সুস্মিতা মিলিঃ
আপনার নাম কি সোমা? আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে পাশের মহিলাটির দিকে তাকালেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুলতানা জাহান সোমা। তার চোখে উল্টা প্রশ্ন
—আমি কি আপনাকে চিনি? মানে আপনি কি আমাকে চেনেন? কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত মহিলাটিকে কেমন চেনা চেনা লাগছে সোমার। মনে হচ্ছে কোথায় জানি দেখেছে।
সোমা একটু ভালো করে মহিলাটির দিকে তাকালেন। লিলেন কাপড়ের প্রিন্টের বোরকা পরা, হাতে দুটো রং যাওয়া সিটি গোল্ডের চুড়ি।
মাথায় একটা ওড়না পেচিয়ে পরা, মাথার সিঁথি বরাবর ওড়নাটা বেশ খানিকটা সেলাই করা।
—-আমার নাম নিলু নিলুফার, তুমি মানে আপনার সাথে মডেল গার্লস স্কুলে পড়তাম।
—আমার সাথে পড়তেন? আমার সাথে?অবাক হতে যাবে এমন সময় চট করে সোমার বুকের ভেতরে একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো ।
—নিলু! তুই ? বলেই মহিলাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সোমা। নিলু! এতোদিন পর?
কত বছর চলে গেলো!প্রায় ত্রিশ বছর পর দুজনের দেখা হলো। নিলু আর সোমা এক স্কুলে আর এক ক্লাসেই পড়তো।দুজনের বন্ধুত্ব ছিলো খুব গভীর। একই বেঞ্চে বসা।টিফিন ভাগ করে খাওয়া। মাঝে মাঝেই নিলু সোমাদের বাসায় আসতো। সোমার বেশি যাওয়া হতো না কারন ওর মা কোথাও যাওয়া পছন্দ করতেন না।তাই নিলুই আসতো মাঝে মাঝে বিকালে সোমাদের বাসার ছাদে আড্ডা দিতে।
স্কুলে নিলু বরাবরই সোমার চেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলো। সোমা ছিলো মিডিয়াম মানের ছাত্রী। নিলুর রোল উপরের দিকে থাকতো বলে সব সময় সে একটা অহংকারী ভাব নিয়ে থাকতো। চঞ্চল সোমা মোটামুটি রেজাল্ট করলেও এসব নিয়ে তার কোন বিকার ছিলো না। কারণ তার ভাইবোন সকলেই ভালো ছাত্র-ছাত্রী ছিলো। পরিবারের কাছ থেকেও তেমন চাপ ছিলো না। আর তাদের পারিবারিক পরিবেশ ছিলো খুব ভালো।
সোমার বাবা ছিলেন সরকারি অফিসার। তিনি খুব অমায়িক আর সৎ অফিসার ছিলেন।
আর নিলুর বাবা ছিলো কাঁচামালের ব্যবসায়ী।
তারা মোটামুটি পয়সাওয়ালা ছিলো।কিন্তু শিক্ষার পরিবেশ তেমন ছিলো না। কিন্তু নিলু ছিলো গোবরে পদ্মফুলের মতো। সত্যিই সে খুব মেধাবী ছিলো।
সোমা আর নিলুর বন্ধুত্ব ছিলো ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত। তারপর একটা ঘটনায় দুজনের সম্পর্কে চিরস্থায়ী ফাটল ধরে। তারপর আরও দুবছর এক স্কুলে পড়লেও কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। বলার চেষ্টাও করেনি।
এইটে উঠার পর ওদের পড়ালেখার চাপ অনেকখানি বেড়ে গেলো। কারন দুজনই বৃত্তি দিবে। তাই পড়াশোনা নিয়ে এবার সোমাও বেশ সিরিয়াস হয়ে গেলো।
এমনি এক বিকালে সোমা হঠাৎ নিলুদের বাসায় গেলো। দুদিন জ্বর থাকায় স্কুলে যায়নি সোমা। তাই পড়া আনতে নিলুদের বাসায় গিয়েছিলো।
নিলুদের উঠানে পা দিতেই দেখে ফর্সা রোগা একটা ছেলে পেয়ারা গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে। নিলুর ভাইদের চেনে সোমা। সোমাকে দেখেই ছেলেটা এগিয়ে এলো,বলল
–তুমি সোমা তাইনা?
সোমাতো অবাক! এই ছেলেটা কে? তার নাম জানলো কি করে?
সে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
—আপনি কে? আমাকে চিনলেন কি করে?
—–চিনবো না! তোমাকেতো আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি।তাইতো একদেখাতেই চিনে গেলাম।মিটিমিটি করে হাসতে হাসতে বললো ছেলেটা।
তারপর—-সোমার ভেতরে কি জানি হলো, ভেতরটা শূন্য হয়ে গেলো নিমিষেই। সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো অদ্ভুত এক ভালোলাগায়। তেরো বছরের কিশোরীর নিজস্ব ভুবন উলটপালট হয়ে গেলো মূহুর্তের মধ্যে। সোমা নিলুর সাথে দেখা না করেই সেদিন বাসায় চলে গেলো।
সেদিন সারারাত সোমার ঘুম হয়নি। তার ভেতরে বাজতে লাগলো ছেলেটার সেই কথাটা
“আমি তোমাকে স্বপ্নে চিনেছি” “আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি”
অপরিচিত একটা ছেলের জন্য তেরো বছরের কিশোরী নিলু ফুপিয়ে ফুপিয়ে মধ্য রাতে কাঁদতে লাগলো। মা জিজ্ঞেস করলেন,
— কিরে সোমা কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?
—-আমার পেট ব্যথা করছে মা।
মধ্যরাতে মা তার কিশোরী মেয়েকে গরম পানি খাওয়ালেন। এন্টাসিড টেবলেট দিলেন।
মা জানতেও পারলেন না তার কিশোরী মেয়েটার মনোজগতে কি বিপর্যয় নেমে এসেছে। কি ঝড় চলছে তার মেয়েটার মনে।
পরদিনই সোমা জেনেছে ছেলেটার নাম তাইজুল। সে নিলুর খালাত ভাই। বি বাড়ীয়া সরকারি কলেজে বিএসসি পড়ছেন।৷ হোস্টেলে থাকেন। সামনে বৃত্তি পরীক্ষা সেই জন্য নিলুর খালাতো ভাই তাইজুল এখন থেকে নিলুকে পড়াবেন । তিনি খুব ভালো অংক বুঝান নিলুকে। আগে মাঝে মাঝে এসে পড়াতেন এখন নিলু এইটে ওঠায় তিনি ওদের বাসায় চলে এসেছেন।
এতদিন নিলু কখনো তার তাজু ভাইয়ার কথা বলেনি। কিন্তু নিলু এখন তাজু ভাইয়া এটা করে, তাজু ভাইয়া ওইটা করে, এই গল্প প্রতিদিনই করে। সোমার খুব ভালো লাগে এসব শুনতে।আবার নিলুর ভাগ্য দেখে হিংসাও হয়। এখন সোমা মাঝে মাঝেই নিলুদের বাসায় যায়। তাজু ভাইয়ার সাথে গল্প করতে তার খুব ভালো লাগে। একদিন তাজু ভাইয়া গল্পের ছলে সোমার হাতটা একটু ধরেছিলো, সে সময় সোমার ভেতরে অপার্থিব এক ভালোলাগায় কাঁপতে লাগলো। বাসায় এসে রাতে চামচ দিয়ে ভাত খেয়েছে। হাতটা ধুয়ে ফেললে যদি ভালো লাগার অনুভূতিটা শেষ হয়ে যায়!
সোমার পড়াশোনায় কিছুটা শিথিলতা আসলো। পড়তে বসে সে তাজু ভাইয়ার সাথে মনে মনে গল্প করতো। তার পৃথিবীতে এখন শুধু একটাই নাম, তাজু!তাজু। একদিন সোমা নিলুদের বাসায় যাওয়ার পর তাজু ভাই সোমাকে লুকিয়ে একটা চিঠি দিলো। চিঠি পেয়ে সোমার সারা শরীর ঘামতে লাগলো। এটা ছিলো প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠি। বাসায় এসে বাথরুমের ভেতরে ঢুকে প্রথম চিঠিটা খুললো। চিঠিটাতে খুব সুন্দর একটা গন্ধ।
তাতে লেখা ছিলো “তুমিই আমার স্বপ্ন দেখা রাজকন্যা। “
একটা মাত্র লাইন!এই লাইনটি সোমা কত শত বার যে পড়েছে হিসেব নেই। তার মনে হতে থাকে সে সত্যিই একজন রাজকন্যা। আর তাজু হলো যুবরাজ।
সে পরদিনই একটা চিঠি লিখে নিলুকে দিল।
নিলু অবাক হলো চিঠিটা দেখে,বললো
—এটা কি?
সোমা লাজুক গলায় বললো
—এই চিঠিটা তাজু ভাইয়াকে দিস
—কি? তুই কি আমাদের বাসায় এই কারনে যাস?ছি! ছি! ছি! তুই এতো খারাপ একটা মেয়ে জানলে আমি কখনো তোর সাথে মিশতাম না।
— নিলু,কাল তোর ভাইয়া আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে।তাই আমিও,,,
—- মিথ্যে কথা,তাজু ভাইয়া এমন মানুষই না। ভাইয়া বরং বলেছে তুই যে লেখাপড়ায় গাধা এটা নাকি তোর চেহারা দেখলোই বুঝা যায়।
ভাইয়া গাধা ছাত্রীদের একদম পছন্দ করেনা। আর তুই বলছিস তিনি তোকে চিঠি দিয়েছেন? রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিলু বললো।
—–সোমা অনুনয় করে বললো,তুই তাজু ভাইয়াকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ প্লিজ। তুই দেখিস ভাইয়া তোকে বলবে আমাকে যে পছন্দ করে সে কথা।
পরদিন নিলু স্কুলে এসেই অন্য বেঞ্চে বসলো। সোমা ওর জন্য জায়গা রাখলো কিন্তু নিলু সেখানে বসলো না। টিফিনের সময় নিলু ডেকে নিল সোমাকে তারপর খুব কঠিন স্বরে বললো,
—– তুই আর কোনদিন আমাদের বাসায় যাবি না। তাজু ভাইয়া বলেছে আমি যেন আর তোর মতো খারাপ মেয়ের সাথে না মিশি। কারন ভাইয়া বলেছে তাতে আমিও খারাপ হয়ে যাবো। আজ থেকে তুই আর আমি বন্ধু না।তুই আলাদা আমি আলাদা। তোর সাথে আমি আর কখনো কথা বলবো না।
সোমা বিশ্বাস করতে পারলো না তাজু ভাইয়া এমন কথা বলেছে। সেদিন সোমা উদভ্রান্তের মতো স্কুল থেকে এলো।গায়ে জ্বর। কিচ্ছুটি ভালো লাগতো না তার। সেদিন থেকে ভীষণ জ্বরে কয়েকদিন কাহিল হয়ে রইলো। পরিবারের সবাই ভাবলো জ্বরের কারনে মেয়েটা এমন নির্জীব হয়ে গেছে।
শরীরের অসুখ সবাই দেখে যত্ন নেয়। কিন্তু সোমার মনের ক্ষতস্থানে কেউ মলম লাগালো না। কেউ জানতেও পারলোনা বাড়ির কিশোরী মেয়েটি কি ভয়াবহ দিন পার করছে। সারারাত সে ঘুমাতো না। মাঝে মাঝেই নিরবে চোখের পানি ফেলতো।
নিলু আর সোমার ভুবন আলাদা হয়ে গেলো। দুজন একই স্কুলে পড়ে তাও যেন অনেক দূরে থাকে। মাঝে মাঝে সোমার নিলুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হতো।কিন্তু নিলু এই সুযোগ ওকে কখনো দিতনা।
—আস্তে আস্তে সোমা পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে গেলো। মনের অস্থিরতা দূর করতে সারাদিন পড়ালেখা করে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষে দেখা গেলো সোমা ক্লাসে ফোর্থ হলো আর নিলুর পজিশন অনেক পেছনে চলে গেলো । ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় সোমা টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেলো আর নিলু পেলোনা।
সোমা তার মেধা দিয়ে সায়েন্স পেলো আর নিলু মানবিক বিভাগে চলে গেলো।
এসএসসি পাশ করে সোমা ঢাকার একটি নামকরা কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো। নিলুর আর তাজুর অধ্যায়টা সোমার কাছে অনেকটা ফিকে হয়ে গেলো। কিন্তু সোমা ঠিক করে রেখেছে যদি কখনো তাজু ভাইয়ার সাথে দেখা হয় তবে জিজ্ঞেস করবে তিনি কেন সোমাকে খারাপ মেয়ে বলেছিলো? কেন তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে তার সাথে মিশতে বারণ করেছিলো। সোমার সাথে তিনি কেন এমন করেছিলেন?
সোমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে গেলো। আর দূর থেকে শুনলো নিলুর বিয়ে হয়ে গেছে একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের সাথে। পড়ালেখা শেষ করে সোমার বিয়ে হলো একজন ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে। আর সোমার চাকরি হলো জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে।
আজ প্রায় ত্রিশ বছর পর মলিন বিব্রত নিলুকে দেখে সোমা সব ভুলে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখলো দুজন মধ্য বয়সি মহিলার মুখে স্বর্গীয় হাসি আর চোখে অনবরত ঝরছে অশ্রু। হঠাৎ সোমা দেখে হাতে একটা পাউরুটির প্যাকেট আর চারটে কলা হাতে ইস্ত্রি বিহীন শার্ট প্যান্ট পরে মুখে ভর্তি পান খেতে খেতে নিলুর হাসবেন্ড এলো।
তাজু ভাইয়া! উনার দিকে তাকিয়ে ত্রিশ বছর আগের মতই ভেতরটা শূন্য হয়ে গেলো সোমার। এতো বছর ধরে যে প্রশ্নগুলো মনে নিয়ে বসে আছে আজ এক নিমিষেই যেন তার সকল উত্তর পেয়ে গেলো।
কোন প্রশ্ন করলো না সে বরং তাদের জন্য কোথা থেকে একটা করুণা অনুভব করলো ভেতরে।
লেখকঃকবি ও সাহিত্যিক।