Ads

এখনো বিজয় আসেনি ।। ২য় পর্ব

।। শহীদ সিরাজী ।। 

ফাইজা মাকে কিছুটা অভিমানের ঢংয়ে বললো, “আমি কি পর্দা করে চলি না?”

মা’র অভিযোগ, “হু! কি পর্দা করো তা তো দেখছিই। আচ্ছা নাসিমকে জিজ্ঞাসা কর তোর কতটুকু পর্দা হয়!”

মায়ের কথা শুনে ফাইজার মুখ লজ্জায় লালচে হয়ে উঠলো। নাসিমও বিব্রত তখন। সে কখনো তার দিকে চাইনি। ভাবছে কি বলবে সে!

হাসিম ফোড়ন কেটে বললো, “বাহ নাসিম! এবার তুমি ফাইজার ওপর ফতোয়া দাও দেখি।”

নাসিম নিজের লজ্জা আড়াল করতে ব্যস্ত। স্বসংকোচে কোনরকমে বললো, “না ভাই! আমি কোন শায়খ বা মুফতি নই!”

হাশিম এবার বোনকে ধরলো। আদরের ছোট বোন ফাইজা। কিছুটা বিস্মিত হয়েছে নাসিমের পক্ষে কথা বলতে দেখে। বললো, “তুই তো নাসিমকে সাপোর্ট করে বড় বড় কথা বললি; তা সে শ্রমনীতির কি জানিস।”

ভাইয়ার কথায় ফাইজা বিব্রত বোধ করছে। এভাবে ভাইয়া তাকে নাসিমের কাতারে ফেলতে আরও লজ্জা বাড়লো। বললো, “সরি ভাইয়া!

“কেন সরি কেন তুই না অনেক কিছু জানিস।”

মা এবার বললেন, “ঠিক আছে নাসিম বলবে। তুমি বলো তো বাবা আমরা শুনি, এ ব্যাপারে ইসলাম কি বলে।”

ফাইজা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।নাসিম বললো, “খালাম্মা! সেতো অনেক দীর্ঘ আলোচনা।”

বয়স্ক মহিলা খালাম্মা তিনি সুযোগ পেলেই কুরআন তেলাওয়াত করেন। ইউটিউবে দেশের খ্যাতনামা শায়কদের আলোচনা শুনেন। নফল নামাজ পড়েন। মাঝে মাঝে রোজাও রাখেন। বললেন, “হোক তবুও শুনতে চাই। তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বলো। বলো বাবা।”

নাসিম আর কি করবে। খালাম্মার কথা কি সে অমান্য করতে পারে? বললো, ইসলামে শ্রমনীতি ও শ্রমিকের মর্যাদার অনেক বর্ণনা আছে। আল্লাহ বলেছেন,‘সালাত আদায় হয়ে গেলে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়াবে।’ এছাড়াও আল্লাহ বলেছেন, ‘এমন অনেক লোক আছে যারা জমিনের দিকে ভ্রমণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়ায়।’

হাদিসে রয়েছে, ‘হালাল জীবিকা অন্বেষণ ফরজ ইবাদতের পরে একটি বাড়তি ফরজ।’ কুরআন ও হাদিস গবেষণা করলে এই ধরনের আরো বিষয় আমরা পেতে পারি। ইসলামী শ্রম নীতির এসবই এক একটা দিক।

হাসিম আপত্তি জানিয়ে বললো, “তুমি অর্থনীতি ছেড়ে এবার ধর্মের কথা শোনাচ্ছো। নীতিকথা শোনাচ্ছো।”

নাসিম বন্ধুকে বললো,

“তুমি বোকার মত কথা বলছো। সব শুধু নীতি কিংবা শুধু কথার কথা নয়। আল্লাহর পাঠান সকল নবীদের ইতিহাস যদি পড় তবে অবাক হবে। আল্লাহর সব নবী রসুলগণ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁরা শ্রমের বিনিময়ে কাজ করেছেন। অন্যের উপরে নির্ভরশীল ছিলেন না। আমাদের নবীজির কথাই ধরুন, তিনি নিজে বকরি চরিয়েছেন, ব্যবসায় করেছেন,পারিশ্রমিক নিয়ে কূপ থেকে পানি উঠিয়েছেন, মাটি খনন করেছেন, রান্নার কাঠ সংগ্রহ করেছেন, আবার যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। কোন কাজ করতে তিনি লজ্জাবোধ করেননি। শুধু তিনি নন তার কন্যা ফাতিমা ঘরের সব কাজ নিজেই করতেন।

অন্যান্য নবীদের ইতিহাস পাঠ করলে আমরা এমনটাই দেখি। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম আ. জমি চাষ করতেন. ফসল ফলাতেন; নুহ নবি কাঠমিস্ত্রি ছিলেন; ইদরিস আ. ছিলেন দর্জি। দাউদ আ. ছিলেন কামার, জাকারিয়া আ. ছিলেন তাঁতী আর মুসা আ. ছিলেন ছাগলের রাখাল। এসবই আল্লাহর নীতিমালা। ইসলামে সব কাজই সম্মানের। ইসলামে সৎ ব্যবসায়ীকে সু খবর দেয়া হয়েছে‌। বলা হয়েছে, ‘সত্যবাদী, বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতে নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গী হবে।’ ইসলামে সকলকে পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করা হয়েছে।”

খালাম্মা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন‌। তাদের অনেক কথায় অজানা। ফাইজারও মুগ্ধচিত্ত। তবে হাসিম কথার মধ্যে আবার আবার প্রশ্ন করে বসলো,

“দেখো নাসিম, তুমি যেসব কথা বলছো সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি বা সামাজিক অর্থনৈতিক মতবাদ এ ব্যাপারে ভিন্ন ধারণা পোষণ করে। এই মতবাদে ব্যক্তি মালিকানা বা সম্পত্তি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়। সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো সমাজে ব্যক্তিরা আলাদা হয়ে বাস করে না বা কাজও করে না বরং একে অপরের সহযোগিতায় বাস করে। মানুষ যা কিছু উত্পাদন করে তা সামাজিক পণ্য। যারা উৎপাদনে অংশ নেয় তারা এতে অংশ পাওয়ার অধিকারী। সামগ্রিকভাবে সোসাইটি বা রাষ্ট্র সকলের সুবিধার জন্য সম্পত্তির মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করবে।”

নাসিম হেসে উঠে বললো,

“তুমি যা বললে তা অনেক আগেই ব্যর্থ হয়েছে। মে দিবসে যখন এ আন্দোলন হয়েছিল তখনই শ্রমের সময় ৮ ঘণ্টা, ন্যায্য মজুরির দাবি ও নিপীড়ন-নির্যাতন রোধে আন্দোলন হয়েছিল। সে ১৮৮৬ সালের কথা। তুমি কি জানো, সে আন্দোলনের দাবি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় আরো অনেক পরে ১৯১৭ সালে ঘটেছিল সমাজতন্ত্রের বিজয় বিজয়। তুমি যা বললে সে কথাই তখন বলা হয়েছিল। শ্রমিকরা সাধ্যানুযায়ী কাজ করবে, প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরি পাবে। কিন্তু আজ অব্দি বাস্তবায়িত হয়নি। সমাজতন্ত্রের আগে পুঁজিবাদ যেমন শ্রমিকদের সাথে চরম জুলুম, নির্যাতন ও অধিকারবঞ্চিত করেছিল তেমনই সমাজতন্ত্রও শ্রমিকদের সাথে চরম প্রতারণা ও শোষণ করে চলেছিল। সমাজতন্ত্র ১০০ বছরও কতটুকু করতে পারে নাই। সেই মতবাদ পটল তুলেছে। কেন এই ব্যর্থতা? আসলে শ্রমিকরা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয়ের যাঁতাকলে পড়ে বারবার প্রতারিত হয়েছে। এসবই মানুষের তৈরি করা শ্রমনীতির কুফল। তাই বলছি বিকল্প নীতি হলো ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও শ্রমনীতি। যে কথা আমি আগেই বললাম।”

ফাইজা ভাবছে তাদের অনার্সে ইসলামের অর্থনীতি পড়ানো হয় বটে তবে তা নামে মাত্র, এত চমৎকার ভাবে নয়। নাসিমের ব্যাখ্যা তার বেশি ভালো লাগছে। শুনতে শুনতে সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো। হঠাৎই বলে বসলো, ” আপনার উপস্থাপনাটা বেশ সুন্দর, ধন্যবাদ।”

ফাইজার এমন কথা নাসিমকে বিস্মিত করল। শুনে তার ভালো লাগছে তবে প্রকাশ না করে চুপ করে থাকলো। হাসিম বলল,

“নাসিম! তোমার কথা কি শেষ?”

“না, এখনো রয়ে গেছে।”

ধীরে ধীরে ফাইজার সংকোচ কেটে যাচ্ছে। সংকোচ সত্ত্বেও সে ড্রয়িংরুমের আলোচনায় অংশ নিতে কিছুটা বাধ্য হয়েছে। ব্যাপারটা কাকতালির। কিন্তু গরজ বড় বালাই। কিছু প্রশ্ন আছে তার। জিজ্ঞেস করবে কি করবে না, করলে কিছু মনে করবে কিনা এসব ভাবছে সে। কিছু বিষয় তার জানা চাই। প্রয়োজন তাকে সংকোচ থেকে বের করে আনলো। বললো,

“মে দিবস উপলক্ষে মেয়েদের হলেও একটা আলোচনা অনুষ্ঠান রয়েছে সেখানে আমাকে আলোচনা করতে হবে। দুশ্চিন্তার মধ্যেই ছিলাম। তবেই এ আলোচনা দুশ্চিন্তাকে অনেকটা দূর করছে। কিছু প্রশ্ন আছে। উত্তর পেলে কৃতজ্ঞ থাকবো।”

খালাম্মাও বলল, ” বাবা! তুমি বলো আমরা শুনছি; অনেক কিছুই জানা হচ্ছে। আর ফাইজাও তো জানতে চাচ্ছে।”

নাসিম আমতা আমতা করে বলল, “তোমার কি প্রশ্ন?”

“আলোচনার প্রস্তুতি নেয়া এবং জানার জন্য খুবই প্রয়োজন!”

“ঠিক আছে চেষ্টা করব।’

ফাইজা বলল,”আপনি যা বলেছেন বুঝতে পেরেছি। এখন আমার প্রশ্ন, ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কে কেমন হবে এবং সেখানে শ্রমিক মালিকের অধিকার সংরক্ষণই বা কিভাবে হতে পারে? অনেকে দাবি করেন ইসলামের অর্থনীতি ভারসাম্যপূর্ণ তা আমরা কিভাবে গ্রহণ করতে পারি?”

চলবে…

আগের পর্ব-এখনো বিজয় আসেনি ।। ১ম পর্ব

লেখকঃ  কবি , সাহিত্যিক এবং  সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন এবং সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হইন । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন