি লুকাসের মোড়ে। উদ্দেশ্য বলাকা বাস। আমি কখনোই রাস্তাঘাটে চলার সময় কারো চোখের দিকে তাকাই না। সুতরাং পাশ দিয়ে নিজের বাবা-ভাই গেলেও বলতে পারবো না,যদি তারা আমার কাছে এগিয়ে না আসে। সেদিন যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় আমার এক দুলাভাই পাশে এসে যখন বললেন, কই যাও। তখন দেখলাম। যাই হোক এটা আমার প্র্যাকটিস। কারন কারো দিকে তাকালেই হয় চোখ টিপ দিবে। নয়তো জিভ বের করে নিজের জিভ চাটবে। কেউ হয়তো নিজের হাতের আঙ্গুল দিয়ে খারাপ কাজের ইঙ্গিত দিবে। তাই অনেকদিন থেকেই প্র্যাকটিস করেছি রাস্তায় চলতে গেলে কারো দিকে তাকাবো না।
যাই হোক, বলছিলাম লুকাসের মোড়ের কথা। আমি তো বাসের খোঁজে তাকিয়ে আছি দূরে। পাশ দিয়ে একটা প্রাইভেট কার যাচ্ছিল। আমি সরে জায়গা করে দিলাম। চোখে না হয় তাকাই না। কান তো বন্ধ না। শুনলাম গাড়ির গ্লাস নামিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি বাজে কাজের ইঙ্গিত দিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে চলে গেল। অথচ আমার গায়ে সাদা এপ্রোন ছিল। সেই মুহূর্তে নিজেকে শুধুই একটা মাংসপিণ্ড মনে হয়েছিল। আমি যে এত কঠিন মানসিকতার একজন নারী। তারপরও এই নোংরা ভাষাটা সামলাতে গিয়ে সেদিন লুকাসের মোড় থেকে পায়ে হেঁটে মালিবাগ পর্যন্ত এসেছিলাম। বৃষ্টি, কাঁদায় এই হাঁটাটা খুব বেশি সুখকর ছিল না। তবু হাঁটার কারনে মানসিক যন্ত্রণা থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলেছিল।
ঐ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা গাড়ির মালিক ছিল নাকি ড্রাইভার ছিল সেটা জানি না। তাকিয়েছিলাম একবার। কিন্তু বাজে মানুষের চেহারাগুলো সব একই হয়। তাই বোঝা মুশকিল, কে মালিক আর কে চাকর! বিশ্বাস তো আমরা অনেককেই করি। কিন্তু সব সময় আসলে বুঝি না সে কেমন। এবার একজন লেখকের কথা বলি। তার লেখা আমি পড়িনি। তার একটা উপন্যাস বের হয়েছিল গত ২০২০ এর বই মেলায়। এবং এই বইটা নিয়ে পুরো বছরটা সে ভীষন হইচই করেছে। কিন্তু বিভিন্ন পোস্টে তার নেগেটিভ মানসিকতার পরিচয় এতটাই সুস্পষ্ট ছিল যে, তার বই পড়তে আমার মন সায় দেয়নি কখনো। জানি না কেন। হয়তো লেখক হিসেবে যাদের মানি তাদের নেগেটিভ মানসিকতা মেনে নিতে পারি না। আমার মনে হয় লেখক তার লেখার মত পবিত্র হবে। যদি তার লেখা কারো ভালো লাগে সে যেন লেখকের ব্যক্তি জীবনের সাথে তাকে আলাদা করতে না পারে। কারন লেখকের চরিত্র তার লেখায় প্রকাশ পায়।
এটা বলতেই পারেন, তাহলে যার লেখা আপনার ভালো লাগবে না বলে আপনি পড়েননি সে কি লেখক নন। অবশ্যই তিনি লেখক। কিন্তু চটি বইয়ের লেখক। যে বই গুলোরও পাঠক যুগে যুগে ছিল, আছে এবং থাকবে। এই সব লেখকরাও তাদের লেখনীর মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসছেন। এরাও লেখার মধ্যে নিজেকে বিলীন করার জন্য ঠিক চটি বইয়ের চরিত্র গুলোর মতোই নিজেকে প্রকাশ করেন এবং ঐ রকম জীবন যাপন করেন। যেমন ভ্রমন লেখকগন ভ্রমন করে লেখার উপাদান বের করেন ইত্যাদি।
যাই হোক, ভেবেছিলাম ঐ লেখক তো আমার সাথে খারাপ কোন আচরণ করেনি। থাকুক পরে আইডিতে। অবশ্য তার টাইমলাইনের পোস্টের কারনে তাকে আমি তিনবার ব্লক করেছি। তিনবারই বহুত আকুতি মিনতি করে আবার বন্ধু লিস্টে এড হয়েছিল। ফাইনালি তার চরিত্রটা সে দেখিয়ে দিল আমার ইনবক্সে তার নিজের গোপন অঙ্গের ছবি পাঠিয়ে। তার চেহারাও ছিল তার লিঙ্গের সাথে। আরো একটা ধাক্কা এবং ব্লক লিস্টে প্রেরণ। সেই ঘটনার পর ঘুমোতে পারিনি অনেকদিন। নিজের শিক্ষা, সংস্কৃতি মুহূর্তে ধুলোয় লুটিয়ে গেল। খুব নোংরা লাগছিল নিজেকে।
এমনটা যে কেবল নারী বলে আমার সাথেই হয় তা কিন্তু নয়। আমার পুরুষ বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানতে পারি অনেক কিছু। অনেকে বিশ্বাস করে নিজে থেকেই বলে। কোন মেয়ের যদি কোন ছেলেকে ভালো লাগে। সামনাসামনি কথা বলে। বাড়ি গিয়ে নিজের শরীরের উপরের অংশের ছবিটা পাঠিয়ে দেয়। তাই শুধু মেয়েরা এবিউজিং এর স্বিকার হচ্ছে তা নয়, ছেলেরাও হচ্ছে। এবং এই কভিড পরিস্থিতিতে আরো বেশি হচ্ছে।
টিকটক একটা বিনোদন মাধ্যম। অনেকে পছন্দ করে অনেকে করে না। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ হুজুগে নাচে বলে কিছু বাজে টিকটক দেখে গনহারে বলতে থাকে টিকটক ভালো না। তাদের অনুরোধ করবো একটু ঘুরে আসেন প্লিজ। ভালো মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যারা সময় কাটানোর জন্য গানের সাথে ঠোঁট মিলায়। বিভিন্ন সচেতনতা মূলক নাটিকা দেয়। রান্নার টিপস দেয়। মেকাপ টিউটোরিয়াল করে। সুখের সংসারের ভিডিও আপলোড করে। অনেকে আবার অনেক দুঃখে টিকটকে এসেই কাঁদে।
একটু গভীরে প্রবেশ করেন। কেন এগুলো করে! কারন এখানে অনেক মানুষ। মানুষ সামাজিক জীব বলে, মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাই নিজের সুখ দুঃখ শেয়ার করতে আসে। গতকাল টিকটকে দেখলাম, একটা CP শিশু অর্থাৎ সেরেব্রাল পালসি কিশোরী, যার মুখ বাঁকা। কথা বলতে পারে না ঠিক করে। সে সাজুগুজু করে এসে টিকটক করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব খুশি হয়েছি। কারন এদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য এরা ফ্রাস্টটেশনে থাকে সব সময়। তার উপর আছে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার প্যারা। এতকিছু সাথে নিয়ে এরাও বিনোদন খোঁজা শুরু করেছে।
যাই হোক বলছিলাম নারী, পুরুষ এবিউজের কথা। যা যা এতক্ষন বলেছি সব কি ভুল মনে হচ্ছে! যারা চোখ বন্ধ করে আছেন তাদের কাছে হয়তো ভুল। যারা এসবের স্বীকার হয়েছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন এগুলো এখন এই সমাজের বাস্তবতা। কভিডের কারনে ফেইসবুক, টিকটক, ম্যসেন্জারে সমসাময়িক সমাজ ভেসে উঠেছে। শরীরের ক্ষুধায় মানুষ পাগল হয়ে গেছে। যাদের পেটে ভাত কম পরছে তাদেরও এই চাহিদা আছে। যাদের প্রতিবেলা ভরপেট খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে তাদেরও এই চাহিদা আছে। আর এই চাহিদা মেটাতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে, নোংরা ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে মানুষ হওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলছে মানুষ। তবু এরা শুয়োর অথবা কুকুর না। এরা শুধুই একটা অবয়ব। যাদের ভেতর কোন মনুষ্যত্ব নেই। চিন্তা করার ক্ষমতা নেই। বিবেক বলে কিছু নেই। এরা শুধু চোখ, হাত, পা আর মুখ ব্যবহার করতে জানে। বাকি যে এতকিছু আছে আমাদের শরীরে, এর কোনকিছুর ব্যবহার এরা জানে না।
সবশেষে বলতে চাই, অনলাইনের সবগুলো সাইট ব্যবহার করে মানসিক ডাক্তারদের কাজ করা উচিৎ। মানুষ যেন ফেইসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম খুললেই ভালো কথা শোনে। যেগুলো বই পড়ে জানার কথা, সেসব যেন চোখে দেখে ও কানে শোনে। আর এই লেখাটা যাদের চোখে পরবে তাদের কাছে অনুরোধ দুটো হলেও ভালো কথা বলেন। নিজেকে ভালো বানানোর জন্য কারো নেগেটিভ আচরণ বা কথার সাথে তাল মিলাবেন না। আর বন্ধ দরজার ভেতর যা হয় তা নিয়ে মাতামাতি না করে, প্রকাশ্য সমাজে যা শুরু হয়েছে তার প্রতিকার করুন।
মেয়েরা জামাকাপড় খুলে ফেলছে। ছেলেরা প্রকাশ্যে যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করছে। কি এসব! আপনারা আছেন ক্যামেরা নিয়ে রেডি, কে কার সাথে বন্ধ দরজার ভেতর কি করছে সেটা প্রকাশ করার জন্য। আরে ভাই, যারা বন্ধ দরজার ভেতর একসাথে পা রেখেছে, তারা তো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করেই পা রেখেছে। আপনি কে তার গোপন কর্ম প্রকাশ করার! সেটার দেখার জন্য আল্লাহপাক আছেন। তিনি সবকিছুর হিসাব নিকাশ কড়ায়গন্ডায় নিবেন।
বরং যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের ভালো মানুষ বলে সমাজে প্রমান করার চেষ্টা করেন, তারা নিজের পরিবার সমাজ নিয়ে কাজ করেন। খারাপ ভালো বোঝান। যার যার নিজের পরিবারটাও যদি খেয়াল রাখেন তাহলেও অনেক উপকার হয়। আপনার ঘরের ছেলে অথবা মেয়েটি টিকটক, লাইকি, ফেইসবুকে কি করছে একটু খোঁজ নেন। আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো রাখেন। ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ নেন। নিজেও ভালো কথা বলেন। দু’জন দু’জনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিন। অনলাইনে অলরেডি বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যেগুলো অফলাইনে চলতো সেগুলো এখন অনলাইনে। কোর্স ফি এর বিনিময়ে বিভিন্ন কোর্স করাচ্ছে। সেগুলোর খোঁজ নেন। পরিবারকে ব্যস্ত রাখেন, নিজেও ব্যস্ত থাকেন।
৭ জুলাই, ২০২১ ইং
যাত্রাবাড়ী
আরও পড়ুন