Ads

নিঃশব্দ ভাবনারা

মাহফুজা শিরিন

আমার একটা খুব সুন্দর ছেলেবেলা ছিল । এতটাই সুন্দর যা সারাটি জীবন মনে হয় এভাবেই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকবে। আনমনে শুয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে শিলা। আজকাল তার কি.যে…হয়েছে!!! যখনই কাজের ফাঁকে একটু অবসর পায় তখনই ভাবনারা যেন মিতালী করার জন্য তার চারপাশে এসে হুড়মুড় করে হাজির হয়ে যায়। আর সে তখন ভাবনার দোলায় দোলতে…দোলতে…পিছনের দিনগুলোতে ফিরে যায়। কতইনা রং মাখা ছিল সে দিনগুলো……..।

শিলা একটি মফস্বল শহরে বড় হয়েছে । তাদের এই শহরটি ছিল অনেক সুন্দর । শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদীর এ-ক শাখা নদী । শিলারা ছিল দুই বোন। শিলা আর মিলা । মিলা শিলার চেয়ে সাত আট বছরের বড়। তাই মিলা বাড়িতেই মায়ের সাথে থাকতো । আর শিলার তখন বয়স সাত কি আট তাই তাকে বাড়িতে তেমন দেখা্ই….. যেতো না..। সে সারাটা দিন বাড়ির বাইরে খোলা মাঠ আর তার লাগোয়া আম আর লিচুর বাগানে ছুটে বেড়াতো….। সে ছুটে বেড়াতো ফড়িং আর প্রজাপতির পিছন পিছন। অনেক দূ–র ছুটে যেয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আবার ফিরে আসতো।

ওর ক-ত্ত খেলার সাথী ছিল। সবার নামও আজ আর ঠিকমতো মনে নেই। তবে ঘনিষ্ঠ দুই একজনের নাম এখনো মনে আছে। এখন আর তাদের সাথে ঠিকমতো দেখা- ও হয়না । জীবনের প্রয়োজনে…. আজ একেক জন একেক দিকে ছিটকে পড়েছে। তাঁর নিত্য দিনের খেলার সাথী ছিল তিন্নি ,শিমু আর টিয়া ।

এই চার জনের পায়ের ছাঁপ পড়েনি এমন জায়গা অত্র মহল্লায় খুঁজে পাওয়া ভার । সব চে মজা হতো যখন তারা ডিউক আর ডনদের বাগানে খেলতে যেত। ডিউক আর ডন দুই ভাই। ওরা একটি শত বর্ষের পুরনো পৈতৃক ভিটায় থাকতো । এই দুই ভাই ছিল রহস্য মানব । ওরা সচরাচর কারো সাথে মিশতোনা। কেউ কেউ বলে ওরা বিয়ে করেছিল কিন্তু বৌ মারা গেছে কেউ বলে ওদেরকে ছেড়ে ওদের বৌরা চলে গেছে আবার কেউ বা বলে… ওরা কখনও বিয়ে- ই- করেনি…. । আসল ঘটনা…. আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

ওদের বাড়িটা ছিল বাগানের শেষ মাথায় । বাড়িটা পুরাতন হলেও…… ঐ আমলে যে ওরা অনেক শানদার ছিল তা বাড়ি টা দেখলেই– বুঝা যায়…… । ইটের সাইজ গুলো ছিল অনেক বড় অনেকটা শিল-পাটার পাটার মতো । লাল রংয়ের বাড়িটার জায়গায় জায়গায় উঠে যাওয়া ইট সুরকী দেখলেই বুঝা যায় বাড়িটি শত বর্ষের পুরনো । বিকেল বেলায় সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকতো চারদিকে সুনসান তখন ওরা চারজন এই বাড়ির ছাদে চুপিচুপি উঠে পড়তো…..। কিন্তু…. কিছুক্ষণ পরেই ….আবার নামার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত । কারণ, ততক্ষণে …ঐ রহস্য দুই মানবের ছোট মানব অর্থাৎ ডিউক লাঠি হাতে ছাদে এসে উপস্থিত !! সিঁড়ি মুখ আঁড়াল করে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে সে হাতের লাঠি টা বন বন করে এমন ভাবে ঘোরাত যে তাদের দলের সদস্যরা আগে লাফ দিয়ে লাগোয়া একটি ছোট্ট ছাদে নামত তারপর সেখান থেকে উঁচু একটি দেয়ালের উপর দিয়ে দ্রুত হেঁটে বাথরুমের ছাদে…… …. ছাদের সাথে লাগানো ছিল একটি সুপারি গাছ…… সে গাছ বেয়ে সড়…. সড়….. করে নীচে নেমে দিত ভোঁ…. দৌড়। আর তাদের পায় কে…….. ???

হঠাৎ… শিলার চার বছরের ছেলে আফনান ঠান্ডায় কেঁপে উঠল। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে । চারদিকে তাই ঠান্ডার একটা আমেজ। শিলা উঠে পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাঁথাটি ছেলের গাঁয়ে জড়িয়ে দিয়ে আবার তারপাশে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। অমনি তার ভাবনারাও এসে তাকে জড়িয়ে ধরল…….।

ওরা ডিউকের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে চলে আসত লিচু বাগানে ।কিন্তু.. সেখানে কিছুক্ষণ খেলেই আবার… সেই ছাদে যেত….. । আবার…. একই রকম ভাবে সুপারি গাছ বেয়ে সড়.. সড়.. করে নামতো..। খুব মজা পেতো সবাই…….. । ডিউক শুধু ওদেরকে ভয় দেখাতো…. কখনও মারতোনা , যদিও ওর হাতে ইয়া—ব্বড় একটি লাঠি থাকতো…….। হয়তোবা …ওর এই শাসনের মধ্যে এক ধরনের প্রশ্রয়ও ছিল….. । দুই ভাইয়ের তো কোন সন্তান ছিল না……..। কে ..জানে…..।

শিলাকে দেখলেই ছোট ভাইটা হাসত …………..কিন্তু ….ওর হাসি দেখলে শিলার পিলে চমকে যেত। কারণ…. সে মুখ হাঁ- করে এমনভাবে হাসতো……… মনে হতো যেন সে তাকে ভেংচি কাটছে । সে ভয় পেয়ে দূরে সরে যেত…..। কিন্তু…..এখন বুঝতে পারে তার সে হাসির মধ্যে কত মায়া–ই -না -লুকিয়ে ছিল………. ।

কোন কোন দিন ওরা সবার চোখ কে ফাঁকি দিয়ে নদীর ধারেও বেড়াতে যেত…..। নদীটা ছিল বাড়ি থেকে একটু দূরে…. । তাই সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল । কিন্তু…. নদীর ধারের চোখ জুড়ানো কাঁশ ফুল ……..,ছোট ছোট ডিঙিগ নৌকা…….. আর ঝিরঝিরে বাতাস যেন তাদের হাতছাঁনি দিয়ে ডাকতো……। তাই… কোন কোন দিন ওরা পা টিঁপে টিঁপে স্বপ্ন চালিতের মতো এ-কে-বারে নদীর ধারে যেয়ে হাজির হতো । কাঁশ বনে লুটোপুটি খেলে…….ঝিরঝিরে বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে…… দু-ই হাত ডানার মতো ছড়িয়ে পাখির মতো উড়ে……. আর দিগন্তে মিলাতে থাকা ডিঙিগ নৌকাগুলোকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হ-য়ে ঘরে ফিরে আসতো…..।

মাঝে মাঝে ওরা নতুন কোনো বাসায় ও বেড়াতে যেতো… । একবার… ওরা এক ঈদের দিনে …এলাকার এক বড় ব্যবসায়ীর বাসায় বেড়াতে…. গিয়েছিল…. । উনাকে এক নামে সবাই চেনে….. উনি সেই সময়-ই ব্যবসায়-এর কাজে সিঙ্গাপুর ,থাইল্যান্ড ,হংকং ইত্যাদি জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন । ওদের সাথে তিন্নিদের পরিবারের ভাল সম্পর্ক ছিল…। সেই সূত্র ধরেই… ওরা.. ঈদের দিনে নতুন জামা কাপড় পড়ে…. দুপুরের আগ দিয়ে….. হাঁটতে… হাঁটতে …. চলে গেল সেই বাড়িতে….. । বাহ…….!! কি সুন্দর বাড়ি….. !! একদম ছবির মতো……. । সবুজের ছাউনি ঘেরা বাংলো বাড়ি যেন একটা………. । বাড়িটার আশেপাশে ঘর বাড়ি খুব-ই কম । বড় বড় দেবদারু…… শাল….. .আর মেহগনি গাছ বাড়িটাকে আঁড়াল করে রেখেছে । গাড়ি চলাচলের বড় পাকা রাস্তা থেকে একটি চিকন পিচ ঢালা রাস্তা সরাসরি বাড়িটির গেটে চলে গেছে ……। বাড়ির সামনে নদী থেকে নেমে আসা একটি জলা…। চিকন রাস্তাটি এই জলার সাথে সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে… বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে… । প্রধান গেটটি বেশ বড় । ওরা চার জন গেট পার হয়ে গুটি গুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে গেল.. ।
ভিতরে গিয়ে … শিলা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল…. ,যেন সবুজের অপরূপ সমারোহে কেউ তাকে ঢেকে ফেলেছে……..। চিকন পাকা রাস্তার দু’ ধারে হাজারো ফুলের গাছ । হাসনাহেনা ……গোলাপ…… আর বিভিন্ন রকম পাতা বাহারের গাছ…..। ফুল বেশি ফোটেনি ….তাই অন্য রংয়ের চেয়ে বাগানে সবুজের প্রলেপ ই বেশি….. । দুই ধারে প্রশস্ত বাগান আর তার মাঝখানে চিকন পিচ ঢালা রাস্তাটি একেবারে বারান্দার গ্রীলের সাথে গিয়ে মিশেছে…… । ওরা সে রাস্তা ধরে হেঁটে গ্রীলের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল……..। ভিতরে ঢুকে..ও সব জায়গায় শৈল্পিক ছোঁয়ার দেখা মিলল…….। ব্যবসায়ীর স্ত্রী তাদেরকে আদর করে বসাল… এবং …অনেক ধরণের খাবার খাওয়াল । তারপর ওরা খেলতে এল বাগানে……। বাড়ির প্রাচীরের বাইরে বড় বড় গাছগুলো থাকায় এই প্রখর রোদে ও বাগানে ছায়া বিরাজ করছিল….. । কি.. যে.. প্রশান্তি লাগছিল……. শিলার ছোট্ট মনে ….বলে বোঝানো যাবেনা……। সেই বাগানে ছোট ছোট পাখিরা……. যেমন টুনটুনি….. চড়ুই….. দোয়েল …….বুলবুলি …….আরো অ—নেক নাম না জানা পাখি এক ফুলের ঝাড় থেকে উ-ড়ে… উ-ড়ে….. অন্য ফুলের ঝাড়ে যাচ্ছিল….. ।

ওরা ….ও ….পাখিদের সাথে গোটা বাগানে ছোটাছুটি করতে লাগল………। পাখিরা যেন ওদের বন্ধু হয়ে গেল…… । ওদের কে দেখে একটা পাখি –ও ভয় পেয়ে উড়ে গেল না । ওরা বাগানের মধ্যে তিন…. চারটি….. টুনটুনি পাখির বাসাও দেখতে পেল……। অ–নেক সময় ধরে ওরা সে বাগানে খেলা -ধুলা করল……।

হঠাৎ………!! চলে আসার আগ দিয়ে শিলা ওর পিছনে একটা পাখির ডাক শুনতে পেল……,যে কিনা …”ম–য়না ,ম–য়না “বলে চিৎকার করছিল…….. । সে পিছনে তাকিয়ে দেখল…… বারান্দায় গ্রীলের সাথে বাঁধা খাঁচায় বন্দী একটি ময়না পাখি…….. । পাখিটি প্রাচীরের বাইরের এক বড় শাল গাছের দিকে তাঁকিয়ে মাথা উঁচু করে ডানা ঝাঁপটাচেছ আর “ম-য়না……. ম-য়না” বলে চিৎকার করছে ……..। শিলা শাল গাছে তাকিয়ে দেখল ……সেখানে……. আরেকটি পাখি বসে আছে…… । সে পাখিটির কোন খেয়ালই—এইদিকে নেই …….। সে আপন মনে…….. অলস দৃষ্টিতে……. এদিক সেদিক দেখছে ……..আর একটু পর… পর…. ডেকে ডেকে উঠছে….. । কিন্তু…… যতবারই …গাছের পাখিটি ডেকে উঠছে …..ততবারই… বন্দী খাঁচার পাখিটি “ম-য়না……. ম-য়না ” বলে চিৎকার করছে…….. । আর ….তার প্রত্যেক বারের ” ম-য়না ” বলার সাথে… সাথে….. তার চোখে …মুখে …..কি …..যেন……. একটা আকুতি ফুটে ফুটে উঠছে……….!! শিলা আ-র সেখানে দাঁড়াতে পারল না…….. । তার দুই চোখ ভিজে …উঠল……। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে….. বন্ধুদের কাছে চলে আসল………..আর এত আনন্দের মাঝে-ও…. একটা অব্যাক্ত কষ্ট নিয়ে……. বাড়ির .. পথে রওনা হল……..।
হঠাৎ….. শিলার ছেলে আফনান নড়ে ….চড়ে….. উঠল । কখন যে বিদ্যুত্ চলে গেছে শিলা টেঁর- ই পায়নি । কাঁথা গায়ে ছেলেটি তার ঘেমে……. ভিজে গেছে…… । সে দ্রুত হাতে ওর গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিয়ে …….জানালাটি বড় করে খোলে দিল………। সে কাছে এসে তার ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকাল…….আর…… যেন খাঁচায় বন্দী ময়না পাখিটির মতো…… তার সন্তানের শৈশব কালকেও সে খাঁচায় বন্দী দেখতে পেল……… ।

রাজধানী শহরে বড় হওয়া আফনান কি আর এই রকম দুরন্ত শৈশবের স্বাদ কোন—দিন–ও পাবে…..????

আরও পড়ুন